বড় ছাড়েও খেলাপি ঋণ বাড়ল ১২ হাজার কোটি টাকা

“জুন শেষে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা,”- বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 August 2022, 01:40 PM
Updated : 11 August 2022, 01:40 PM

বকেয়া কিস্তি পরিশোধে ছাড় এবং পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়ার পরও তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। মার্চে যা ছিল ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, “জুন শেষে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা।”

গত মার্চে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা।

গত জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা।

Also Read: খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে ‘বড় ছাড়’

Also Read: খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিতে আরও বদল

গত মার্চে এর স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৬৮ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা।

ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে গত ১৮ জুলাই ঋণ পুনঃতফসিলে ব্যবসায়ীদের বড় ছাড় দিয়ে নতুন নীতিমালা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তখন ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোসহ নগদ এককালীন জমা দেওয়ার হার কমিয়ে ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানো হয়।

এর ১৬ দিনের মধ্যে সংশোধনী দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া নতুন সার্কুলারে ঋণ খেলাপিদের আরও ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি বেশ কিছু ক্ষেত্রে কড়াকড়িও করা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৭ হাজার ৯৩ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ।

২০২১ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৮ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা এবং হার ছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে স্থিতি ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, মোট খেলাপির মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকে যা ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

এছাড়া বিদেশি শাখার ব্যাংকে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকে ৪ হাজার ১৯৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

ঋণ অবলোপন, পুনঃতফসিল, উচ্চ আদালতে রিটের কারণে খেলাপি না দেখানো ও ঋণ পুনর্গঠন মিলিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের তথ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বরাবরই আপত্তি জানিয়ে আসছে।

২০১৯ সালের জুনে আইএমএফ এর একটি প্রতিবেদনে তখন বলা হয়, বাংলাদেশের প্রকৃত খেলাপির অনেক তথ্যই আড়াল করে রাখা হচ্ছে। প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে।

কোভিড-১৯ এর প্রভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি না দেওয়া এবং আংশিক দিয়ে খেলাপি না হওয়ার সুবিধা ছিল।

তখন ধরে নেওয়া হয় মার্চ শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে ২০২০ ও ২০২১ সালের বকেয়া কিস্তির পুরো অর্থ পরিশোধেও ছাড় দিয়ে সময় বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

সর্বশেষ গত ২২ জুন আরও ছাড় দিয়ে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি না হওয়ার সুবিধা দেওয়া হয়।

সেসময় জানানো হয়, গত দুই বছরে বড় ঋণের বকেয়া কিস্তির ন্যূনতম ৫০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ দিলে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের খেলাপি করা যাবে না।

আর ছোট ও মাঝাড়ি আকারের ঋণের সর্বনিম্ন ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পরিশোধ করলে তাদের খেলাপি হিসেবে দেখানো যাবে না।

ফলে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের একটি অংশ অপ্রকাশিতই থাকছে।

এসব বকেয়া ঋণের বিপরীতে নতুন কোনো ছাড় না দিলে আগামী বছরের মার্চ শেষে তাদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।

যদিও গত ১৮ জুলাই খেলাপি হওয়া ঋণের পুনঃতফসিল ও পুনঃর্গঠনের বিষয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এখন থেকে কোনো ঋণ পুনঃতফসিল করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিটি ব্যাংক ঋণ পুনঃর্গঠন ও পুনঃতফসিলের নীতিমালা করবে।

নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনঃর্গঠন করছে কি না তা দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপির পরিমাণ কাগজে-কলমে আরও কমে আসবে বলে মনে করছেন বিশ্বেষকরা।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ঋণ পুনঃতফসিল করার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার প্রভাব সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনঃতফসিল করার ক্ষেত্রে যৌক্তিক হতে হবে।

“শুধু প্রকৃত অর্থেই কোনো কারণে খেলাপি হয়ে গেছে, তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করতে হবে। আর স্বভাবজাতদের কোনো সুবিধা দিয়ে লাভ নেই।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে গত জুন পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। খেলাপির হার ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকে ১০ লাখ ৪২ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা, খেলাপির হার ৬ শতাংশ।

আর বিদেশি শাখায় ৬৭ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা, খেলাপির হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকে ৩৫ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা, খেলাপির হার ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ।