“আগে যদি বলে দেওয়া হত, আমরা আসতাম না। এসে লাভের পরিবর্তে লোকসান গুনতে হচ্ছে,” বলেন কেরানীগঞ্জের শাকিল।
Published : 24 Apr 2025, 09:38 PM
গৃহস্থালি ও ঘর সাজানোর পণ্য কিনতে চট্টগ্রামের মানুষ যে মেলার অপেক্ষায় থাকেন সেই বৈশাখী মেলায় এসে ‘বিপাকে’ পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ঐতিহ্যবাহী ‘আব্দুল জব্বারের বলী খেলা’ ঘিরে এই মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা বলছেন প্রতিবছর মেলায় পসরা সাজিয়ে বসতে পারলেও এবার পুলিশ তাদের দোকান বসাতে বাধা দিচ্ছে।
অনেক ব্যবসায়ী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মালামাল নিয়ে মেলায় এলেও পুলিশের বাধার কারণে মালামাল পুনরায় ফেরৎ পাঠিয়ে দিচ্ছেন বলে দাবি করেছেন তারা।
পুলিশ পুলিশ বলছে, মেলা চলবে, কিন্তু রাস্তা দখল করে কেউ দোকান নিয়ে বসতে পারবে না।
বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১২ বৈশাখ চট্টগ্রাম নগরীর ঐতিহাসিক লালদিঘী মাঠে জব্বারের বলী খেলা হয় প্রতিবছর। শুক্রবার হবে বলী খেলার ১১৬তম আসর।
খেলার আগের দিন ও পরের দিন মিলিয়ে মোট তিন দিন হয় বৈশাখী মেলা।
বলী খেলাকে ঘিরে এ বৈশাখী মেলার জন্য অপেক্ষায় থাকেন চট্টগ্রামবাসী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দোকানিরা নানা ধরনের মালামাল নিয়ে আসেন এ মেলায়।
মাটির তৈরি তৈজসপত্র, খেলনা, ফুলদানি, পুতুল, বেত-কাঠ ও বাঁশের তৈরি আসবাব, হাতপাখা, মাছ ধরার পলো, বেতের তৈরি ডালা, কুলো, ফলদ ও বনজ গাছের চারা, ফুল গাছের চারা, মুড়ি মুড়কি, পাটি, মাদুর, চুড়ি, প্রসাধনী সামগ্রী, দা-বটি, ছুরিসহ প্রায় সব পণ্যই পাওয়া যায় এ মেলায়। মেলা ঘিরে নিয়ে শিশুদেরও আনন্দের কমতি থাকে না।
চট্টগ্রাম নগরের পাশাপাশি বিভিন্ন উপজেলা, পার্বত্য জেলা ও কক্সাবাজর থেকে লোকজন এ মেলায় আসেন। তারা এ মেলা থেকে সংগ্রহ করেন পুরো বছরের গৃহস্থালি সামগ্রী ও ঘর সাজানোর জিনিস।
প্রতিবছর নগরীর কোতোয়ালী থানা মোড় থেকে জেল রোড, লালদিঘী হয়ে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল ও সিনেমাপ্যালেস মোড় পর্যন্ত লালদিঘী মাঠের আশেপাশের প্রায় দেড় বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বসে মেলা।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীদের দাবি, শীতের শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে মেলা শুরু হয় তার শেষ হয় এ আব্দুল জব্বারের বলী খেলার মেলা দিয়ে। এ মেলার পর তারা আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন অন্য মেলার জন্য।
আগের বছরগুলোতে পুলিশের পক্ষ থেকে এ সড়কে তিন দিনের জন্য যানবাহন চলাচল সীমিত রাখার নির্দেশনাও আসত। তবে এ বছর তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। পুলিশ বলছে রাস্তা ‘দখল করে’ মেলার দোকান বসানো যাবে না।
মেলার শুরুর দিন বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর সিনেমা প্যালেস সংলগ্ন কে সি দে সড়কে ফুটপাতের একপাশে অল্প কিছু মাটির বাসনপত্র নিয়ে বসেছেন মো. ফখরুদ্দীন নামে এক ব্যবসায়ী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মেলা উপলক্ষে প্রতিবছরের মত এবারও শুরুর কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রামে এসেছেন। প্রতিবার মেলা শুরুর আগে থেকে অল্প অল্প বিক্রি করতেন। তবে এবার গাড়ি থেকে মালও নামাতে দেয়নি পুলিশ।
ফখরুদ্দীনের দাবি, চারটি কভার্ড ভ্যানে মাটির তৈরি জিনিসপত্র নিয়ে তারা ১২ জন এসেছেন ১৫ এপ্রিল রাতে। গাড়ি থেকে মাল নামাতে না দেওয়ায় দুই কভার্ড ভ্যান মাল ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন বুধবার রাতে।
“এসব মালামাল নিয়ে আসা, ১২ জনের থাকা খাওয়া সব মিলিয়ে খরচ হয়ে গেছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। গতকাল (বুধবার) সন্ধ্যায় কিছু মালামাল গাড়ি থেকে নামিয়ে সাজানোর পরপরই পুলিশ বাধা দিয়েছে।
“আর দুই দিন মেলা আছে সেজন্য কিছু মালামাল খুললেও বাকিগুলো খোলা হয়নি। যদি এভাবে বাধা দেওয়া হয়, পুরোটাই লোকসান হবে আমাদের।”
ফখরুদ্দীনের মত একই অবস্থা ঢাকার চাঁনখারপুল ও কেরানীগঞ্জ থেকে মাটির বাসনপত্র নিয়ে মেলায় আসা শফিকুল ইসলাম ও মো. শাকিলের।
শফিকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ মেলায় আসার জন্য আমরা আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। ২৫/২০ বছর ধরে আমরা মেলায় আসছি। এবারও মেলার কথা শুনে ছয় কভার্ড ভ্যান মাল নিয়ে আসছি। কিন্তু কোন ভাবেই গাড়ি থেকে মালামাল নামাতে দেওয়া হয়নি। যার কারণে গাড়িগুলো টাকা দিয়ে পার্কিংয়ে রেখেছি।”
তার অভিযোগ, বুধবার রাত ২টার দিকে তারা চৌকি পেতে পসরা সাজানোর পর পুলিশ তাদের বাধা দিয়েছে। চৌকি নিয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে তিনি দুই গাড়ি মাল ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন।
শাকিলের দাবি, করোনার কারণে যে দুই বছর মেলা হয়নি সে বছরগুলো ছাড়া প্রায় ২০ বছর ধরে চট্টগ্রামে আসেন তিনি। এ মেলায় বিক্রি ভালো হয় বলে তারা অপেক্ষায় থাকেন। কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়ে আসেন। কিন্তু এবার মেলায় এসে তাদের ‘পথে বসার’ অবস্থা।
তিনি বলেন, “বসতে না দিলে, আগে যদি বলে দেওয়া হত তাহলে আমরা আসতাম না। এসে আমাদের লাভের পরিবর্তে লোকসান গুনতে হচ্ছে। বুধবার রাত ১টার দিকে পুলিশ দুইটি টেবিল নিয়ে গেছে।”
আক্ষেপের সুরে শাকিল বলেন, “চট্টগ্রাম আসতে যে টাকা খরচ হয়েছে, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সে টাকাও তুলতে পারব না। এভাবে হলেতো সামনে আমরা আর আসব না। এ মেলাও ঐতিহ্য হারাবে।”
লালদিঘী মাঠের সামনে গিয়ে দেখা যায় সড়ক বিভাজকের উপর গোল করে দাঁড়িয়ে বসে গল্প করছেন কয়েকজন। কেউ কেউ ঘুমিয়ে সময় পার করছেন।
তাদের একজন মো. রাসেল মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকার লালবাগ থেকে আমরা বেশ কয়েকজন এসেছি। কসমেটিকস, ছোটদের খেলনা এসব নিয়ে। প্রতিবছর এ স্থানে আমরা পসরা সাজিয়ে বসি। চার দিন ধরে বসে থাকলেও পুলিশ কার্টন খুলতে দিচ্ছে না।
“এ মেলা ঐতিহ্যবাহী, আমাদের সারা বছরের রোজগারের অন্যতম একটা স্থান এ মেলা। ঋণ নিয়ে মালামাল সংগ্রহ করে এখানে আসি। মেলা থেকে ফিরে সে টাকা পরিশোধ করি। কিন্তু এবারতো আমরা এখানে এসে বিপদে পড়ে গেছি।”
রাসেলের দাবি, যে টাকা নিয়ে মেলায় এসেছেন তার সব শেষ হয়ে গেছে। এখন তাদের হাতে খাবারের টাকাও নেই।
রাসেলের মত একই অবস্থা সালমা বেগম ও সুরমা নামে দুই কাঁচের চুড়ি বিক্রেতা নারীরও।
ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামের মেলায় আসা পঞ্চাশোর্ধ সালমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কম করে হলেও ৪০ বছর ধরে মেলায় আসছি। কিন্তু এ ধরনের অবস্থায় কখনও পড়িনি। এ মেলায় ভালো বেচাবিক্রি হয়। এবারতো চুড়ির বাক্সও খুলতে পারিনি।”
এসময় সালমা নিজের ভ্যানেটি ব্যাগ খুলে দেখিয়ে বলেন, “দেখেন ২০ টাকার একটা নোট আছে। না খেয়ে আছি। এখানে আসলাম এখন কিভাবে যাব, তাও বুঝতে পারছি না।”
মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর থেকে আসা সুরমা বলেন, “এ মেলায় আমরা যারা আসি সবাই পরিচিত। অনেক দিন প্রস্তুতি নিয়ে সবাই একসাথে মেলায় আসি। কিন্তু এবার এসে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার অবস্থা। টাকা যা ছিল সব শেষ, কাল রাত থেকে না খেয়ে আছি।”
এ মেলায় চট্টগ্রামবাসীর সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে ফুলের ঝাড়ু, বাঁশ-বেতের গৃহস্থালীসহ নানা সরঞ্জামের দিকে। নগরীর পাশাপাশি বিভিন্ন উপজেলার মানুষ বলী খেলার মেলায় আসেন বেতের তৈরি কুলা, চালুনি, মাছ ধরার চাঁইসহ নানা ধরনের পণ্য কিনতে।
কোভিড মহামারীর সময় ২০২০ ও ২০২১ সালে মেলা হয়নি।
লালদিঘী সোনালী ব্যাংকের বিপরীতে বাঁশের তৈরি কুলা, চালুনি. মাছ ধরার পলো বা চাঁইসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে বসেছেন আবুল বাশার নামে এক ব্যক্তি।
নরসিংদীর রায়পুর থেকে আসা বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ১৪/১৫ বছর ধরে মেলায় আসছি। তিন/চার মাস আগে থেকে দাদন নিয়ে কারিগরদের টাকা দিয়ে রাখি মালামাল তৈরির জন্য। প্রতিবছর মেলা থেকে বাড়ি গিয়ে এ টাকা পরিশোধ করি।
“এবার দুই ট্রাক মাল নিয়ে আসছি গত মঙ্গলবার এসেছি। কিন্তু খুলতে দেয়নি পুলিশ। গতরাতে (বুধবার রাত) মালামাল খুলে বসার পর পুলিশ এসে নিয়ে গেছে, অনুরোধ করে ফেরত নিয়েছিলাম। মনে করেছি সকালে বসতে দেবে, কিন্তু ভোরে এসেও গাড়িতে মালামাল তুলে ফেলে পুলিশ। বসব না বলে অনুরোধ করে সেই মালামাল ছাড়িয়ে নিয়েছি। যার কারণে এক ট্রাক মাল সকালে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি।”
লালদিঘী মসজিদ গেইটের পাশে বসে থাকতে দেখা যায় কয়েকজনকে। তারা বলেন, মেলায় আচার ভালো বিক্রি হয়। কিন্তু পুলিশ তাদের দোকান সাজিয়ে বসতে দিচ্ছে না।
কুমিল্লার চান্দিনা থেকে আসা সিয়াম নামের এক যুবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল রাতে এসেছি। এসে দেখি মালামালও নামাতে দিচ্ছে না পুলিশ। বাধ্য হয়ে এখন বসে আছি।
তার একটু দূরে বসে থাকতে দেখা যায় আব্দুল হাকিম নামে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে। সিলেট থেকে এসেছেন জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে বিক্রি ভালো হয় শুনে চার দিন আগে আসছি। কিন্তু এখানে এসে দেখি মালের বাক্সও খুলতে দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশে মালগুলো রেখে দিয়েছি।
“৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আচার তৈরির মসলাপাতি কিনেছি, নিজের ঘরে এবং বাইরে তৈরি করিয়েছি। আবার গাড়ি ভাড়া দিয়েছি ১২ হাজার টাকা।”
১১৫ বছর আগে চট্টগ্রাম শহরের বদর পাতির ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এ অঞ্চলের যুবকদের শারীরিকভাবে প্রস্তুত করতে ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আয়োজন করেন কুস্তির, যা বলী খেলা নামে পরিচিত।
যা বলছে আয়োজক কমিটি ও পুলিশ
মেলা কমিটির সদস্য সচিব ও আব্দুল জব্বারের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও মালামাল নিয়ে এখানে বিক্রেতারা আসেন। এবার আসলেও তাদের বসতে দেওয়া হচ্ছে না বলে শুনছি।
“প্রতিবারের মত এবারও আমরা লিখিতভাবে বলী খেলা ও মেলার জন্য পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে তিন দিনের অনুমতি পেয়েছি। পুলিশের সাথে মিটিংও করেছি, কিন্তু এবছর পুলিশের পক্ষ থেকে ‘মৌখিকভাবে’ বলা হয়েছে কোতোয়ালী থেকে আন্দরকিল্লা সড়কে কোনো মেলা বসতে পারবে না। এটি পরিষ্কার রাখতে হবে।”
শওকত আনোয়ার বাদল বলেন, “দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশ এটা বলছে, কিন্তু আমরা তাদের অনুরোধ করেছি অন্তত শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনে যেন মেলা বসতে দেওয়া হয়। বিষয়টি আমরা মেয়র মহোদয়কেও জানিয়েছি।”
এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মেলা করতে নিষেধ করা হয়নি। রাস্তায় যানবাহন ও মানুষ চলাচলে যেন বিঘ্ন না ঘটে সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সড়ক পরিষ্কার রাখতে বলা হয়েছে।
নগরীর যে এলাকায় আব্দুল জব্বারের মেলা হয় এটি নগর পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের অধীনে।
এ জোনের উপ-কমিশনার আলমগীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কমিটি বলী খেলার অনুমতি নিয়েছে। মেলার কোন অনুমতি নাই। তারপরও আমরা বলেছি রাস্তা বন্ধ না করে মেলা করতে পারলে করুক।”
এ মেলা ঐতিহ্যবাহী, তবুও কেন বাধা? জবাবে উপ-কমিশনার আলমগীর বলেন, “ঐতিহ্য কেউ বন্ধ করছে না। খেলা চলবে, মেলা চলবে সব মাঠের ভেতর চলবে। রাস্তা দখল করে বসতে হবে কেন?
“রাস্তাতো মেলার অংশ না। আমরা বলেছি মেলা, খেলা সব চলবে, রাস্তা দখল করে মেলা চলবে না, সাথে রাস্তায় গাড়িও চলবে।”