সীতাকুণ্ডে কত কারখানা? সংখ্যাই জানা নেই, তদারকি তো দূর

উপজেলা প্রশাসন বলছে, এত কারখানা তদারকের সামর্থ্য তাদের নেই।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 March 2023, 07:08 PM
Updated : 6 March 2023, 07:08 PM

আট মাসের মধ্যে দুটি ভয়াবহ দুই বিস্ফোরণে অর্ধ শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর সীতাকুণ্ডে কারখানাগুলোতে তদারিকের হাল নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন দেখা গেল সেখানে কতটি কল-কারখানা রয়েছে, সেই তথ্যই নেই সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী উপজেলা সীতাকুণ্ডে অনেকগুলো কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে জাহাজ ভাঙার কারখানাগুলো, যেখানে অনিরাপদ পরিবেশে কাজ চলার অভিযোগ বহু পুরনো।

গত বছরের জুন মাসে সেখানে বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে অর্ধশত জন নিহত হন। গত ৪ মার্চ সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে ঘটে বিস্ফোরণ, তাতে নিহত হন সাতজন।

সীমা অক্সিজেনে বিস্ফোরণের পর ভারী ও মাঝারি শিল্পে শ্রমিক নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশের আলোচনা আবার সামনে এসেছে।

তবে সংস্থাগুলোর কাছে যখন শিল্প-কারখানার সঠিক সংখ্যাই নেই, তাহলে তদারকি আর কী হবে, তা নিয়ে সন্দিহান শ্রমিক নেতারা।

দেখা যায়, সরকারি একাধিক সংস্থা এসব কারখানা তদারকির দায়িত্ব থাকলেও তারা পরিদর্শন ও চিঠি দিয়েই দায় সেরেছে। নির্দেশ অনুযায়ী কাজ হয়েছে কি না, তা আর খতিয়ে দেখেননি। আর এত কারখানা তদারকিতে অসমর্থ্য বলে জানাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন।

সোমবার ‘চট্টগ্রাম জেলার ভারী ও মাঝারি শিল্প প্রবণ এলাকার দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে’র জন্য আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এই চিত্র উঠে আসে।

সংখ্যা কত?

সীতাকুণ্ড এলাকার ভারী ও মাঝারি শিল্প-কারখানার সংখ্যা কত তা সভায় জানতে চান জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।

কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের উপ-মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত তখন জানান, সীতাকুণ্ডে ৫৭৫টি কারখানার নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান চালু করেনি। নিবন্ধনের বাইরে কতগুলো আছে, তা তার জানা নেই।

তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পুরো চট্টগ্রাম জেলায় নিবন্ধন নিয়েছে ৪৯৪৮টি কল-কারখানা। চালু আছে ২০৩২টি।

যে কোনো কারখানা স্থাপনে অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর ছাড়পত্র নিতে হয়।

সীতাকুণ্ডে কারখানার সংখ্যা নিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক সভায় বলেন, “আমাদের মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনের তথ্য আছে। সেটা কত এখনই বলতে পারছি না। তথ্য নিয়ে পরে জানাতে পারব।”

একই বিষয়ে সীতাকুণ্ডের ইউএনও শাহাদাত হোসেন বলেন, “তহশিলদারদের মাধ্যমে আমরা একটা জরিপ করেছিলাম। সীতাকুণ্ডে ১৭৯টি শিপ ইয়ার্ডসহ ৪৮০টি ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। এরমধ্যে ৫৪টিতে গত বছর আমরা পরিদর্শন করেছি। কিছু নির্দেশনা দিয়ে আসি।”

উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে এতগুলো প্রতিষ্ঠান তদারকি সম্ভবপর নয় বলে জানান তিনি।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে জেলা প্রশাসক ফখরুজ্জামান বলেন, “আমরা শুনেছি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। ভারী ও মাঝারি শিল্প কত আছে? রিস্ক ফ্যাক্টর কী। সেগুলো সার্ভে করেন।

“শতভাগ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত না করে যেন নতুন কারখানা চালু না হয়। আর চালু কারখানাগুলোকে কীভাবে কমপ্লায়েন্সে আনা যায়, সেটার ক্রাশ প্রোগ্রাম করব।”

Also Read: বিএম ডিপোর আগুন রাসায়নিক থেকেই, দায় ছিল সবারই: তদন্ত কমিটি

Also Read: ‘ত্রুটির জন্য’ একবার নোটিস পেয়েছিল সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট

Also Read: সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট চালাতেন দু’জন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার

সাগর ও পাহাড়বেষ্টিত সীতাকুণ্ড উপজেলায় শিপ ইয়ার্ড, কন্টেইনার ডিপো, অক্সিজেন প্ল্যান্ট, স্টিল রি রোলিং মিল, তেল ডিপো, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, পুরনো জাহাজের তেল-টায়ার-বিভিন্ন যন্ত্রাংশ মজুদ ও কাটার প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প আছে।

সভায় তিন ক্যাটাগরিতে অতি ঝুঁকিপূর্ণ (লাল), মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ (হলুদ) ও কম ঝুঁকির (সবুজ) শিল্প-কারখানার তালিকা করতে ফায়ার সার্ভিস, কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেন জেলা প্রশাসক।

সীমা অ্ক্সিজেনে কারখানাটিতে শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন তৈরি করা হলেও সেখানে নাইট্রোজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের সিলিন্ডার মিলেছে। এর পরিবেশ ছাড়পত্র ছিল না। ফায়ার সেফটি এবং বয়লার সনদও ছিল না। তিন মাস আগে ‘অনেক সমস্যা’ পেলেও চিঠি দিয়ে দায় সেরেছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সীতাকুণ্ড-মিরসরাইয়ে কত অক্সিজেন প্ল্যান্ট আছে, তার তালিকা করতে ৫ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। আশা করি, এক সপ্তাহের মধ্যে তালিকা করতে পারব। ঝুঁকিপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানের তালিকা চলতি মাসের মধ্যে করতে পারব। কাল থেকে কাজ শুরু হবে।”

যেভাবে চলছে

সীমা অক্সিকো অক্সিজেন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মামুন উদ্দিন সভায় বলেন, সরকারি সব কমপ্লায়েন্স মেনেই তারা কারখানাটি চালাচ্ছিলেন।

কিন্তু কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং বিস্ফোরক অধিদপ্তর জানায়, সেখানে অনেক ঘাটতি ছিল।

তাহলে কীভাবে কারখানাটি চলছিল তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আল মামুনের কথায়।

তিনি বলেন, “কারখানা করতে ১৮টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সনদ লাগে। শুধু ফি দিলাম আর আন্ডার টেবিল টাকা দিলাম। সনদ হয়ে গেল।

“সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ঠিকমতো নজরদারি করত, তাহলে এ ঘটনা ঘটত না। আমাদের বাড়বকুণ্ডে সাগরপাড়ে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে অনেক এলপিজি প্ল্যান্ট, কিন্তু সেখানে কোনো ফায়ার স্টেশন নেই। মহাসড়কের উভয় পাশে রাতের আঁধারে জমি ভরাট হয়। পরে সেখানে কারখানা হয়।”

সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপো ও সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে দুর্ঘটনার বিষয়ে শ্রমিক সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের চট্টগ্রামের সভাপতি তপন দত্ত বলেন, “সরকারি তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব কী ছিল? চিঠি দেওয়া? আইনে আছে মামলা করার কথা। মামলা হলেও তাদের জরিমানা হয় খুব কম। মালিকরা সেসব তোয়াক্কা করে না।”

বিজিএমইএ’র পরিচালক এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সভায় বলেন, “আইন অনেক আছে, বাস্তবায়ন নেই। যন্ত্রপাতি সচল কি না, সেটার ফলোআপ খুব জরুরী। কারখানা মালিক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান উভয়ের নজরদারি প্রয়োজন।”

উপজেলা চেয়ারম্যান আল মামুন বলেন, “এখানে অনেক বড় শিল্প আছে। তারা বিভিন্ন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এনে এইচআর বিভাগে বসায়। শ্রমিকদের ন্যায্যা পাওনা দেয় না। আমরা গেলে কারখানায় ঢুকতেও দেয় না।”

শিল্প পুলিশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের এসপি মো. সোলায়মান বলেন, “সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন শেষে ৩ মাস সময় দিলে এরমধ্যেও তো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অধিকাংশ ফ্যাক্টরিতে পানি সরবরাহ নেই। তাহলে আগুন লাগলে কীভাবে নেভাবে? আমাদের প্রতিনিধি গেলে প্রবেশ করতে দেয় না। কেন?”

বিস্ফোরক অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অক্সিজেন প্ল্যান্ট এবং শিপ ইয়ার্ডে যদি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ করে তাহলে আমাদের লাইসেন্স নিতে হয়।

“কেউ খোলা তেল মজুদ করলে সেটার অনুমতি জেলা প্রশাসন থেকে নিতে হয়। যেসকল কারখানার লাইসেন্স আছে, সেখানে আমরা নিয়মিত পরিদর্শন ও ভ্রাম্যমান আদালত করি। অনুমোদনহীন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলে সেটা স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলি।”

শ্রমিক ও স্থানীয়দের নিরাপত্তা দেখার কেউ নেই

ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতা তপন দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বছরের পর বছর ধরে দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা নিহত-আহত হচ্ছে। অথচ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই।

“গত ৫০ বছরে শিল্প মালিকরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। অথচ তারা শ্রমিকদের শোষণ করছে। বিএম ডিপোর ঘটনার পর একটা প্রতিবাদ মিছিল করতে দেয়নি।”

শ্রম আইন শ্রমিক বান্ধব নয় দাবি করে তপন দত্ত বলেন, “একজন শ্রমিকের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর দেওয়া ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণে কিভাবে তার পরিবার চলবে? তারা ভিক্ষা করতে পথে নামে। ঘটনার পর দুয়েকদিন হইচই। তারপর দেখার কেউ নেই।”

এই ধরনের দুর্ঘটনায় চাকরি জীবনের আয়ের সমান ক্ষতিপূরণের দাবি জানান তিনি।

সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আল মামুন বলেন, “সীতাকুণ্ডে ভারী শিল্পের পাশেই জনবসতি। অনুমতি দেওয়ার আগে এসব দেখা দরকার ছিল। শ্রমিকের নিরাপত্তা অবশ্যই দিতে হবে।”

ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের তপন দত্ত বলেন, “সেখানে শত শত শিল্প কারখানা জনবসতির মধ্যে। সরকার অনুমতি দিল কী করে? শনিবারের ঘটনায় অনেক দূরের বাসিন্দা দুজন মারা গেছেন। আশেপাশের অনেক ঘরের ক্ষতি হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও হবে। সরকার ও প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে।”

জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, বিএম ডিপোর ঘটনায় স্থানীয়রা এখনও ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে অভিযোগ আছে। সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ঘটনায় আশেপাশে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী সভায় বলেন, “সীতাকুণ্ড-মিরসরাই শিল্প এলাকায় কোনো হাসপাতাল নেই। শিল্প মালিকদের কোনো অ্যাম্বুলেন্সও নেই। দুর্ঘটনার পর মালিকপক্ষকে পাওয়া যায় না। প্রশাসন ছুটে যায় আহত-নিহতদের সেবায়।

সভায় শেষে জেলা প্রশাসক আহত-নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, শিল্প-কারখানার জন্য বাস্তবায়নযোগ্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, কারখানায় কোন কাজে কোন যোগ্যতার শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ হবে তার ম্যানুয়াল তৈরি করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।