৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩টির সম্মেলনের পর গত ৫ ডিসেম্বর কেন্দ্রের নির্দেশে তৃণমূলের সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছিল।
Published : 20 Mar 2023, 10:47 PM
ওয়ার্ড সম্মেলন ঘিরে আবারও দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের নেতারা।
মাস খানেক আগে চট্টগ্রাম থেকে আলাদাভাবে গিয়ে গণভবনে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন নগর কমিটির দুই পক্ষের নেতারা। ওয়ার্ড পর্যায়ের সম্মেলন ঘিরে ‘নেত্রীর নির্দেশনা অমান্য করা হচ্ছে’ বলে এখন এক পক্ষ অন্যপক্ষকে দোষারোপ করছে।
শনিবার নগরীর বাগমনিরাম ওয়ার্ড এবং সোমবার আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিল হয়েছে। তাতে প্রয়াত নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের বাদ দিয়ে নগরের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীদের নিয়েই নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
মহিউদ্দিন অনুসারীদের অভিযোগ, পছন্দমত লোকদের কাউন্সিলর বানিয়ে ওয়ার্ড সম্মেলন করা হচ্ছে। আর নাছিরের অনুসারীদের দাবি, বেশিরভাগ কাউন্সিলরদের উপস্থিতিতে সম্মেলনগুলো হচ্ছে।
দেড় থেকে দুই দশক আগে হওয়া চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের ৪৪টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডের মধ্যে ৩টি ওয়ার্ডের সম্মেলন হয় গত বছর। তার একপর্যায়ে গত ৫ ডিসেম্বর কেন্দ্রের নির্দেশে তৃণমূলের সম্মেলন স্থগিত করা হয়।
চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগে দীর্ঘ দিন ধরে দুটি ধারা চলছে। এর একটি অংশ নগর কমিটির সভাপতি ও তিনবারের মেয়র প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর ওই ধারাটির নেতাকর্মীরা আছেন তার বড় ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সঙ্গে।
আরেকটি ধারা নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
সাধারণ সম্পাদককে ছাড়াই সম্মেলন
নগরীর ১৫ নম্বর বাগমনিরাম ওয়ার্ডের সম্মেলন হয় শনিবার। এতে ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ আব্দুল আজিমকে সভাপতি ও সাইফুল আলম বাবুকে সাধারণ সম্পাদক করে ওয়ার্ড কমিটি ঘোষণা করা হয়।
সেদিন সম্মেলন চলাকালে ওই এলাকায় মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে সম্মেলনে অংশ নিতে না পারা অংশ।
ওয়ার্ডের সদ্য বিদায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবুল বাশার।
আবুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সম্মেলনে কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। কাউন্সিলর তালিকা করা আমার দায়িত্ব। আমার স্বাক্ষরে তালিকা থেকে সবকিছু হবার কথা।
“আমরা যারা মহিউদ্দিন চৌধুরীর রাজনীতি করি, তাদের সবাইকে বাদ দিয়ে সম্মেলন হয়েছে। আমি পদত্যাগ করিনি বা আমাকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়নি। অথচ আমি থাকতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাউন্সিলর তালিকা করেছে।”
আবুল বাশার বলেন, “ইউনিট পর্যায়ে জামায়াত-বিএনপির লোকজন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ওয়ার্ড কমিটির অনেকে মারা গেছেন। বিষয়গুলো আমি কেন্দ্রকে জানিয়েছিলাম। অথচ তাদের কাউন্সিলর রেখেই সম্মেলন হয়েছে।
“বিগত ২৭ বছর ধরে আমি সাধারণ সম্পাদক এর আগেও দুবার সম্পাদকীয় পদে ছিলাম। ছাত্রলীগ, যুবলীগ করেছি। মামলার আসামি হয়েছি, জেল খেটেছি। এসব ত্যাগের কোনো মূল্যায়ন আছে? আমি সভাপতি প্রার্থী ছিলাম। মাননীয় সভানেত্রী বলেছিলেন, পুরনোদের মূল্যায়ন করতে। অথচ আামাদের ছাড়াই সম্মেলন হলো। আমরা এ বিষয়ে কেন্দ্রকে জানাব। পাল্টা কমিটি করা হবে।”
জানতে চাইলে ওয়ার্ডের বিদায়ী সভাপতি গিয়াস উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাধারণ সম্পাদক সম্মেলন করতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান উনাকে ডেকে বারবার সময় দিয়েছেন। তিনি আসেননি। তাই সাংগঠনিক নিয়মে যুগ্ম সম্পাদক দায়িত্ব পালন করেছেন।”
শনিবারের সম্মেলনে নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির বলেন, “চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রের নির্দেশনা ও পরামর্শ অনুযায়ী সংগঠনের স্তর ও কাঠামোকে বিনির্মাণ করে চলেছে। আমরা সাংগঠনিক সুদৃঢ় ঐক্য ও শৃঙ্খলাকে যথাযথ অনুসরণ করে চলেছি। এ ক্ষেত্রে কখনো ব্যত্যয় ঘটতে দেওয়া হয়নি।”
ক্লাস চলাকালে স্কুলের মাঠে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলন
‘নেতৃত্বে যারা এতদিন, তারা সম্মেলন চাননি’
একদিন পর সোমবার নগরীর আন্দরকিল্লা নজির আহমদ চৌধুরী সড়কের মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি (এমইএস) উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্কুল চলাকালে ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনের প্রধান আলোচক আ জ ম নাছির বলেন, “অনেক দিন ধরে নানাবিধ কারণে ওয়ার্ড, থানা স্তরে সম্মেলনগুলো হতে পারেনি। কারণ যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের কেউ কেউ সম্মেলন হোক এটা চাননি।
“এতে করে তৃণমূলস্তরে যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তার ফলে তৃণমূল স্তরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছিল। এখন আমরা বাস্তবতার আলোকে এই সম্মেলনগুলো করতে চাই। এ ব্যাপারে নেতাকর্মীদের সমর্থনও প্রয়োজন।”
সম্মেলনে আগের কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইকবাল হাসানকে সভাপতি করে এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক আশীষ ভট্টাচার্যকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এই সম্মেলন যখন চলছিল, তখন ‘অবৈধ সম্মেলনের’ প্রতিবাদে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চত্বরে মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে আওয়ামী লীগের একাংশ।
বিক্ষোভ সমাবেশে ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও নগর কমিটির দপ্তর সম্পাদক জহর লাল হাজারী বলেন, “ওয়ার্ড সম্মেলনগুলো করার জন্য নগর কমিটির সিনিয়র নেতাদের দায়িত্ব দিয়ে কমিটি করেছিল নগর আওয়ামী লীগ। আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধভাবে সম্মেলন করছে।
“যারা সংগঠনে ঐক্য চায়, সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চায়, একটি পক্ষ তাদের বাদ দিয়ে সম্মেলন করেছে। এই সম্মেলন কখনো বৈধতা পাবে না। যারা সম্মেলন করেছে, তাদেরই এর দায়িত্ব নিতে হবে। সবাই চায়, মহানগরের সকল নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সম্মেলন।”
আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের সদ্য বিদায়ী কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, “এই ওয়ার্ডের সভাপতি ছিলেন সজীব কুমার পাল। তিন বছর আগে তিনি অসুস্থ হলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয় ইকবাল হাসানকে।
“সজীব কুমার পাল এখন সুস্থ। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মোসলেম উদ্দিন। কিভাবে তাদের এড়িয়ে সম্মেলন হচ্ছে, সেটা সবাই জানে। এই এলাকার সমন্বয়কারী নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জহিরুল আলম দোভাষ। ব্যানারে উনার নাম থাকলেও সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে উনাকে কিছু জানানো হয়নি। তাই উনি আসেননি।”
নির্দেশ অমান্যের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
নগর আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের নেতারা গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গণভবনে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আড়াই ঘণ্টা সভা করেন।
সেদিন নগর আওয়ামী লীগের নেতারা দুই ভাগে গণভবনে যান। পরে তারা দলীয় সভাপতির সঙ্গে একত্রে বৈঠক করেন।
একপক্ষে ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের নেতৃত্বে সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও নির্বাহী কমিটির সদস্যসহ মোট ১২ জন।
আরেক পক্ষে ছিলেন নগর কমিটির সহ সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, খোরশেদ আলম সুজন, জহিরুল আলম দোভাষ ও আলতাফ হোসেন বাচ্চু, মেয়র ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম রেজাউল করিম চৌধুরী, বদিউল আলম এবং কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম।
সেদিন বৈঠক শেষে নগরের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছিলেন, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নেতাদের ‘একযোগে কাজের নির্দেশ’ দেন। পাশাপাশি তৃণমূলের ওয়ার্ড ও থানা কমিটির সম্মেলন শেষ করে নগর আওয়ামী লীগকে সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে বলেন দলীয় সভানেত্রী।
সোমবার নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নেত্রীর সাথে আমরা দেখা করি ১৯ ফেব্রুয়ারি। তার পরপরই সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করা উচিত ছিল। তা হয়নি। এখন যেভাবে ওয়ার্ডের সম্মেলন হচ্ছে তা নেত্রীর সিদ্ধান্তের বিপরীত।
“নেত্রী বৈঠকে বলেছিলেন, পুরনোরা সুস্থ থাকলে তাদের মূল্যায়ন করতে। বাগমনিরাম ওয়ার্ডের সেক্রেটারি সম্মেলনে সভাপতি প্রার্থী ছিলেন। এ কারণে তাকে সম্মেলনে আসতেই দেওয়া হয়নি।”
সুজন বলেন, “আজ আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের সম্মেলন হলো স্কুল চলাকালে। অথচ সামনে এসএসসি পরীক্ষা। দাওয়াতপত্রে যাদের নাম আছে, সেই অতিথিদের দাওয়াত দেয়া হয়নি। এভাবে সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়েই সম্মেলনগুলো হচ্ছে।
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সম্মেলন স্থগিত, নগর সম্মেলন অনিশ্চয়তায়
“সম্মেলনের নামে অরাজকতার মাধ্যমে বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। তারা উস্কানিমূলক এসব কাজ করলেও আমরা সংঘাতের ফাঁদে পা দিতে চাই না। কেন্দ্রকে সাংগঠনিকভাবে সব বিষয় জানাব।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর কমিটির আরেক সহ-সভাপতি বলেন, “অগঠনতান্ত্রিক কাজ হচ্ছে। যারা সংক্ষুব্ধ তারাও কেন্দ্রের কাছে জানাবেন, আমরাও জানাব। দায়িত্বশীল জ্যেষ্ঠ নেতাদের অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। তাদের কোণঠাসা করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। নেত্রী নিজে বলেছেন, যাতে বিএনপি-জামাতের কেউ সংগঠনে অনুপ্রবেশ না করে। অথচ এভাবে কমিটি করতে গিয়ে তৃণমূলে সেটাই হয়ে যাচ্ছে।”
এসব বিষয়ে জানতে সোমবার একাধিকবার আ জ ম নাছিরকে ফোন ও এসএমএস করে সাড়া পাওয়া যায়নি।
দুপুরে আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের সম্মেলনে আ জ ম নাছির বলেন, “আমাদের মধ্যে কেউ কেউ দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ও পরামর্শ মানেন না। এমনকি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোরও বিরোধিতা করেন।
“তারা দলকে যদি ভালবাসেন, নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল থাকেন, তাহলে নেত্রীর ও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।”
নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সাংগঠনিক সম্পাদক হাছান মাহমুদ হাসনী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাগমনিরাম ওয়ার্ডের সেক্রেটারি না আসলে কে কী করবে? আপনারা খবর নেন, দুই ওয়ার্ডেই ৯০ শতাংশ কাউন্সিলর এসেছেন।
“আজ জহর লাল হাজারী মিছিল করেছে। তার সাথে যারা ছিল, তার বেশিরভাগ সদস্যও না। তাদের পক্ষে কয়জন কাউন্সিলর আছে? সম্মেলন হবে। গণতান্ত্রিক সংগঠন। একজনও বলতে পারে যে, মানি না।”
হাসান মাহমুদ হাসনী বলেন, “আপনারা খবর নেন, কাউন্সিলরদের ইনফ্লুয়েন্স করা হয়েছে কি না? কাউন্সিলররাই সব ঠিক করেছেন। তারাই নেতৃত্ব নির্বাচন করছেন।
“আর সিনিয়র নেতাদের দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে। তারা না আসলে তো কিছু করার নেই।”
কাউন্সিল করতে গিয়ে বিভক্ত চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ