রোববার ঋণের হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে রয়েছে।
এ হিসাবে ২০২১ সালের মার্চের তুলনায় চলতি বছর মার্চে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার এ প্রবণতা সহজেই কমবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘ঋণ খেলাপিদের যতদিন সুবিধা দেওয়া হবে ততদিন বাড়বেই। তাদের তো সুদ মওকুফও করে দেওয়া হয়।’’
সুদ মওকুফ ও খেলাপিদের ছাড় দিয়ে আদায় বেড়েছে বা খেলাপি কমেছে এমন নজির নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, “খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় কী শাস্তি দেওয়া যায় তা বের করতে হবে। তাদের জামানত বিক্রি করে আদায় করতে হবে।’’
খেলাপি ঋণ বাড়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল বলেন, “কোভিড-১৯ এ ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রণোদনার ঋণ আদায় ও নিয়মিত ঋণের বকেয়া পরিশোধে ছাড় দেওয়া হয়। ১৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়েও ঋণকে নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। তা অনেকেই নিতে পারেননি।
“আবার গত প্রান্তিকে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার মন্দ ও সন্দেহযুক্ত ঋণের উপর কিন্তু সুদযুক্ত হয়েছে। এসব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে।“
অর্থনীতি স্বাভাবিক হলে খেলাপি ঋণ আদায় বেশি হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
৩ মাসে নতুন ঋণ ২৮ হাজার কোটি টাকা
দেশের ব্যাংকিং খাতে ২০২১ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে গত মার্চে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।
করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের নানা নীতি সুবিধা দেওয়ার পরও গত এক বছরে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা (১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ)।
ফাইল ছবি
সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংক থেকে দেওয়া মোট ঋণের মধ্যে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে মোট ঋণের স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ১৩ লাখ ১ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা।
এ হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিকে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২৭ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা।
সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ কত?
মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ২০ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকে এ হার ১২ শতাংশ, বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোতে ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মার্চ শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৪৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা।
এসময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৫৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা।
আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর ঋণ স্থিতি ৬৩ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা।
বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৩৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা।
কোভিডের কারণে ব্যবসায়ীদের ছাড়
করোনাভাইরাসে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হলে ২০২০ সালে কোনো ঋণকে খেলাপি দেখানো হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে। এসময় ঋণের কিস্তি আদায়ও বন্ধ ছিল কিছু সময়।
ব্যবসায়ীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সুবিধা বাড়িয়ে ঋণকে খেলাপি না দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়।
এরপর ২০২১ সাল শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক বকেয়া ঋণের ১৫ শতাংশ জমা দিলে সেই ঋণকে আর খেলাপি দেখানো যাবে না বলেও ব্যবসায়ীদের ছাড় দেওয়া হয়।
মহামারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে ব্যবসা বাণিজ্যে গতি আসলে খেলাপি ঋণ বিষয়ক আগের দেওয়া বেশ কিছু সুবিধা ধীরে ধীরে তুলে নিতে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করেই এখন বাড়তে শুরু করেছে খেলাপি ঋণের অঙ্ক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংকাররা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। সব সুবিধা তুলে দিলে আগামী জুন শেষে কিছুটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ে।
এদিকে গত ৩১ মে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল ব্যবসায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে দেখা করে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন করে খেলাপি ঋণ শ্রেণিভুক্ত না করার অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও সিদ্ধান্ত জানায়নি।
ব্যবসায়ীদের এমন দাবি প্রসঙ্গে মির্জ্জা আজিজ বলেন, ‘‘এক শ্রেণির ব্যবসায়ী তো চাইবে সুদ দিতে হবে না, ঋণও পরিশোধ করতে যেন না হয়।“
ঋণ খেলাপীদের সব সুবিধা বাতিল করে অর্থ আদায়ের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “তাদের সুবিধা দিয়েও তো কোনো উন্নতি হচ্ছে না।’’