“প্রায় সব মণ্ডপেই বাঁশ-বেত-পাটির মত দেশি উপকরণ আর দেশীয় ভাবনায় মণ্ডপ সাজানো হয়েছে এবার। শৈশবের পূজোর আমেজ পাওয়া যাচ্ছে যেন,” বলেন এক দর্শনার্থী।
Published : 20 Oct 2023, 09:46 PM
মা চলেছেন ভিটেমাটি আর জন্মভূমি ছেড়ে। সঙ্গে ছেলেমেয়েরা। বড় বোনের কোলে ছোট ভাই। কাঁধে কাপড় চোপড়। আর মায়ের কোলে প্রতিমা। অনিশ্চিত যাত্রার দিনেও ভরসা যে, সেই তো মা- দেবী দুর্গা।
ব্রিটিশদের শাসন-শোষণ, মুক্তিকামী তারুণ্যের আত্মদান, যন্ত্রণার দেশভাগ, ভিটেমাটি ছাড়া উদ্বাস্তু জীবন- এমন আবহে সেজেছে চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গি বাজার শিববাড়ী (শ্মশানেশ্বর শিব বিগ্রহ) মন্দিরের এবারের দুর্গা পূজার মণ্ডপ।
তাদের এবারের ভাবনা ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে দুই বাংলার বিভক্তির গল্প নিয়ে ‘কাঁটাতার’।
চট্টগ্রামের এবারের মণ্ডপগুলো সেজেছে ইতিহাস, শাশ্বত বাংলার প্রাণ প্রকৃতি, দেবীর আগমনী-বিজয়াসহ আনুষাঙ্গিক নানা ভাবনায়। মণ্ডপ সজ্জায় দেশীয় উপকরণের আধিক্য নজর কেড়েছে।
আর প্রতিমা ফিরেছে সাবেকিয়ানায়। প্রকৃতিতে শরতের ছোঁয়ার সঙ্গে ঢাক-ঢোলের বাদ্যে পূজা যেন ফিরেছে পুরনো রূপে।
নগরীর মণ্ডপগুলোতে এবার দর্শনার্থীদের আনাগোনা বৃহস্পতিবার পঞ্চমীর বিকাল থেকেই। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় শুক্রবারে ষষ্ঠীতেই মণ্ডপে মণ্ডপে মানুষের ঢল নামে।
শ্মশানেশ্বর শিব বিগ্রহ মন্দির পুজা উদযাপন পরিষদ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শোভন বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর বলেন, “ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ক্ষুদিরাম বসুসহ শত সহস্র বিপ্লবী আত্মদান করেছিলেন। কিন্তু আজও বাংলাদেশে তাদের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।
“৪৭ এর দেশভাগে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছিল লাখ লাখ মানুষ। কাঁটাতারের এপারে-ওপারে যন্ত্রণা দগ্ধ মানুষের কষ্টের জীবনযাপন করেছেন। এবার আমাদের মূল ভাবনায় সেই বেদনাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।”
শোভন বিশ্বাস বলেন, “এরপর ১৯৭১ সালের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। অথচ এখনও বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পরিচিত হয় সংখ্যালঘু নামে। এইসব কষ্টের কথা বলা হয়েছে মণ্ডপ সজ্জার নানা দেয়াল চিত্রে।”
দেওয়ানজী পুকুর পাড়ে ‘চট্টল মহাশক্তি সম্মিলনী’র এবার দুর্গা পূজার ৯০ তম আয়োজনের মূল ভাবনা ‘আগমনী সুরে আনন্দ আসুক ফিরে’।
শিল্পী বিশ্বজিৎ আইচ মণ্ডপের পুরোটাই সাজিয়েছেন বাংলার বাঁশ, বেত, ডালা, কুলা, মাটির বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে। আর শিল্পী রতন পালের প্রতিমাও সাবেকী ধাঁচের।
মণ্ডপ সজ্জায় দেখা মেলে বাংলার টেপা পুতুলের আদলে তৈরি কিছু প্রতিমা। বাঁশের তৈরি ঘোড়া। মণ্ডপের দেয়ালে শরতের আগমনী বার্তার পরিচায়ক কাশফুল। আর মহিষাসুরমর্দিনীর অমর শিল্পী বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের প্রতিকৃতি।
‘চট্টল মহাশক্তি সম্মিলনী’ পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শিমুল সেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মা দুর্গার আগমনী ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতেই এবারের আয়োজন। মণ্ডপের একপাশে ছোট একটি মাতৃ প্রতিমা আছে। সেই মঞ্চ থেকে মাকে বরণ করে নিয়ে মূল বেদীতে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঘরের মা-বোনেরা- এভাবেই আগমনী ভাবনাটি চিত্রিত করা হয়েছে।”
বন্দর নগরীতে প্রতিবছর হাজারী লেনের পূজা দেখতে দলে দলে মানুষ ভিড় করেন। এবার এখানকার মূল ভাবনা ‘প্রাণ প্রকৃতির টানে’।
মণ্ডপের পুরো অন্দর সজ্জা মাটির রঙে। গ্রামীণ আদলে গড়া মন্ডপ তৈরি করা হয়েছে ‘শতভাগ প্রাকৃতিক উপকরণ’ ব্যবহার করে।
আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিরর জহর লাল হাজারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রামের আবহে এবারের মণ্ডপ সজ্জা করা হয়েছে। আছে মাটির ঘর, ধানের গোলা, বাবুই পাখির বাসা, কাশফুল আর শরতের বাতাসে দুলে ওঠা বাংলার প্রকৃতি।
“আর এসব তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে পাটি, বাঁশ, আম গাছের ডাল, কাপড়, সুতা, কাঠের গুড়া ও তালপাতা। পুরো প্লাস্টিক বিবর্জিত এবারের সাজসজ্জা। প্রায় তিন মাস সময় লেগেছে পুরো মণ্ডপ সজ্জায়।”
এখানকার প্রতিমা মণ্ডপের আনুষাঙ্গিক সাজের সাথে মিল কাঁচা হলুদ রঙের। আর প্রতিমার আদল পুরনো গ্রামীণ মন্দিরের দেবী প্রতিমার মত।
হাজারী লেনে পূজা উপলক্ষে তিনদিনের সাংস্কৃতিক আয়োজন থাকছে শনি থেকে সোমবার। এতে অংশ নেবেন বাউল শিল্পী পাগলা বাবলু, ফকির শাহাবুদ্দিন ও ইলমা বিনতে বখতিয়ার।
ওই লেনে কথা হয় পূজা দেখতে আসা তাপস দাশের সাথে। তিনি বলেন, “শহরের কয়েকটা পূজার প্রতি মানুষের বেশি আগ্রহ থাকে। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়াতে আজেই লোকজন পূজা দেখতে বেরিয়ে পড়েছে। তাই ষষ্ঠীতে যেন অষ্টমীর ভিড় হয়েছে।”
বন্দর নগরীর আরেক পুরনো পূজা দক্ষিণ নালাপাড়া দুর্গোৎসব পরিষদের এবার ৭৬তম আয়োজন করেছে।
এখানেও দেশীয় উপকরণে করা হয়েছ মণ্ডপের অন্দরসজ্জা। পূজোয় ধুনুচি নাচ, গনেশ কোলে ঘরের মেয়ে মা দুর্গার পৃথিবীতে আগমন আর তেল-সিঁদুরে বিদায়ের ক্ষণ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোট ছোট আরও বেশ কয়েকটি প্রতিমায়।
দক্ষিণ নালাপাড়া পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সুলাল চৌধুরী বলেন, “এবারের আমাদের থিম ‘বিজয়া’। মহিষাসুর বধের পর বিজয়া দশমীর দিনে মায়ের বিদায়ের ক্ষণ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।”
উত্তর কাট্টলী বড় কালী বাড়ির পূজার থিম এবার ‘যাদুরকাঠি’।
‘পিঠে আমার মস্ত ঢাক, হাতে ঢাকের কাঠি’ ও ‘শারদ প্রাতে গা ছেড়ে শহর পথে হাঁটি’ এমন সব স্লোগানের সঙ্গে চিরচেনা ঢাকির দেয়ালচিত্র আর স্থানীয় কিছু ঢাকির নামে নামফলক- এসবে সেজেছে মণ্ডপটি।
একটি দেয়ালচিত্রে দেখা যায়, পূজা শেষে মা দুর্গা ফিরছেন কাশবনের পথ বেয়ে ঢাকির হাত ধরে।
সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পূজা দেখতে বের হওয়া বেসরকারি চাকরিজীবী রাজীব চৌধুরী বলেন, “কয়েকটা মণ্ডপ ঘুরে দেখলাম। প্রায় সব মণ্ডপেই বাঁশ-বেত-পাটির মত দেশি উপকরণ আর দেশীয় ভাবনায় মণ্ডপ সাজানো হয়েছে এবার। এটা ভালো। শৈশবের পূজোর আমেজ পাওয়া যাচ্ছে যেন।”