খাদ্য সংকটের শঙ্কা কেন করছেন না, ব্যাখ্যা দিলেন দুই মন্ত্রী

চালের বাড়তি দরে মানুষের কষ্টের কথা অবশ্য স্বীকার করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2022, 05:50 PM
Updated : 1 Nov 2022, 05:50 PM

ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা যখন বিশ্বজুড়ে, তখন আগামী অন্তত এক বছর বাংলাদেশে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা নেই বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এবং সাধন চন্দ্র মজুমদার।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভা শেষে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপগুলো সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন তারা।

সারে ভর্তুকি পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছেন জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী রাজ্জাক বলেন, আমন ধান নিয়ে উৎকণ্ঠা কেটেছে, বোরো নিয়েও কোনো শঙ্কা নেই।

খাদ্য ঘাটতির কোনো শঙ্কা নেই দাবি করে খাদ্যমন্ত্রী সাধন বলছেন, অহেতুক আতঙ্ক না ছড়ালে কোনো সমস্যা দেখছেন না তিনি।

মহামারীর পর যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে না। এই সংকট যে আগামী বছরও কাটছে না, সেই পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশ্ব সংস্থাগুলো।

সহসা খাদ্য সংকট তৈরি হওয়ার স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত এখনও সরকারের পরিসংখ্যানে দেখা না গেলেও মূল্যস্ফীতি বহু বছর পর এখন ৯ শতাংশের উপরে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা খাদ্য সংকটের যে ঝুঁকির কথা বলছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের নামও আছে।

এই পরিস্থিতিতেও সঙ্কটের আশঙ্কা না করার কারণ দেখিয়ে কৃষিমন্ত্রী রাজ্জাক বলেন, “এই সংকটের মধ্যে চাল-গমের আমদানি কম হলেও আমাদের বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে।

“সাধারণত আমাদের দেশে কার্তিক মাসে খাদ্যের দাম বাড়ে। কিন্তু এবার বাড়েনি। এই মুহূর্তে মঙ্গা এলাকায়ও কোনো খাদ্য সংকট নেই। গত এক-দেড় মাসে চালের দাম বাড়েনি। আগে বেড়েছিল এটা সত্য, এখন চালের দাম স্থিতিশীল আছে। দাম বেশি আছে, কিন্তু স্থিতিশীল আছে। চালের বাড়তি দরে কিছু মানুষের কষ্ট হচ্ছে। এর সঙ্গে দ্বিমত করছি না।”

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে আমন ফসলহানির যে শঙ্কা করা হচ্ছিল, তেমনটি না হওয়ায় হাঁপ ছাড়ছেন রাজ্জাক। ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টিকে বরয়ং আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন তিনি।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছায় ধান বপনের পরপরই বৃষ্টি হয়েছে। ইনশাআল্লাহ এর পরে সাইক্লোনও হয়েছে। সব মিলিয়ে আমনের অবস্থা বেশ ভালো।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক

রাজ্জাক বলেন, “এবছর শ্রাবণ মাসে মাত্র একদিন বৃষ্টি হয়েছে। আমরা এটার জন্য খুবই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলাম। বৃষ্টির অভাব, পানির অভাবে আমন ধান বপন করা যাচ্ছিল না। আমন ধান হচ্ছে খুবই ফটো সেনসিটিভ। সূর্যের আলো পর্যাপ্ত না পেলে এসব স্থানে তাড়াতাড়ি ফুল চলে আসে। তারপরেও শেষ মুহূর্তে কৃষকরা নানানভাবে সেচের ব্যবস্থা করে আমন ধান বপন করেছে।

“আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছায় ধান বপনের পরপরই বৃষ্টি হয়েছে। ইনশাআল্লাহ এর পরে সাইক্লোনও হয়েছে। সব মিলিয়ে আমনের অবস্থা বেশ ভালো।”

এবার লক্ষ্যমাত্রার বেশি জমিতে আমন চাষ হয়েছে জানিয়ে রাজ্জাক বলেন, “অন্যান্য বছর অতিবৃষ্টির কারণে নিচু জমিতে আমন আবাদ করা না গেলেও এবার অনাবৃষ্টির কারণে ওই সব নিচু জমিতে আবাদের সুযোগ হয়েছে।”

কৃষি উৎপাদনে গতি ধরে রাখতে চলতি অর্থ বছরে সারে ৪৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছেন বলে জানান কৃষিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমাদের বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। একটা বৈশ্বিক আঘাত আসলে সেটা আমরা মোকাবেলা করতে পারব, সে ধরনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আমাদের নেই।

“তবুও সারে গত পাঁচ বছর যেটা ৮ হাজার কোটি টাকা করে আমরা ভর্তুকি দিচ্ছিলাম, সেটা গত অর্থবছর দিয়েছি ২৮ হাজার কোটি টাকা। এবার আমরা জুন পর্যন্ত এস্টিমেট করেছি, আমাদেরকে দিতে হবে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এ টাকা কোথা থেকে আসবে?”

“আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি। তিনি বলেছেন- ‘এটা তোমার চিন্তার বিষয় না, আমরা সারের ব্যাপারে, কৃষি উৎপাদনের ব্যাপারে কোনো ঝুঁকিতে যাব না। কৃষির উৎপাদনটাকে আমাদেরকে সাসটেইন (দীর্ঘস্থায়ী) করতে হবে। যদি ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাগে, এটাও আমরা দিব; তুমি সার কিন’।”

“ইনশাআল্লাহ সারের কোনো সংকট হবে না। কাজেই প্রকৃতি যদি আমাদের সহায়ক থাকে, বোরোতেও কোনো ঝুঁকি হবে না,” বলেন রাজ্জাক।

বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান, আর তার চাহিদার প্রায় পুরোটাই দেশের উৎপাদনেই মেটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হলে তখন চাল আমদানি করতে হয়।

Also Read: খাদ্যাভাবের ঝুঁকি কতটা, বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?

সরকারের হিসাবে, দেশের মানুষকে খাওয়াতে বছরে মোটামুটি ৩ কোটি ৫০ লাখ টন চাল এবং ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন আটা লাগে।

তবে আটার ১০ শতাংশের মতো দেশীয় জোগান থেকে আসে।

বর্তমানে সরকারি গুদামে প্রায় ১৬ লাখ টন খাদ্যের মজুদ আছে। এর মধ্যে চাল প্রায় ১৪ লাখ টন, গম এক লাখ ৮০ হাজার টন। আর গুদামে ধান আছে ২০ হাজার টন। আমন মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহে নেমেছে সরকার, যা মজুদ সমৃদ্ধ করবে।

তবে আমদানি করতে গেলেই লাগবে ডলার, রিজার্ভে চাপ বাড়ায় তা এখন বড় সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ডলারের দাম ও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশে খাদ্যের আমদানি কম হলেও দেশের খাদ্য মূল্যবৃদ্ধি ‘স্থিতিশীল’ থাকা শক্তিশালী ‘জোগান ব্যবস্থা’র ইঙ্গিত হিসেবে দেখাচ্ছেন রাজ্জাক।

তিনি বলেন, “গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৫ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানি করার কথা ছিল। সেখানে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র এক লাখ টন। ৬ লাখ টন গম আমদানি হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৫৪ হাজার টন।

“তারপরেও চালের দাম বেড়ে যাওয়া, বাজারে চালের সংকট হওয়া এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে দেশে খাদ্য সংকট অতটা নেই।”

খাদ্যের কোনো ঘাটতি হবে না। গেল, গেল-গেল, আইলো-আইলো এ ধরনের আতঙ্ক যদি আমরা না ছড়াই, তাহলে আমার মনে হয় আমরা বাংলাদেশবাসী অনেক শান্তিতে আছি এবং শান্তিতে থাকব।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার

সারাবিশ্বে ২৩০ ডলার থেকে আড়াইশ ডলারের মধ্যে প্রতি টন গম বেচাকেনা হলেও এখন সেটা ৫০০ ডলারের উপরে উঠে গেছে। সাধারণত গমের দাম বেড়ে গেলে চালের উপরে প্রভাব পড়ে, তখন চালের দামও বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতেও আমদানি কম।

বেসরকারিভাবে গম আমদানি কমে যাওয়া প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ইউক্রেইন-রাশিয়ার আমদানি বাজার বন্ধ হলেও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা খোলা আছে। তারপরেও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি হওয়ার কারণে অনেকেই হয়ত চাহিদা মতো গম আমদানি করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে দেশীয় জোগানের উপর চাপ বেশি পড়বে।

সেজন্য সরকারিভাবে অতিরিক্ত ১০ লাখ টন চাল বেশি আমদানির পরিকল্পনা করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলো ধীরে ধীরে দেশের বাজারে ঢুকছে। এর বাইরে রাশিয়া থেকে পাঁচ লাখ টন গম আমদানির চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া থেকে প্রতি মাসে দুটি করে জাহাজ আসতে থাকবে। এসব জাহাজের ৫০ থেকে ৫২ হাজার টন গম থাকবে।

“সবাই মিলে আমরা যদি পজিটিভ থাকি, আর পজিটিভ নিউজ যদি করি, ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ খাদ্যের কোনো ঘাটতি হবে না। গেল, গেল-গেল, আইলো-আইলো এ ধরনের আতঙ্ক যদি আমরা না ছড়াই, তাহলে আমার মনে হয় আমরা বাংলাদেশবাসী অনেক শান্তিতে আছি এবং শান্তিতে থাকব,” বলেন সাধন মজুমদার।