রাতের পর দিনভরও থেমে থেমে বিস্ফোরণের পর আগুন না নেভায় বেসরকারি ওই কন্টেইনার টার্মিনালে রাসায়নিক থাকার অনুমতির বিষয়ে প্রশ্ন ওঠার মধ্যে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয় বলছে, প্রাণঘাতি এ দুর্ঘটনার পরই তারা প্রথম জানতে পারে সেখানে রাসায়নিক রাখা ছিল।
এ কার্যালয়ের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন জানান, বিএম কন্টেইনার ডিপোর রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখার কোনো অনুমতি নেই।
সেখানে দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ বা মজুদের কোনো নিয়ম না মানার কারণেই হয়ত ভয়ানক এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তার ধারণা।
যদিও ডিপো কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের সব ধরনের অনুমোদন রয়েছে।
শনিবার রাতে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর এলাকায় অবস্থিত এ ডিপোতে আগুন লাগর পর বিকট বিস্ফোরণে পুড়ে ও আহত হয়ে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ ৪১ জন। বিভিন্ন মাত্রায় আহত হয়েছেন দুইশ’র বেশি মানুষ।
এদের বড় অংশই বিস্ফোরণের পর আগুনে পুড়ে যাওয়া। আহতদের মধ্য বেশি সংকটাপন্নদের হেলিকপ্টারযোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
শনিবার রাত সাড়ে নয়টার পর থেকে রোববার পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ডিপোতে রাসায়নিক থাকার খবর তাদের জানানোই হয়নি। সেখানে আর কোন কোন ধরনের রাসায়নিক আছে- সে বিষয়েও তেমন তথ্য নেই তাদের কাছে।
“রাসায়নিক থাকার কথা জানতে পারলে আমরা হয়ত অন্যভাবে এগোতাম; আরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারতাম, ফোম ব্যবহার করতে পারতাম।”
তৈরি পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন আমদানি ও রপ্তানির কন্টেইনার খালাস ও পরিবহনের জন্য গড়ে তোলা এ ডিপোতে রাসায়নিক মজুদ বা সংরক্ষণ করা হবে কেন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন চট্টগ্রামের বিস্ফোরক পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন।
দুর্ঘটনার পর রোববার সকালে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মীরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তাদের মতে, রাসায়নিক থেকে আগুন লেগেছে এবং সেখানে দাহ্য পদার্থও ছিল। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে ফেটে যাওয়া বেশকিছু ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের’ প্লাস্টিক জার দেখা যায়।
তোফাজ্জল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কন্টেইনার ওঠানামার জন্যই এ ডিপো। সেখানে রাসায়নিক উপাদান সংরক্ষণ করবে কেন? এখনো পর্যন্ত দুর্ঘটনার উৎপত্তিস্থলের কাছে আমরা কেউ যেতে পারিনি। সেকারণে নিশ্চিত নই কোথা থেকে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
“এখানে কেমিকেল থেকে আগুন লেগেছে যেমন সত্য, তেমনি দাহ্য পদার্থও ছিল। না হলে বিস্ফোরণ কেন হবে? তবে কি ধরনের দাহ্য পদার্থ তা এখনও জানি না। তাদের রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখার কোনো অনুমতি নেই। আমরা এখানে এসে প্রথম জানলাম ডিপোতে রাসায়নিক রাখা ছিল।”
ঘটনাস্থলে থাকা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের জার পাওয়া বিষয়ে এই পরিদর্শক বলেন, “এটি একপ্রকার রাসায়নিক যা আগুন বাড়াতে সাহায্য করে। এতে কিন্তু বিস্ফোরণ হওয়ার কথা নয়।”
বিএম কন্টেইনার ডিপো হয়তো তা মানেনি উল্লেখ করে তোফাজ্জল বলেন, তদন্ত শেষে জানা যাবে কি কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে।
দাহ্য পদার্থ বা রাসায়নিক রাখার অনুমতি না থাকা প্রসঙ্গে বিএম কন্টেইনার ডিপোর মালিক প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) অবসরপ্রাপ্ত মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শনিবার রাতের আগুনের নমুনায় ধরে নেওয়া স্বাভাবিক সেখানে বিস্ফোরক ছিল। বিষয়টি এখন তদন্তাধীন, সুতরাং এ বিষয়ে এখন কথা না বলাই ভালো। তদন্তে উঠে আসুক আসলে কী হয়েছিল এবং অনুমতি ছিল কি না।”
ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপক নাজমুল আকতার খান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রপ্তানির জন্য এগুলো এখানে এনে রাখা হয়েছিল। আমাদের সব রকমের অনুমতি আছে।”
অন্য প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “রাসায়নিক পণ্যের কন্টেইনার আলাদা রাখা ছিল। তবে কত কন্টেইনার ছিল তা জানা নেই। সরকারের কাছে আহ্বান পুরো তদন্ত হোক।”
রোববার সকালে পরিদর্শন শেষে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মো. শাহজাহান জানান, ডিপোতে ২৬টি কন্টেইনারে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিল। এর বাইরে ডিপোর টিনশেডেও প্লাস্টিকের জারেও এই রাসায়নিক ছিল।
চট্টগ্রাম নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ২৪ একর জায়গায় অবস্থিত বিএম কন্টেইনার ডিপো ২০১১ সালের মে মাসে নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটির বাংলাদেশ অংশে মালিকানায় রয়েছে স্মার্ট গ্রুপ। এটির ধারণক্ষমতা চার হাজার ৩০০ কন্টেইনার।
এ ব্যবসায়িক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাঁশখালী উপজেলার বাসিন্দা মুজিবুর রহমান, যিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। তিনি ওই ডিপোর পরিচালকও।
তার বড় ভাই মুস্তাফিজুর রহমান বর্তমানে ডিপোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ডিপোর অনুমোদন কোন প্রক্রিয়ায়
নতুন একটি কন্টেইনার ডিপো স্থাপনের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয় এবং পরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মূল লাইসেন্স দিয়ে থাকে।
বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোর বিভিন্ন সংস্থা থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘‘তবে দাহ্য জাতীয় বা রাসায়নিক উপাদানের ক্ষেত্রে বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের ছাড়পত্র নিতে হয়।“
ওই ডিপোর অনুমোদন ছিল কি না তা তদন্তে উঠে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
গত ১৫ বছর ধরে এটি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এর মধ্য দিয়ে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি। আদৌ এ দুর্ঘটনা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থেকে হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত।
দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বিএম কন্টেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য জানা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেকোনো ধরনের রাসায়নিক সংরক্ষণ বা পরিবহনের জন্য আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত গাইডলাইন রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ করতে হয়। কোনো রাসায়নিক ক্রয় বা পরিবহনের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম অনুসরণ করতে হয়।
“রাসায়নিক পদার্থ ওয়েল ভেনটিলেটেড থাকতে হবে, নির্দিষ্ট জায়গায় নির্ধারিত তাপমাত্রায় রাখতে হবে।”
হাইড্রোজেন পার অক্সাইড আগুন বাড়াতে পারে উল্লেখ করে রসায়নের এই শিক্ষক বলেন, “এটি অন্য দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসলে বড় ধরনের বিস্ফোরণ হতে পারে। সুতরাং ওই ডিপোতে অন্য দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
আরও পড়ুন: