“খেলাপি হওয়া ব্যক্তিকে শাস্তি দিলেও তার কোম্পানিকে পুনর্গঠন করা যেতে পারে। কোম্পানির উৎপাদন কার্যক্রম যেন বন্ধ না হয়,’’ বলেন তিনি।
Published : 29 Oct 2022, 08:35 PM
উচ্চ হারের খেলাপি ঋণে জর্জরিত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপিদের আরও সুবিধা দিতে আইন সংস্কারের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
তিনি বলেছেন, ‘‘খেলাপিদের এক্সিট সুবিধা দিতে ব্যাংক আইন সংস্কারে কাজ করা হচ্ছে, আমরা এটি চাচ্ছি।’’
অনেকেই ইচ্ছেকৃত খেলাপি হয়েছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যারা খেলাপি হচ্ছেন তাদের এক্সিট দিতে হবে। খেলাপি হওয়া ব্যক্তিকে শাস্তি দিলেও তার কোম্পানিকে পুর্নগঠন করা যেতে পারে। কোম্পানির উৎপাদন কার্যক্রম যেন বন্ধ না হয়।’’
শনিবার সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বের প্রকল্প (পিপিপি) বাস্তবায়নে সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে এফবিসিসিআই আয়োজিত সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
রাজধানীর মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে ‘অ্যাচিভিং ভিশন ২০৪১: দ্যা রুল অব পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপস (পিপিপি)’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছিলেন তিনি।
বকেয়া কিস্তি পরিশোধে ছাড় এবং পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়ার পরও ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ মাস জুন শেষে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর প্রান্তিকে মার্চ শেষে যা ছিল ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এ হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়ে জুন শেষে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। গত মার্চে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।
গত জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা।
এত বিপুল খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৮ জুলাই ঋণ পুনঃতফসিলে ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষেত্রে বড় ছাড় দেয়। এতে পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো ও নগদ এককালীন জমা দেওয়ার হার কমিয়ে ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
এরপর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিতে আরও বদল আনা হয় ৪ অগাস্ট। নতুন সংশোধনীতে আরও ছাড় দেওয়া যেমন হয়েছে, তেমনি বেশ কিছু ক্ষেত্রে কড়াকড়িও করা হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে খেলাপিদের যাদের মধ্যে ব্যবসায়ী ও শিল্পদোক্তাই বেশি তাদের ঋণের চক্র থেকে বের হওয়ার সুযোগ দেওয়ার প্রসঙ্গে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানালেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান।
তিনি বলেন, বর্তমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে এরকম কোনো সুযোগ নেই।
“এজন্য আমরা ব্যাংক কোম্পানিতে সংস্কার এনে খেলাপিদের এক্সিট দিতে চাচ্ছি।“
পিপিপি এর প্রক্রিয়া দ্রুত করতেও প্রয়োজনে আইন সংস্কারের কথা বলেছেন তিনি। এফবিসিসিআইয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে তার বক্তব্য তুলে ধরা হয়।
তিনি বলেছেন, “বর্তমান আইনে পিপিপির প্রক্রিয়া দ্রুত করা সম্ভব কি না, তা যাচাই করে দেখতে হবে। যদি দরকার হয়, আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু এই পথেই যেতেই হবে।“
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং দেশের রিজার্ভ ও বাজেট সীমাবদ্ধতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পিপিপি প্রকল্প গ্রহণ ছাড়া কোনো উপায় নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিদ্যুৎ খাতে পিপিপি সফল হয়েছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন,
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল মাত্র ৪৫০০ মেগাওয়াট। কিন্তু আইন পরিবর্তন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি খাতে মোট ৫৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। বিদ্যুৎখাতের সফল পিপিপির কারণেই বর্তমান অর্থনৈতিক অগ্রগতি এসেছে।
পিপিপিকে দ্রুত করতে, এর আওতায় দেওয়া প্রকল্প প্রস্তাবে অর্থায়ন সক্ষমতার প্রমাণাদি দলিল সংযুক্ত থাকলে সেগুলোকে ফাস্ট ট্রাক প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন তিনি।
পিপিপি এর মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে সব মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন জানিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, পরিকল্পনাগুলো হতে হবে গবেষণাভিত্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্যতার নিরিখে, যেখানে পরবর্তীতে পরিকল্পনা সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজন করার প্রয়োজন হবে না।
পিপিপি এর মাধ্যমে দেশি বিদেশি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদাহরণ টেনে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফরেইন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি ও স্টান্ডার্ড চার্টাড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী নাছের এজাজ বিজয়।
বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে কয়েকটি দেশের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ও গ্রিসের সমুদ্রবন্দর নির্মাণে পিপিপির সফলতা তুলে ধরা হয় প্রবন্ধে।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বড় প্রকল্পে অর্থায়ন শুধু সরকারি তহবিলে সম্ভব নয়। বিশেষ করে অবকাঠামো, শিল্পে বিনিয়োগ, বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর মত প্রকল্প পিপিপি এর মাধ্যমে করা সম্ভব হবে।
সেমিনারে জানানো হয়, বর্তমানে ৭৬টি প্রকল্প পিপিপির মাধ্যমে হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
সবখানেই পিপিপি নেওয়া ঠিক হবে না মন্তব্য করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘‘ঢাকার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় সরকারকে লিখিতভাবে সার্বভৌম গ্যারান্টি দিতে হয়েছে, এখানে ২৪ বছরের মধ্যে কোনো সরকারি প্রকল্প নেওয়া যাবে না।’’
অথচ দেশের পর্যটননগরী সিলেট, বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রাম, পদ্মা সেতু ও বরিশাল বিভাগে যাওয়ার এটি একমাত্র দুয়ার, যা একটি অর্থনৈতিক করিডোর বলে জানান তিনি।
এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে এবং মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করাসহ কয়েকটি প্রকল্প এ এলাকায় বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। আরেকটি প্রকল্পের শেষ প্রান্ত হচ্ছে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী। এখন কীভাবে এটি হবে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
দেশে পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা ভূমি অধিগ্রহণ উল্লেখ করে পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, দেশে অবকাঠামো খাতে পিপিপি বাস্তবায়নে দুর্বলতা রয়েছে। প্রকল্প খরচ ও সময় বেড়ে যাচ্ছে।
অন্যান্য বক্তারা মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে ২০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ টানতে সুশাসনে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন।
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন উদ্দিনের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন পিপিপিএ এর প্রধান নির্বাহী মো. ইব্রাহিম, বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি মোখলেসুর রহমান, ইডকল এর পরিচালক আব্দুল হক, ইউনাইটেড গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক কায়েস খলিল খান, পিপিএ উপদেষ্টা মোহাম্মদ হাসান হায়দার, এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী।
আরও পড়ুন:
খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিতে আরও বদল
খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে ‘বড় ছাড়’ কেন বাতিল নয়: হাই কোর্ট