বিএম ডিপোর আগুন রাসায়নিক থেকেই, দায় ছিল সবারই: তদন্ত কমিটি

সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে থাকা রাসায়নিক থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করছে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের গঠিত তদন্ত কমিটি।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2022, 01:20 PM
Updated : 6 July 2022, 04:09 PM

অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি বলেছে, এক মাস আগে বেসরকারি ওই কনটেইনারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মালিকপক্ষ এবং তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো দায় এড়াতে পারে না।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা বুধবার বিকালে চট্টগ্রমের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। 

কমিটির প্রধান মিজানুর রহমান বলেন, ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার কারণ, দায়-দায়িত্ব নিরূপণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে সুপারিশ প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাদের ওপর। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে তারা তদন্ত করেছেন।

কমিটির প্রতিবেদনে ২০টি সুপারিশ রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা দুর্ঘটনাস্থলে সরেজমিনে গিয়েছি এবং কারা এর জন্য দায়ী তা নির্ধারণের চেষ্টা করেছি। এটাকেই চূড়ান্ত বলা যাবে না। এ ঘটনায় বৃহত্তর তদন্তও হতে পারে।”

বিভাগীয় কমিশনার আশরাফ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনার পর সরকারের নির্দেশে এ তদন্ত কমিটি করা হয়। এ প্রতিবেদন মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। সেখান থেকে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ হবে।

গত ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর একের পর এক বিস্ফোরণে তা ছড়িয়ে পড়ে। ডিপোতে থাকা রাসায়নিকের কারণে ছড়িয়ে পড়া ওই আগুন ৮৬ ঘণ্টা পর বিভিন্ন বাহিনীর চেষ্টায় নেভানো হয়।

ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। অগ্নিকাণ্ডের এক মাস পর বুধবারও সেখান থেকে পোড়া হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়েছে।  

অগ্নিকাণ্ডের পর বিভিন্ন সংস্থার পরিদর্শনে ওই ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকার বিষয়টি উঠে আসে। বিএম ডিপোর মূল প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের সহযোগী আল রাজী কেমিকেল কমপ্লেক্স থেকে এসব রাসায়নিক বিদেশে রপ্তানির জন্য সেখানে রাখা ছিল। 

তদন্ত কমিটির প্রধান মিজানুর রহমান বলেন, ওই হাইড্রোজেন পার অক্সাইডই ডিপোতে ‘আগুনের উৎস’।

“দুর্ঘটনার জন্য ডিপো মালিক কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না। এছাড়া তদারকির দায়িত্বে থাকা দপ্তরগুলোও দায় এড়াতে পারেন না।”

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে শনিবার রাতে আগুন লাগার পর শত শত কন্টেইনার পোড়ার সঙ্গে দফায় দফায় ঘটে বিস্ফোরণ। ছবি: সুমন বাবু

 

কী ঘটেছিল সীতাকুণ্ডে?

বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দুই কোম্পানির যৌথ বিনিয়োগে বেসরকারি এই ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটি গড়ে তোলা হয় ২০১১ সালে। এর মালিকানায় আছেন বাংলাদেশের স্মার্ট গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান এবং তার ছোট ভাই চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবুর রহমান।

স্মার্ট গ্রুপের আরেক কোম্পানি আল রাজী কেমিকেল কমপ্লেক্স লিমিটেডে উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানির জন্য রাখা ছিল কনটেইনার ডিপোতে। ওই রাসায়নিকই যে আগুনকে ভয়ঙ্কর রূপ দিয়েছে, সে কথা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা শুরু থেকেই বলে আসছেন। 

চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ওই কন্টেইনার ডিপোতে ৪ জুন রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের কুমিরা ও সীতাকুণ্ডের দুটি ইউনিটের কর্মীরা তা নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানে একের পর এক বিস্ফোরণ শুরু হলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

বিকট বিস্ফোরনের ধাক্কায় বহু দূর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে, পাশের গ্রামের ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা।

ডিপো কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, সেখানে ৪৪০০ এর মত কন্টেইনার ছিল। এর মধ্যে অন্তত ৪০০ কন্টেইনার ধ্বংস হয়েছে বলে সে সময় তথ্য দিয়েছিলেন উদ্ধারকর্মীরা।

অর্ধশত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়ে, বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে, ৮৬ ঘণ্টা পর পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয় সেই নরককুণ্ড। যারা নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে নয়জনই ফায়ার সার্ভিসের কর্মী।

ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় বেসরকারি এ টার্মিনালের আটজনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। ডিপোতে অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির অভিযোগ আনা হয়েছে মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে।

আসামিরা হলেন- বিএম কন্টেইনার ডিপোর ডিজিএম (অপারেশন) নুরুল আকতার, ম্যানেজার (অ্যাডমিন) খালেদুর রহমান, সহকারী অ্যাডমিন অফিসার আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মো. নাসির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) আবদুল আজিজ, কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশনের ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, একই বিভাগের নজরুল ইসলাম ও জিএম (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) নাজমুল আকতার খান।

স্মার্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুজিবুর রহমান।

 

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড

যেদিন রাতে ওই ডিপোতে আগুন লাগল, পরদিন সেখানে গিয়ে পোড়া ও জ্বলন্ত কনটেইরারের আশপামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেল নীল রঙের বেশ কিছু জেরিকেন। ফেটে বা গলে যাওয়া সেসব জেরিকেনের গায়ে লেখা ছিল হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড। তাপ পেলে যে সেগুলো বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে- সে সতর্কবাণীও লেখা ছিল গায়ে।

বিভাগীয় কমিশনারের গঠিত তদন্ত কমিটি বলছে, ওই ডিপোতে মোট ৩৭টি কন্টেইনারে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল। প্রতি কন্টেইনারে ছিল ৬৮০টি করে রাসায়নিক ভর্তি জেরিকেন। প্রতি জেরিকেনে ৩০ লিটার করে রাসায়নিক ছিল।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ভর্তি মোট ২৫টি কন্টেইনার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কমিটির সদস্যরা কন্টেইনারগুলোর ভেতরে কাঠের পাটাতন পেয়েছেন। কেমিকেল ভর্তি জেরিকেনগুলোর সনদও যথাযথ ছিল না।  

তদন্ত কমিটির এক সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগুনের উৎস মূলত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড। আইএমডিজি কোড অনুযায়ী হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিপজ্জনক রাসায়নিক হিসেবে বিবেচিত।

“এসব রাসায়নিকের কিছু কন্টেইনার ৪০ দিনের বেশি সময় ধরে সেখানে পড়ে ছিল। রপ্তানির সমস্যার কারণে সেগুলো সেখানে ছিল। চারবার তারিখ বদল হয়েছে কিছু চালানের।’’

ডিপোতে আগুন লাগার পরদিন চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আনিসুর রহমান বলেছিলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা প্রথাগতভাবে পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেন শুরুতে। পানি ছিটাতে শুরু করার পর শুরু হয় বিস্ফোরণ। ডিপোতে যে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল, সেটা ডিপোর কেউ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের জানায়নি।

আর বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়, ডিপোটিতে রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখার অনুমতি ছিল না। শুধু হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কারণে আগুন লেগে বিস্ফোরণ হয়নি। সেখানে অন্য কোন দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি থাকতে পারে বলে ধারণা তাদের।

রাসায়নিক রাখার বিষয়ে ওই ডিপো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ছাড়পত্র পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নেয়নি বলে সংস্থাটির চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল আলম সে সময় জানান।

যে কারখানায় ওই হাইড্রোজেন পার অক্সাইড তৈরি হয়েছিল, ইটিপির শর্ত পালন না করায় সেই আল রাজী কেমিকেল কমপ্লেক্স ছাড়পত্রও পরিবেশ অধিদপ্তর ২০২১ সালের পর আর নবায়ন করেনি।

আর কী পেল তদন্ত কমিটি?

বিভাগীয় কমিশনারের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মিজানুর রহমান জানান, অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে মোট ২৪ জনকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।

এর মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শী, ডিপোর দুই মালিক, বিএম ডিপোর সহযোগী প্রতিস্ঠান আল রাজী কেমিকেলের কর্মকর্তা, ডিপো পরিচালনার সাথে যুক্ত কর্মী, বিভিন্ন শিপিং লাইন্সের কর্মী, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মীরা রয়েছেন। তবে ডিপোর নির্বাহী পরিচালক এবং জিএমকে তদন্ত কমিটির সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেননি।

তিনি জানান, কমিটি চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম কাস্টমস, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতিবেদন নিয়েছে। এছাড়া দুর্ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা নমুনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়েছে।

ঘটনার বিস্তারিত জানতে কমিটির সদস্যরা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বললেও ডিপো থেকে কোনো সিসিটিভি ভিডিও সংগ্রহ করতে পারেননি।

ভিডিওর কোনো ব্যাকআপও ছিল না জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, “আধুনিক ব্যবস্থাপনায় ডিপো কর্তৃপক্ষের ব্যাকআপ না থাকা মানা যায় না।”

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কদমরসুল এলাকার বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুনের পর ভয়াবহ বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া অনেক কন্টেইনার ছিল রপ্তানির পোশাক পণ্য ভর্তি। ছবি: সুমন বাবু

এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে তদন্ত কমিটি ২০টি সুপারিশ দিয়েছে জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, বিপজ্জনক পণ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া বেরসকারি বিভিন্ন ডিপো বা অফডক করতে গেলে ২৫টি প্রতিষ্ঠানের সনদ বা ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়। ভবিষ্যতে এ ধরণের দুর্ঘটনা এড়াতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সময় কমিটির সদস্যদের মধ্যে চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেন খান, নগর পুলিশের উপ-কমিশনার ফারুকুল হক, চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিম, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল আলম, সিআইডি চট্টগ্রমের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তার, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের মেজর কাওসার, ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক নিউটন দাশ, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের তোফাজ্জল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

দুর্ঘটনার পর মোট ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর এবং বিভাগীয় কমিশনারের গঠিত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিল।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের করা তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতাসহ অগ্নি নির্বাপন যন্ত্রের স্বল্পতার বিষয়টি তুলে আনে।

ওই কমিটি বিস্ফোরণের কারণ খুঁজে বের করতে না পারলেও ‘ভয়াবহ এ ঘটনার দায় ডিপো কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না’ বলে মত দেয়।

এছাড়া বন্দরের করা তদন্ত কমিটি ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে চারটি ভাগে বিভিন্ন সুপারিশ করে।

পুরনো খবর