বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যাত্রী সেজে বসে থাকে ছিনতাইকারীরা। অন্য কেউ উঠলে গন্তব্যে না গিয়ে অন্য পথে চলে যায় সেটি।
Published : 24 Aug 2023, 11:45 PM
মুন্সীগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামে কাঠ কিনতে আসা ব্যবসায়ী পারভেজ খান এক ভোরে জিইসি মোড়ে ঢাকার বাস থেকে নেমে বন্দরে যেতে ওঠেন একটি লোকাল বাসে।
বাসটি গন্তব্যে না গিয়ে উল্টোপথে উঠে যায় ফ্লাইওভারে। সেখানে তাকে মারধর করে টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয়। পরে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশের সহায়তা চান তিনি।
গত ৯ জুলাইয়ের এ ঘটনায় পুলিশ টানা অভিযান চালিয়ে পুলিশ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে, যারা সবাই বাসের শ্রমিক।
যাত্রীরা বলছেন, গণপরিবহনে স্বাভাবিকভাবে যাত্রী বেশী থাকায় সেটিকে নিরাপদ মনে করেন অনেকেই। কিন্তু কিছু ঘটনার পর দেখা যায় যাত্রীসহ বাস ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
খুলশী থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওয়াসা-লালখান বাজার-জিইসি-ষোলশহর-মুরাদপুর-বহদ্দারহাটসহ বিভিন্ন স্থানের ৭৭টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করে বাসটি শনাক্ত করা হয়েছে।
“বাসটি দিনের বেলায় পোশাক কারখানার শ্রমিক আনা নেওয়া করে। আর রাতে রাস্তায় নামে সাধারণ যাত্রী পরিবহনের নামে ছিনতাইয়ে।”
গত ৫ অগাস্ট রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রামে এসে ষোলশহর ২ নম্বর গেইট থেকে বন্দর মাইলের মাথা যাবার জন্য ১০ নম্বর রুটের একটি বাসে উঠেন আল মামুন নামে এক কিশোর। বাস শ্রমিকরা তাকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে না নামিয়ে নিয়ে যায় আরও কয়েক কিলোমিটার দূরে। তার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ার পর বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়।
শোরগোলের পর বাসে থাকা অন্য কয়েকজন নারী যাত্রীও চিৎকার করলে স্থানীয় জনতা বাসটি আটকে চালকসহ অন্যদের পিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
চট্টগ্রাম বন্দর থানার ওসি সঞ্জয় কুমার সিনহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ছোট গড়নের কিশোরটি বাসে উঠার পর থেকেই তাকে ‘টার্গেট করে’ হেলপার। যার কারণে সে বাস থেকে নামতে চাইলেও তাকে নামতে না দিয়ে ধমক দিয়ে পেছনের সিটে বসিয়ে রাখা হয়।
তিনি জানান, বাসটির মূল চালক ছিলেন মাহমুদুল নামে এক জন। কাঠগড় থেকে ফেরার পথে মাহমুদুল তার বদলি হিসেবে মফিজকে বাসটি চালাতে দেন। পথে মেহেদী নামে অপর এক যুবককে বাসে তুলে নেন। কিছু দূর আসার সময় মাহমুদুল টেলিফোন করার কথা বলে ওই কিশোরের কাছ থেকে মোবাইল সেটিটি নিয়ে মেহেদীকে দিয়ে দেন। পরে সেটি নিয়ে মেহেদী বাস থেকে নেমে চলে যান।
ওসি বলেন, “বাসে থাকা যাত্রীদের চিৎকারে পথচারীরা এগিয়ে এসে বাসটি আটক করতে না পারলে তার পার পেয়ে যেত। আর ভুক্তভোগী যাত্রী যদি মামলা না করতেন তাহলে বিষয়টি আমাদের নজরেও আসত না।”
এ ধরনের অপরাধী শনাক্তে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সাধারণ জনগণকে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন সঞ্জয়।
গত বছরের ১৯ মে নগরীর বাকলিয়া থানার রাহাত্তার পুল এলাকায় সড়ক থেকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এ তরুণীকে উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন হাসপাতালে ভর্তি করান।
যে বিষয়টি নিয়ে ধাঁধায় পড়েছিল পুলিশসহ সবাই্। কেউ বলছিল ওই নারী ইচ্ছা করেই বাস থেকে লাফ দিয়েছিলেন, আবার কেউ বলছিলেন, তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পর ওই তরুণীর জ্ঞান ফেরার পর পুলিশ জানতে পারে ওই তরুণীকে বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয়নি, ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতেই মূলত তিনি লাফ দিয়েছিলেন।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনার পর মেয়েটির মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে বাসটি আটক করে চালক আনোয়ার হোসেন টিপু ও তার সহকারী জনি দাশকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে।”
তিনি জানান, পাহাড়তলী ও বন্দর থানায় এলাকায় বাসে যাত্রী তুলে ছিনতাইয়ের ঘটনায় দুইটি মামলা হয়েছিল। তদন্তে দেখা যায় আটক করা বাসটিতে যাত্রী তুলে ছিনতাই করা হয়।
পাহাড়তলী ও বন্দর থানার মামলায় বাসটি শনাক্ত হওয়ার পর পুলিশ জানিয়েছিল, বাসটি টিপু ও আশরাফুল পলাক্রমে চালাতেন। তাদের সঙ্গে আরও কিছু লোক ছিল, যারা ছিনতাইয়ে জড়িত।
গত ৪ অগাস্ট বিকালে বাস থেকে এক সাংবাদিকের মোবাইল মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।
দৈনিক সমকাল পত্রিকার সাংবাদিক শৈবাল আচার্য্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ৪ নম্বর রুটের একটি বাসে করে তিনি মুরাদপুর থেকে আগ্রাবাদে তার অফিসে যাচ্ছিলেন। আগ্রাবাদ চৌমুহুনি মোড়ের আগে বাসে সাত থেকে আট জন যুবক উঠে তাকে ঘিরে দাঁড়ায়।
বাস ভাড়া দিয়ে হাতে মোবাইল মানিব্যাগ নিয়ে বাদামতলী মোড়ে বাস থেকে নামার আগেই তার হাত থেকে মানিব্যাগ ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তিনি চিৎকার শুরু করে বাস আটকে রাখলে ওই যুবকরা তাকে মারতে উদ্যত হয়।
শৈবালের অভিযোগ, তিনি তার পাশের লোকজনগুলোর পকেট তল্লাশির কথা বলার পর বাস হেলপার তাকে কানে গিয়ে বাসেই মানিব্যাগ আছে এবং তা খুঁজে দেখতে বলেন। এ সময় নিচ থেকে মানিব্যাগ তোলার সময় ওই যুবকগুলো বাস থেকে নেমে যান।
মালিকপক্ষ ও পুলিশের পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার নোবেল চাকমা বলেন, “এ ধরনের ঘটনায় বাস মালিকরা তাদের দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, তারা যাকে বাস ভাড়া দিচ্ছেন, তার তথ্য নিচ্ছেন। কিন্তু ওই চালক যে বদলি চালককে বাসটি চালাতে দেন, সে বিষয়টির খবর তারা রাখেন না।”
বদলি চালকরাই মূলত অঘটন ঘটায় বলে মনে করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “বাস ভাড়া দেওয়ার পর সেটি কোন রুটে কে চালাচ্ছেন, সেটিও মালিকদের খোঁজ রাখা দরকার।”
এই বিষয়টি নিয়ে বাস মালিকদের সংগঠন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলালের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য জানা যায়নি।
চট্টগ্রাম জেলা পরিবহন মালিক গ্রুপের যুগ্ম সম্পাদক রিটন মহাজন বলেন, গণপরিবহনে বিভিন্ন অপরাধ ও দুর্ঘটনার জন্য বদিল চালকরা দায়ী বলে তিনি মনে করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মালিকরা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ এবং যাদের বৈধ লাইসেন্স আছে তাদেরকেই গাড়ি চালাতে দেয়। মালিকরা অন্য পেশায় জড়িত। তাদের নিজেদের কাজ ফেলে রেখে গাড়ির পেছনে ছোটা অসম্ভব।”
লাইসেন্সহীন চালকদের গাড়ি চালানো বন্ধ রাখতে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, “রাস্তায় ট্রাফিক সার্জেন্টরা দায়িত্ব পালন করেন। তারা এসব গাড়ি ধরে জরিমানাও করেন। এ টাকাও পরিশোধ করতে হয় মালিকদের।
“বদলি চালকরা কোনো শ্রমিক সংগঠনের সদস্যও নন, কোনো অঘটন ঘটানোর পর তাদের মালিকরাও খুঁজে পান না। তাদের জন্য মালিকরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
“আমরা মনে করে লাইসেন্সবিহীন চালকদের জরিমানা না করে সরাসরি জেলে পাঠানো হলে বদলি চালক দিয়ে বাস চালানো থেকে বিরত থাকবেন মূল চালকরা।”
নগরীর গণপরিবহনগুলোতে যাত্রীদের মোবাইল, মানিব্যাগ খোয়া যাওয়াও নিত্ত নৈমত্তিক ঘটনা। এর সঙ্গে বাস চালক ও সহকারীর যোগাযোগ আছে বলেও অভিযোগ করেন যাত্রীরা।
আরও পড়ুন:
বাস নিয়ে রাতে ঘুরে ঘুরে ছিনতাই, গ্রেপ্তার ৫