বাংলাদেশের জন্য ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করল আইএমএফ বোর্ড

আইএমএফের ঋণ মঞ্জুরির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2023, 07:26 PM
Updated : 30 Jan 2023, 07:26 PM

সংকটকালে বাংলাদেশের বহু প্রত্যাশিত ঋণের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদ।

৪.৭ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণের সুবাদে দুর্বল হয়ে পড়া রিজার্ভের বিপরীতে বিদেশি মুদ্রার একটি ‘বাফার’ তৈরির সুযোগ পাবে বাংলাদেশ।  

৪২ মাসের চুক্তিতে সরকারের নেওয়া ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা হিসেবে আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) থেকে ৩৩০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ।

এর অংশ হিসেবে প্রথম কিস্তির ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিকভাবে ছাড় করা হবে বলে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে আইএমএফ।

এছাড়া আইএমএফ এর নবগঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় বাংলাদেশ পাবে ১৪০ কোটি ডলার। বাংলাদেশই প্রথম এশীয় দেশ, যার এই তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে।

২.২ শতাংশ সুদে নেওয়া এই ঋণ আসবে সাত কিস্তিতে। শেষ কিস্তি আসবে ২০২৬ সালে।

ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটে পড়া বাংলাদেশ রিজার্ভ বাড়াতে এমন অর্থের প্রত্যাশায় ছিল।

আইএমএফও তাদের বিবৃতিতে বলেছে, মহামারীর ধাক্কা সামলে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল বাংলাদেশ, কিন্তু ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাতে বৈদেশিক বাণিজ্যে চলতি হিসাব ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, টাকার মান কমে গেছে এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে।    

সাম্প্রতিক এই অর্থনৈতিক জটিলতাগুলো মোকাবেলায় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ একগুচ্ছ সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার মনে করে, প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করতে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণে, উত্পাদনশীলতা বাড়াতে এবং জলবায়ু সহনশীলতা তৈরি করতে হলে তাত্ক্ষণিক এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করার পাশাপাশি, দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত সমস্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিগুলোকেও আমলে নিতে হবে।”

বাংলাদেশকে ঋণ দিতে গত নভেম্বরে ঢাকায় কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছায় আইএমএফ। সেই ঋণচুক্তির শর্তসহ খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ার মধ্যেই বাংলাদেশ সফর করেন আইএমএফের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ।

এরপর বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফ এর নির্বাহী বোর্ডের সভায় ওঠে এবং অনুমোদন পায়।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঋণদাতা এ সংস্থার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেছেন, “বিশেষ করে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আন্তোয়নেট মনসিও সায়েহ এবং মিশনপ্রধান রাহুল আনন্দসহ যে দলটি এই ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন তাদের প্রতি জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।”

আইএমএফের এই ঋণ মঞ্জুরির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন মুস্তফা কামাল।

তিনি বলেন, “অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছিলেন যে আইএমএফ হয়তবা আমাদেরকে এই ঋণ দেবে না। তারা ভেবেছিল, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাসমূহ দুর্বল তাই আইএমএফ এ ঋণ প্রদান থেকে বিরত থাকবে।

“এ ঋণ অনুমোদনের মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হল যে, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাসমূহ শক্ত ভিতের উপরে দাড়িয়ে আছে এবং অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো।”

কোভিড মহামারীর ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বড় ধরনের চাপে পড়েছে; ডলারের বিপরীতে মান হারিয়ে চলছে টাকা, মূল্যস্ফীতিও পৌঁছেছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে।

রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানিতে লাগাম টানায় অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে; জ্বালানি সংকটের মুখে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের মত দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকিও বাংলাদেশের সামনে রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে গত জুলাই মাসে আইএমএফ এর কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ। আইএমএফ এর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল অক্টোবরের শেষে ঢাকায় আসেন।

দুই সপ্তাহ সরকারে বিভিন্ন দপ্তর, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অংশীজনদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের পর ঋণের বিষয়ে প্রাথমিক সমঝোতার কথা জানানো হয় সরকারের তরফ থেকে।

Also Read: আইএমএফের ঋণ: দুয়ার খুলবে আরও বিদেশি অর্থায়নের

Also Read: ঋণ আলোচনা: জানুয়ারিতে ফের আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক

Also Read: ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে আইএমএফ, প্রাথমিক সমঝোতা

আইএমএফ বলছে, ইসিএফ ও ইএফএফ এর আওতায় যেসব প্রকল্প নেওয়া হবে, সেগুলো সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অক্ষুন্ন রাখা এবং ঝুঁকিতে থাকাদের সুরক্ষিত করার পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভিত তৈরিতে সহায়ক হবে।

আইএমএফ  পর্ষদ সভার আলোচনার উপসংহারে উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ধারাবাহিক উন্নতি করেছে। কোভিড-১৯ মহামারী এবং পরে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ দীর্ঘ সেই অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। একাধিক ধাক্কা বাংলাদেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।”

তিনি বলেন, বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের ফল হিসেবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারকে সংস্কার কর্মসুচির গতি আরও ত্বরান্বিত করতে হবে যাতে আরও টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়। 

“সুতরাং, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে বাংলাদেশকে মানবোন্নয়ন এবং অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়গুলোতে অবগত। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটও বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হবে, যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।"

সংস্কারসমূহ

  • এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ)/এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) ঋণের অর্থ সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখবে এবং দুর্বল হয়ে পড়া রিজার্ভের বিপরীতে বিদেশি মুদ্রার জন্য ‘বাফার’ হিসেবে কাজ করে সংস্কার ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে।

  • কর নীতি ও রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের কৌশল বাস্তবায়ন করা হলে তাতে সামাজিক, উন্নয়ন ও জলবায়ু খাতে টেকসইভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।

  • সরকারি ব্যয়, বিনিয়োগ এবং ঋণ ব্যবস্থাপনা আরও সুসংহত করতে সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হলে তাতে আরও দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও ভালোভাবে সরকারি অর্থ ব্যয় নিশ্চিত করা যাবে।

  • আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমানো, তদারকি জোরদার এবং সুশাসন ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করার পাশাপাশি পুঁজিবাজারের যথাযথ বিকাশ ঘটানো গেলে তা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের যোগান দিতে সহায়ক হবে।

  • বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য কাঠামোগত সংস্কার, আর্থিক খাতের গভীরতা বৃদ্ধি, মানবোন্নয়ন এবং ব্যবসা পরিবেশের উন্নয়নে সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা আরও বাড়বে।