বাঁশখালী হত্যার ১৭ বছর: বিচারের অপেক্ষা আর কত?

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাড়িতে আগুন দিয়ে একই পরিবারের ১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যার ১৭ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার পাননি তাদের স্বজনরা; উল্টো শোকের পাথর বুকে চেপে মামলার ব্যয়বহন করতে করতে তারা এখন প্রায় নিঃস্ব।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Nov 2020, 04:30 PM
Updated : 17 Nov 2020, 06:22 PM

২০১৯ সালের ২৩ জুন উচ্চ আদালত মামলার বিচার ছয় মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দেওয়ার পর পেরিয়ে গেছে ১৬টি মাস। কিন্তু বিচার শেষ হওয়া তো দূরের কথা অর্ধশতের বেশি সাক্ষীর অর্ধেকের বেশি সাক্ষ্য এখনও নেওয়া হয়নি। এত দিনেও বিচার না পেয়ে নিরাশ পরিবারটির সদস্যরা।

২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় বাইরে থেকে ঘরে তালা লাগিয়ে গান পাউডার ছড়িয়ে আগুনে পুড়িয়ে নারী-শিশুসহ ১১ জনকে হত্যা করা হয়।

নিহতরা হলেন- তেজেন্দ্র লাল শীল (৭০), তার স্ত্রী বকুল শীল (৬০), ছেলে অনিল শীল (৪০), অনিলের স্ত্রী স্মৃতি শীল (৩২), অনিলের তিন সন্তান রুমি শীল (১২), সোনিয়া শীল (৭) ও চার দিন বয়সী কার্তিক শীল, তেজেন্দ্র শীলের ভাইয়ের মেয়ে বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদি শীল (১৭), অ্যানি শীল (৭) এবং কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা আত্মীয় দেবেন্দ্র শীল (৭২)।

সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পাওয়া তেজেন্দ্র শীলের ছেলে বিমল শীল পরে বাদি হয়ে মামলা করেন। এরপর ১৭ বছর মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বিমল।

বিচার পাওয়া নিয়ে হতাশার কথা জানিয়ে বিমল শীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। কোনো সহযোগিতাও পাচ্ছি না। সরকার যদি মামলা পরিচালনার ভার নিত।

“বছর ঘুরলে শুধু পত্র পত্রিকায় লেখালেখি হয়, এটুকুই। কেউ আর খবরও নেয় না। মা-বাবা হারালাম। আর অবশিষ্ট কিছুই নেই।”

শুরু থেকে এই মামলার বিচারের দাবিতে সরব বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০০১-২০০৬ এই সময়ে দেশে যে কয়টি লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে বাঁশখালীর এই হত্যাকাণ্ড একটি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ঘটনার বিচার হয়নি।

“অনতিবিলম্বে বাঁশখালী ১১ হত্যা মামলার বিচার জাতি দেখতে চায়। ইতিমধ্যে ভুক্তভোগীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। তারা জীবদ্দশায় বিচার পাবে না বলে আশঙ্কা করছেন।”

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, সাক্ষী হাজির করতে না পারায় এবং প্রায় আট মাস ধরে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারকের পদ খালি থাকায় বিচার কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি।

মামলাটি চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। এই আদালতের বিচারক মুন্সী আব্দুল মজিদ ফেব্রুয়ারিতে বদলি হওয়ার পর পদটি শূন্য আছে। অন্য একজন বিচারক অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন।

রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পিপি লোকমান হোসেন চৌধুরী জানান, ২৪ ফেব্রুয়ারি এই মামলার সর্বশেষ শুনানির দিন একজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। এরপর ১১ মার্চ ও ৮ এপ্রিল বিচারক না থাকায় শুনানি হয়নি। তারপর মহামারীর লকডাউনের জন্য আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হলে ২৭ অগাস্ট অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সাবিদুর রহমান মামলার ১০ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য সমন জারির আদেশ দেন। কিন্তু সর্বশেষ ৩ নভেম্বরসহ পর পর তিনটি শুনানির নির্ধারিত দিনেও সাক্ষী না আসায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

এই ১০ সাক্ষীর মধ্যে বাঁশখালীর ঘটনাস্থলের স্থানীয় বাসিন্দা, পুলিশ সদস্য ও মামলা সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন।

অতিরিক্ত পিপি লোকমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশ সদস্য ও ম্যাজিস্ট্রেটসহ সরকারি কর্মকর্তারা প্রায় সবাই বদলি হয়ে গেছেন। কয়েকজন সাংবাদিকও গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। নোটিস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা আসছেন না।”

ঘটনা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করা সাংবাদিক সমরেশ বৈদ্যকে সমন জারি করা হলেও তিনি  সাক্ষ্য দিতে হাজির হননি বলে দাবি করেন এপিপি লোকমান।

তবে সমরেশ এতে বিস্ময় প্রকাশ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি যে সাক্ষী সেটাই আমি জানি না। কে আমাকে সাক্ষী করল? সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য কোনো নোটিস কখনো আসেনি।

“এই ঘটনার শুরু থেকে পরের কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে বেশ কিছু সংবাদ করেছি। কিন্তু সাক্ষী করার আগে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল নিয়ম অনুসারে আমাকে জানানো। এতদিনেও কেউ কিছু জানায়নি।”

আরেক সংবাদকর্মী সুমি খান উল্টো অভিযোগ করলেন, ২০১৫ সালে তিনি নোটিস পেয়ে দুইবার সাক্ষ্য দিতে আদালতে গেলেও তার সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এরপর আর কেউ যোগাযোগ করেনি, কোনো নোটিসও পাইনি।”

২০০৩ সালে মামলার পর সাত তদন্ত কর্মকর্তার হাত ঘুরে অষ্টম তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার হ্লা চিং প্রু ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ডাকাতির উদ্দেশ্যে অগ্নিসংযোগ, খুন ও লুটতরাজের অভিযোগে ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আদালত।

কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটিতে সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের নতুন অভিযোগ আনে। ওই বছরের ১৯ এপ্রিল নতুন করে ওই ধারায় ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয়।

আসামিদের মধ্যে দুজন মাত্র কারাগারে আছেন, যাদের একজন গত জুনে আটক হয়েছেন; জামিনে আছেন ১৭ জন। বাকি ১৯ আসামি পলাতক।

২০১২ সালের ১২ মে চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ওই বছরের ২ অক্টোবর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় ২০১৩ সালের নভেম্বর আবার তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটি ফেরত আসে।

আগামী ১৫ ডিসেম্বর আদালতে মামলাটির শুনানির দিন ধার্য আছে। মামলার বিচার শুরুর পর ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।