চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ঘরের বাইরে তালা লাগিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যার পর ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার পাননি স্বজনরা।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সেই ঘটনা দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। নিহতদের স্বজনদের সমবেদনা জানাতে বাঁশখালী ছুটে গিয়েছিলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর কেটে গেছে দুই দশক। কিন্তু বিচারের আশায় এখনও আদালতে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে মামলার বাদী বিমল শীলকে, যিনি সে সময় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
চার-পাঁচ মাস পরপর একবার সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ আসে। কোনো কোনো তারিখে সাক্ষী না আসায় শুনানি পিছিয়ে যায়। দীর্ঘ সময়েও বিচার কাজ শেষ না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন বিমল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনার পর আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে সমাবেশে আশ্বাস দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হবে।
“বিএনপি সরকারের আমলে প্রধান অভিযুক্ত আমিনুর রহমানকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। আমরা নারাজি দিয়েছিলাম। এ সরকারের আমলে তাকে আসামি করায় আমরা খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু সরকার তিন দফায় ক্ষমতায় থাকার পরও বিচার কাজ শেষ না হওয়ায় আমরা খুবই হতাশ।”
মামলার বাদীর আশঙ্কা, এভাবে দেরি হতে থাকলে বাবা-মাসহ স্বজন হারানোর বিচারের আশা হয়ত তাকে ‘ছেড়েই দিতে হবে’।
২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় তেজেন্দ্র লাল শীলের ঘরের বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে ‘গান পাউডার ছড়িয়ে’ আগুনে পুড়িয়ে নারী-শিশুসহ ১১ জনকে হত্যা করা হয়। ওই সময় ঘর থেকে বের হয়ে পালিয়ে বেঁচে যান বিমল শীল।
আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত হন বিমলের বাবা তেজেন্দ্র লাল শীল (৭০), মা বকুল শীল (৬০), ভাই অনিল শীল (৪০), অনিলের স্ত্রী স্মৃতি শীল (৩২), অনিলের তিন সন্তান রুমি শীল (১২), সোনিয়া শীল (৭) ও চার দিন বয়সী কার্তিক শীল, তেজেন্দ্র শীলের ভাইয়ের মেয়ে বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদি শীল (১৭), অ্যানি শীল (৭) এবং কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা আত্মীয় দেবেন্দ্র শীল (৭২)।
বিমল জানান, ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগে তার স্ত্রী তিন বছর ও এক বছর বয়েসী দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে নগরীতে তার শ্বশুরের বাসায় গিয়েছিলনে। আর বিমল নিজে বাড়িতে ছিলেন। দুই তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে জীবন বাঁচালেও পা ভেঙে বেশকিছু দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল তার।
“আমার স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান বাড়িতে থাকলে তাদের কী পরিণতি হতো ঈশ্বর জানে,” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন বিমল।
এ ঘটনায় বেঁচে যাওয়া বিমল শীল মামলা করেন বাঁশখালী থানায়। ওই ঘটনায় স্থানীয় বিএনপি নেতা আমিনুর রহমান জড়িত বলে সে সময় অভিযোগ উঠলেও তৎকালীন সরকারের সময়ে তদন্তে পুলিশ তাকে অভিযুক্ত করেনি।
মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা সাতকানিয়া সার্কেলের তৎকালীন এএসপি ক্লারেন্স গোমেজ ২০০৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমিনুরকে বাদ দিয়ে ৩১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে তদন্ত শেষ করেন। মামলার বাদী বিমল শীল এর বিরুদ্ধে নারাজি দিয়ে অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন। আদালত ২০০৭ সালের ২০ মার্চ মামলাটি অধিকতর তদন্তে পাঠায়।
এরপর বেশ কয়েকবার আমিনুর রহমানকে বাদ দিয়ে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলেও প্রতিবারই বাদী এর বিরোধিতা করে আদালতে অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন।
সবশেষ ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি এ মামলার অষ্টম তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হ্লা চিং প্রু অভিযোগপত্র জমা দেন। যেখানে আমিনুর রহমানকেও আসামি করা হয়, সাক্ষী করা হয় ৫৭ জনকে। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আদালত।
এ মামলার ৩৭ আসামির মধ্যে ১৮ জন পলাতক, আর ১৮ জন জামিনে আছেন। প্রধান আসামি স্থানীয় বিএনপি নেতা আমিনুর কারাগারে আছেন।
বিমলের আক্ষেপ, অভিযোগ গঠনের ১২ বছর পরও চাঞ্চল্যকর এ মামলায় ৫৭ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২৭ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। মামলার তারিখ পড়ে প্রায় চার মাস পরপর। এ মামলায় বাঁশখালীর তৎকালীন ইউএনও, থানার ওসিসহ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে সাক্ষী করা হয়েছে, কিন্তু তাদের কেউ সাক্ষ্য দেননি।
“এ বছরের শুরুতে ১২ ফেব্রুয়ারি আদালত চার জনের সাক্ষ্য নিয়েছে। তারপর ১২ জুন ও গত ৯ নভেম্বর মামলার দুটো তারিখ ছিল। কিন্তু কোনো সাক্ষী হাজির হয়নি। পরের তারিখ দিয়েছে আগামী বছরের ৮ এপ্রিল।”
চট্টগ্রাম জেলা আদালতের পিপি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাক্ষ্য দিতে না আসায় এ মামলায় অনেক সাক্ষীর নামে ওয়ারেন্ট হয়েছে। পুলিশও তৎপর আছে তাদের হাজির করতে। যেসব পাবলিক সাক্ষী আছে, তাদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী রয়ে গেছে। সে কারণে অফিসিয়াল সাক্ষীদের ডাকা হচ্ছে না।
আগামী ছয় মাসের মধ্যে আলোচিত এ মামলার বিচার কাজ শেষ হবে আশা প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, “পাবলিক সাক্ষীদের হাজির করতে না পারলে তখন আমরা সরকারি সাক্ষীদের হাজির করে মামলার সমাপ্তি ঘটাব।”
বিচার শেষের আশা নিয়ে বিমল বলেন, “প্রতিবছর এ দিনটিতে বাড়ি যাই। সেখানে শ্মশানে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ধর্মীয় কাজ করি। এ বছরও একইভাবে যাব। তাছাড়া তেমন আর বাড়িতে যাওয়া হয় না।”
তিনি জানান, ঘর তৈরির জন্য গত বছর তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্থিক অনুদান চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাতে সায় দিয়ে ৪৫ লাখ টাকা দিয়েছেন বেঁচে যাওয়া তিন ভাইকে।
“সে টাকা খরচ করে আলাদা তিনটি ঘর তৈরি করেছি। সেগুলোর বেশিরভাগ কাজ শেষ। ছোটখাট কিছু কাজ বাকি আছে। সে ঘর তৈরি হলে বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারব।”
আরও পড়ুন