“ক্যান্সারে হুমায়ূনকে হারিয়ে ফেলাটা ভীষণ কষ্টের। এটা বাংলা সাহিত্যের জন্য, নাটকের জন্য ভীষণ ক্ষতির।”
Published : 24 Jul 2024, 02:38 PM
হাসি-কান্না, দৈনন্দিন জীবনের ঘটনায় হাস্যরস আর একেবারেই জীবনঘনিষ্ঠ কিছু সংলাপ-সবমিলিয়ে দর্শককে টেলিভিশনের পর্দায় আটকে রাখার মতো গল্পে গেল শতকের নব্বইয়ের দশকে টেলিভিশন নাটকের গতিপ্রকৃতিই পাল্টে দিয়েছিলেন একজন মানুষ।
হুমায়ূন আহমেদ নামের সেই মানুষটির লেখা নাটকের কিছু চরিত্র হয়ে উঠেছিল যেমন বাস্তব, তেমনি সেইসব চরিত্রে অভিনয় করে কেউ কেউ পেয়েছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। তাদেরই একজন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর।
শক্তিমান এই অভিনেতা যে শুধু হুমায়ূন আহমেদের লেখা নাটকে অভিনয় করেছেন তা নয়, লেখক হুমায়ূনের সঙ্গে ছিল তার ব্যক্তিগত সম্পর্কও।
গত ১৯ জুলাই গেছে হুমায়ূন আহমেদের দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকী। লেখকের প্রয়াণ দিবস ঘিরে আসাদুজ্জামান নূর গ্লিটজের কাছে তুলে ধরেছেন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে স্মৃতিকথা। হুমায়ূনের প্রতি তার যেমন ছিল মুগ্ধতা, তেমনি শেষদিকে তার কাজের মান নিয়েও খেদের কথা জানিয়েছেন অভিনেতা।
হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সারে ভুগে চিরবিদায় নিয়েছেন ২০১২ সালে। তার জন্ম ১৯৪৮ সালের ১১ নভেম্বর নেত্রকোণার মোহনগঞ্জে। গল্প, উপন্যাস লেখার পাশাপাশি আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতে শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এই অধ্যাপক। নব্বইয়ের দশকে সিনেমা নির্মাণে পাওয়া যায় তাকে। নটক-সিনেমা নির্মাণ আর লেখালেখিতে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করার জন্য এক সময় শিক্ষকতা ছেড়ে দেন।
হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের ‘বাকের ভাই’ চরিত্রটি বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র ধরা হয়। এই নাটকে অভিনয়ের কারণে আসাদুজ্জামান নূরকে এখনো অনেকেই ‘বাকের ভাই’ নামেই ডাকেন। এছাড়া হুমায়ূনের নাটক ‘বহুব্রীহি’র আনিস, ‘অয়োময়’ এর ‘ছোট মির্জা’ এখনো মানুষের মনে গেঁথে আছে।
আসাদুজ্জামান নূরের ভাষ্য, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তার পরিচয় ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে, প্রযোজন-পরিচালক নওয়াজীশ আলী খানের মাধ্যমে।
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে নূর বলেন, “একটা নাটকে আমারঅভিনয় দেখে হুমায়ূন তখন নওয়াজীশ ভাইকে বলেছিলেন, আমাকে বলার জন্য। পরে নওয়াজীশ ভাই আমাকে হুমায়ূনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর হুমায়ূনের নাটকে অভিনয় শুরু।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হাউজ টিউটরদের জন্য বরাদ্দ বাসায় সে সময় হুমায়ূন আহমেদ থাকতেন জানিয়ে এই অভিনেতা বলেন, “সেসময় আমরা হুমায়ূনের হুমায়ূনের বাসায় অনেক আড্ডা দিয়েছি। বাসায় তেমন কোনো ফার্নিচারও ছিল না। আমরা মাটিতে বসেই আড্ডা মারতাম। টেবিলে খাবার দেওয়া হতো, সিনিয়রা বসতেন। আমরা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতাম। তবে সবাই মিলে খুব আড্ডা হত।”
রসিকতা করা হুমায়ূন আহমেদের স্বভাবজাত ছিল জানিয়ে করে নূর বলেন, “আমার সঙ্গে পরিচয়ের আগেই তো হুমায়ূনের নামডাক তৈরি হয়েছে। উপন্যাস বেরিয়েছে, সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিতি তৈরি হয়েছে। তখন একটা ব্যাপার ছিল, যে বা যারা সাহিত্যচর্চা করেন- তারা টেলিভিশন নাটককে কিছুটা অবজ্ঞার চোখেই দেখতেন। হুমায়ূনকেও এ প্রশ্ন করা হত, যে সাহিত্য থেকে আপনি টেলিভিশন নাটকে যাচ্ছেন কেন? একটা ইন্টারভিউতেও তাকে এ প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন উত্তরে বলেছিলেন- ‘আমার একটা টেলিভিশন কেনা দরকার, এজন্য আমি টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখি’।”
বাকের ভাইয়ের ফাঁসি, চিন্তিত হুমায়ূনও
হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিক নাটকটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় ১৯৯২-৯৩ সালে। নাটকের মূল চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসি আটকাতে সাধারণ মানুষ রাজপথে মিছিল করে প্রতিবাদ করে; তখন পত্রপত্রিকায় এ খবরও গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়।
তখন স্লোগান দেওয়া হয়েছিল- ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’। কোনো নাটকের চরিত্র নিয়ে এমন উন্মাদনা এর আগে দেখেনি কেউ।
স্মৃতি হাতড়ে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ভারতের বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু এ নাটকটি দেখার জন্য ওই সময় কোনো কাজ রাখতেন না।
“তখন আমি পত্রিকায় পড়েছিলাম, জ্যোতি বসু এই নাটকের প্রতিটা পর্ব দেখতেন এবং এই নাটক প্রচারের সময় তিনি কোনো কাজ বা মিটিং রাখতেন না। কারো সঙ্গে দেখাও করতেন না। ভারতের অনেক মানুষ অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে এ নাটক দেখতেন।”
বাকের ভাইয়ের ফাঁসির বিপক্ষে জনমত থাকা সত্ত্বেও চিত্রনাট্য অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত বাকের ভাইয়ের ফাঁসিই দেওয়া হয়।
সেই সময় হুমায়ূন আহমেদের মানসিক অবস্থা কেমন ছিল তা তুলে ধরে নূর বলেন, “হুমায়ূনও তখন এটা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল। পরে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, বাকের ভাইয়ের ফাঁসিটা হোক। হুমায়ূন তখন আমাদের সঙ্গেও আলাপ করেছিল। হুমায়ূনের ভাষ্যটা এরকম ছিল- ‘ফাঁসিটাই থাকুক। কারণ আমাদের দেশে অন্যায়কারীরা এতটাই শক্তিধর, যে তাদের কাছে সত্য পরাজিত হয়’।
“আমি তখন চরিত্রটা ঠিকমত করা নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিলাম। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হওয়া নিয়ে আমি এতটা চিন্তিত ছিলাম না। এখন মনে হয়- ফাঁসি হওয়াতেই মানুষের মধ্যে নাটকটি আরও বেশি গেঁথে গেছে। মানুষ তো আসলে ট্র্যাজেডি পছন্দ করে। আর ওই সময়ের বাস্তবতায় ফাঁসিটাই মানুষকে আরো বেশি আবেগপ্রবণ করেছে।”
লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ কতটা শক্তিশালী ছিলেন তা বোঝাতে নাটকটির শেষ পর্ব প্রচারের দিনের একটি ঘটনা স্মরণ করেন আসাদুজ্জামান নূর।
“নাটকটির শেষ পর্ব যখন প্রচার শুরু হয়- অর্ধেকটা দেখে আমার মা কাঁদতে কাঁদতে উঠে চলে গিয়েছিলেন। তখন তাকে আমরা সবাই বুঝিয়েছিলাম, যে এটা নাটক। কিন্তু তিনি আর পুরো নাটকটি দেখেননি। হয়ত ছেলের ফাঁসি দেখতে চাননি।”
‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে মুনা চরিত্রে সুবর্ণা মুস্তফা, বদি চরিত্রে আবদুল কাদের, মজনু চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জ, মতি চরিত্রে মাহফুজ আহমেদ, বকুল চরিত্রে আফসানা মিমি, উকিল চরিত্রে হুমায়ুন ফরিদীসহ আরো অনেকে অভিনয় করেন।
বহুব্রীহির আনিস
১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি ধারাবাহিক নাটক ‘বহুব্রীহি’। এটি প্রযোজনা করেন নওয়াজীশ আলী খান।
সামরিক শাসনের সেই সময়ে এ ধারাবাহিকে পাখির মুখ দিয়ে বলানো ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি ঘৃণার প্রকাশভঙ্গি হিসেবে মুখে তুলে নেয় বাংলাদেশের মানুষ; পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে স্লোগান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে এ সংলাপ।
একটি পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত হওয়া এ নাটকের আনিস চরিত্রটি করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর।
তিনি বলেন, “বহুব্রীহি নাটকে গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিল, শেষে গিয়ে হুমায়ূন গল্পটা ঘুরিয়ে দিল। ফলে যেভাবে গল্পটি এগিয়েছিল, সেটি আর হয়নি। তারপরও আমি মনে করি বহুব্রীহি একটা ইন্টারেস্টিং কাজ।”
বাকের ভাই নাকি ছোট মির্জা?
হুমায়ূন আহমেদের তৈরি ‘বাকের ভাই’ চরিত্রটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হলেও আসাদুজ্জামান নূরের কাছে ‘অয়োময়’ নাটকের ‘ছোট মির্জা’ই বেশি শিল্পমান সম্পন্ন মনে হয়েছে।
নূরের ভাষ্য, “সাহিত্যের বিচারে যদি বলি, ঘটনার বৈচিত্র্যেও যদি বলি, চরিত্র নির্মাণের দিক থেকে যদি বলি ‘অয়োময়’ আমার কাছে উঁচুদরের নাটক মনে হয়। ‘বাকের ভাই’ চরিত্রটি অনেক জনপ্রিয় হয়েছে, মানুষ পছন্দ করেছে। কিন্তু আমার পছন্দে এগিয়ে রাখব ‘মির্জা’ চরিত্রটিই।”
মির্জা চরিত্রটির শুটিংয়ের স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, “আমি চরিত্রটি করার সময় একটা আংটি পড়তাম এবং সেটি নাড়াচাড়া করতাম। এটা আমার ‘অ্যাক্টিং ম্যানারিজমের’ মধ্যে ছিল। হুমায়ূন আংটি নাড়ানোটা পছন্দ করে একটা পর্বই লিখে ফেলল। হুমায়ূন তো নাটকে কারা অভিনয় করবে, তা মাথায় রেখেই চরিত্র এবং সংলাপ লিখত। নাটক লিখে সবাইকে নিয়ে বসে পড়ে শোনাত।”
হুমায়ূনের তৈরি আরও কয়েকটি চরিত্রও নূরের ভালোলাগার তালিকায় রয়েছে। এর মধ্যে আছে ‘মাটির পিঞ্জিরা’ নাটকের নান্দাইলের ইউনুস, যেখানে নূর অভিনয় করেছেন একজন ভাড়াটে খুনি চরিত্রে। ‘নিম ফুল’ নাটকে চোরের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নূর, সেটিও তার ভালো লাগার চরিত্র।
হুমায়ূনকে নিয়ে কিছু খেদ
হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘দ্বারুচিনি দ্বীপ’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর।
‘চন্দ্রকথা’ সিনেমায় হুমায়ূন আহমেদ কথা রাখেননি জানিয়ে নূর বলেন, “আমাদের দেশে তখন ভালো মেকআপ আর্টিস্ট ছিল না। হুমায়ূনকে বলেছিলাম, আপনি কলকাতা থেকে ভালো একজন মেকআপ আর্টিস্ট আনবেন, এটা আমার পূর্বশর্ত। কিন্তু শুটিং সেটে গিয়ে দেখলাম, সেটা করা হয়নি। এজন্য প্রথম কয়েকদিন আমি খুব মন খারাপ নিয়েই শুটিং করেছিলাম। আমার মনে হয়, এর প্রতিফলনটা আমার অভিনয়েও ছিল। যার কারণে চন্দ্রকথার অভিনয় নিয়ে আমি খুব একটা খুশি হতে পারিনি।”
হুমায়ূন আহমেদের শেষের দিকের কাজ নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না আসাদুজ্জামান নূর। এতে হুমায়ূনের কাজের যে মান, তার কমতি ছিল বলে মনে করেন তিনি।
নূর গ্লিটজকে বলেন, “শেষের দিকে কিছু নাটক হুমায়ূন লিখেছে, কিন্তু সেটি নির্মাণের কাজটি মনে হয় সহকারীরা করেছে। এতে হুমায়ূনের কাজের যে মান, তাতে কিছুটা কমতি ছিল বলে আমার ধারণা। অনেকে আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন। আমার কাছে মনে হচ্ছিল ওই হুমায়ূন আহমেদকে আমি আর খুঁজে পাচ্ছি না।
“এমনও হতে পারে, শারীরিকভাবে তখন অসুস্থ ছিলেন। ক্যান্সারের ব্যাপারটি হয়ত তখন থেকেই শরীরে ছিল, যেটি হয়ত কাউকে বুঝতে দিতেন না। যখন রোগটি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়, তখন চিকিৎসা শুরু হয়, সবাই জানতে পারে। আমার ধারণা, শেষের দিকের কাজগুলো শারীরিক অসুস্থতার জন্যই খুব একটা নিজে করেননি।”
হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সারে মৃত্যু বেদনাদায়ক উল্লেখ করে এই অভিনেতা বলেন, “যখন এটি শুনেছি, তখন বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়েছে। হুমায়ূন তো নিয়ম মেনে চলার মানুষ ছিলেন না। খাওয়া, ঘুমের খুব অনিময় করতেন। তবে একটা নিয়মই খুব মেনে চলতে দেখেছি, যত রাতেই ঘুমুতে যাক- ভোরে ঘুম থেকে উঠে লিখতেন, এটা খুব মেনে চলতেন। এর ব্যতিক্রম আমি খুব একটা দেখিনি। ক্যান্সারে হুমায়ূনকে হারিয়ে ফেলাটা ভীষণ কষ্টের। এটা বাংলা সাহিত্যের জন্য, নাটকের জন্য ভীষণ ক্ষতির।”