২০১৯ সালে উচ্চ আদালত এ মামলার বিচার ছয় মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দিলেও পেরিয়ে গেছে ৪১ মাস।
Published : 18 Nov 2022, 11:01 PM
বাবা-মাসহ পরিবারের ১১ সদস্যকে হারিয়ে ১৯ বছর ধরে বিচারের আশায় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত বিমল শীল; তবু হত্যাকাণ্ডের জড়িতদের শাস্তি দেখতে তিনি বারবার ছোটেন আদালতের দুয়ারে।
২০১৯ সালে উচ্চ আদালত এই মামলার বিচার ছয় মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দিলেও ৪১ মাসেও মামলাটি একই অবস্থায় রয়েছে। চার-পাঁচ মাস পরপর তারিখ পড়ে; কিন্তু কোনো সাক্ষী হাজির হয় না। মামলার ৩৮ আসামির মধ্যে কারাগারে আছেন কেবল একজন।
চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারধীন মামলাটির পরবর্তী শুনানি আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি।
বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় তেজেন্দ্র লাল শীলের ঘরের বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে ‘গান পাউডার ছড়িয়ে’ আগুনে পুড়িয়ে নারী-শিশুসহ ১১ জনকে হত্যা করা হয় ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর।
এরপর থানা, আদালত, প্রশাসন, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, উচ্চ আদালত সবখানেই গিয়েছেন বিমল। গেল কয়েক বছর তিনিও কিছুটা হতোদ্যম। তবুও যেকোনো আশার আলো দেখলেই ছুটে যান পরিবারের একমাত্র বেঁচে যাওয়া সদস্য বিমল শীল।
শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলছিলেন, “প্রতি বছরের মত আজও বাড়িতে এসেছি। আজ ১৯টি বছর পেরিয়ে গেল। মামলার কোনো উপায় করতে পারছি না। ছুটতে ছুটতে আমি হতাশ। মা-বাবা হত্যার বিচার পাচ্ছি না।
“তবু কিছুদিন আগে যখন শুনলাম নতুন পিপি এসেছেন। তখন গিয়ে উনার সাথে দেখা করেছি। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, চেষ্টা করবেন।”
মামলার বর্তমান অবস্থা জানিয়ে বিমল বলেন, “৩৮ জন আসামির মধ্যে ১৪-১৫ জন শুরুতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। তারপর একে একে সবাই জামিনে বেরিয়ে গেছে। শুধু একজন জেলে আছে।
“আর বাকি আসামিরা কখনও গ্রেপ্তারই হয়নি। আজ এত বছরেও তাদের আইনের আওতায় আনা গেল না! অনেক কষ্টে ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনকে আমি সাক্ষী দিতে হাজির করেছিলাম। গত কয়েক বছর ধরে আর নতুন কারও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। কয়েকজন সাক্ষী এখন আর সাক্ষ্য দিতে আগ্রহীও না।”
তিনি বলেন, “সব সাক্ষীর সাক্ষ্য তো প্রয়োজন নেই। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের সাক্ষ্য নিতে পারলে মামলাটা পরিণতির দিকে যেত। তারিখ পড়ে ৪-৫ মাস পরপর। এভাবে চললে কীভাবে, কবে সাক্ষ্য শেষ হবে? আর কখন রায় হবে?”
বর্তমানে মামলাটি চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারধীন; শুনানির পরবর্তী দিন আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি বলে জানান বিমল।
১৯ বছর আগের ওই ঘটনায় আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত হন- তেজেন্দ্র লাল শীল (৭০), তার স্ত্রী বকুল শীল (৬০), ছেলে অনিল শীল (৪০), অনিলের স্ত্রী স্মৃতি শীল (৩২), অনিলের তিন সন্তান রুমি শীল (১২), সোনিয়া শীল (৭) ও চার দিন বয়সী কার্তিক শীল, তেজেন্দ্র শীলের ভাইয়ের মেয়ে বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদি শীল (১৭), অ্যানি শীল (৭) এবং কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা আত্মীয় দেবেন্দ্র শীল (৭২)।
তেজেন্দ্র লাল শীলের ছেলে বেঁচে যাওয়া এই বিমল শীলই বাদী হয়ে মামলাটি করেছিলেন।
১৯ বছরেও বিচার না পাওয়ার বিষয়ে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশে সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি সংস্কৃতি যে বিরাজ করছে, তার উৎকৃষ্ট নজির এই মামলা।
“এতদিনেও বিচার না হওয়ায় ভুক্তভোগী পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। আর হতাশা তাদের গ্রাস করেছে। বিপরীতে দুর্বৃত্তরা উৎসাহিত হচ্ছে যে, এরকম ঘটনা ঘটালেও তাদের কিছু হবে না। শুধু এই একটি মামলা নয় এরকম হাজার হাজার মামলা আছে। এই অবস্থা থেকে অবশ্যই রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে হবে।”
২০১৯ সালের ২৩ জুন উচ্চ আদালত এই মামলার বিচার ছয় মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনার পরও এর কার্যক্রম না আগানোর বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা আদালতের পিপি শেখ ইফতেখার সাইমুল বলেন, “দায়িত্ব গ্রহণের পর আমি বাদীর সাথে কথা বলেছি। আগামী ৬ মাসের মধ্যে মামলাটি যবনিকার দিকে নিতে চাই।
“এজন্য সাক্ষী হাজির করতে আইনগত সব পদক্ষেপ আমি নিব। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সাক্ষী হাজির করতে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আগামী ধার্য দিনের পর যাতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শুনানির দিন নির্ধারণ হয় সেটাও নিশ্চিত করব।”
নগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক শেখ ইফতেখার বলেন, “এই মামলাটি শেষ করতে সংশ্লিষ্ট সবারই আন্তরিক হওয়া দরকার। অনেক সময় সাক্ষীরা সাহস ও উৎসাহ পেলে সাক্ষ্য দিতে আসেন। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ যারাই শুরু থেকে সম্পৃক্ত, তারাও উদ্যোগী হতে পারেন সাক্ষীদের উৎসাহী করতে।
“আগামী তারিখ থেকে অবশ্যই প্রতি ধার্য দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ হবে।”
২০০৩ সালে মামলা হওয়ার পর সাত তদন্ত কর্মকর্তার হাত ঘুরে অষ্টম তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার হ্লা চিং প্রু ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ডাকাতির উদ্দেশে অগ্নিসংযোগ, খুন ও লুটতরাজের অভিযোগে ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আদালত।
কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটিতে সম্পত্তি দখলের উদ্দেশে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের নতুন অভিযোগ আনে। ওই বছরের ১৯ এপ্রিল নতুন করে ওই ধারায় ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয়।
আসামিদের মধ্যে একজন মাত্র কারাগারে আছেন। জামিনে আছেন ১৮ জন। বাকি ১৯ আসামি পলাতক।
২০১২ সালের ১২ মে চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ওই বছরের ২ অক্টোবর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হয়। নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় ২০১৩ সালের নভেম্বর আবার তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটি ফেরত আসে।
আরও পড়ুন
বাঁশখালী হত্যার ১৭ বছর: বিচারের অপেক্ষা আর কত?
সেলিম প্রধানের অবৈধ সম্পদের মামলায় আরও ২ জনের সাক্ষ্য
বাঁশখালীর ১১ হত্যা মামলার আসামিকে পুলিশে দিল স্থানীয়রা