রাসায়নিকের তথ্য ‘না দেওয়ায়’ এতো প্রাণহানি: ফায়ার সার্ভিস

সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড কিংবা কোনো রাসায়নিক থাকার তথ্য ‘না দেওয়ায়’ পানি দিয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে কর্মীদের হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2022, 06:29 PM
Updated : 7 June 2022, 06:29 PM

অগ্নিনির্বাপণ সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, বিস্ফোরণ ঘটার মতো রাসায়নিক থাকার তথ্য জানা থাকলে বিকল্প উপায়ে আগুন নেভানোর উদ্যোগ নেওয়া যেত। এতে করে বিপুল  প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হতো।

সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ির বিএম ডিপোতে শনিবারের আগুন এবং বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪১ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার ডিপোতে মিলেছে আরও দুটি দেহাবশেষ। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ।

এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৯ জন নিহত, ৩ জন নিখোঁজ এবং ১৫ জন আহত হয়েছেন।

ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. আনিসুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিপো কর্তৃপক্ষ ঘটনার দিন এমন কোনো তথ্য দেননি যে এখানে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বা এ জাতীয় কোনো রাসায়নিক আছে। যা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

“সেটা জানা না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কুমিরা ও সীতাকুণ্ড এই দুই স্টেশনের আমাদের জনবল, অফিসার এবং গাড়ি সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও আছেন। ছবি: সুমন বাবু

মঙ্গলবার পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের আরও ৩ জন এখনো মিসিং। আজ সকালে আমরা আরও দুটি দেহাবশেষ উদ্ধার করেছি। এর মধ্যে আলামত দেখে মনে হচ্ছে একজন আমাদের কর্মী।”

ফায়ার সার্ভিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বা কোনো রাসায়নিক আছে এ তথ্য জানা না থাকায় আমাদের কর্মীরা পানি দিয়ে আগুন নেভাতে গিয়েছিল।

“সেখানে যে শেডটি পুড়ে গেছে তাতে বিপুল পরিমাণ ঝুট কাপড় ছিল। সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে জেনেছি। ওই শেডের পাশেই ছিল হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের কন্টেইনার।”

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা বলেন, “ঝুটের আগুনে ওই কন্টেইনারে থাকা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড উত্তপ্ত হচ্ছিল। আমাদের কর্মীরা যখন পানি ছিটাতে শুরু করেছিল তখন তারা জানতো না কোন কন্টেইনারে কী আছে।

“সাধারণ আগুন ভেবেই তারা পানি দিয়ে নেভাতে গিয়েছিল। এর মধ্যে একটি কন্টেইনারে পানি ছিটাতে শুরু করার ১ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের মাথায় বিস্ফোরণটি ঘটে।”

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও আছেন। ছবি: সুমন বাবু

বিভিন্ন ফেসবুক লাইভ ভিডিওতে দেখা গেছে, শুরুতে আগুন ছিল স্বল্প পরিসরে। শেডের পাশে কয়েক সারিতে কন্টেইনারগুলো একটির ওপর একটি করে রাখা ছিল। একেক সারিতে উপরের দিকে ৪-৫টি করে কন্টেইনার ছিল।

ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ইয়ার্ডের দক্ষিণ অংশে শেড লাগোয়া সারির একসঙ্গে কয়েকটি কন্টেইনারে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি নিয়ে কর্মীরা পানি ছিটাচ্ছিল। শুরুতে কয়েকটি কন্টেইনার লক্ষ্য করে পানি ছিটালেও আগুন কমেনি। পরে আরেকটি কন্টেইনার লক্ষ্য করে পানি ছিটাতে শুরু করার কিছুক্ষণ পরই বিকট বিস্ফোরণ হয়।

ওই বিস্ফোরণে আশেপাশে থাকা বেশিরভাগ মানুষকে ছিটকে পড়ে যেতে ভিডিও চিত্রে দেখা যায়।

বিএম ডিপোতে উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউছিয়া কমিটির সদস্যরা জানান, পুড়ে যাওয়া শেড এবং ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির আশেপাশ থেকেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের মরদেহের বেশিরভাগ উদ্ধার করা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের কুমিরা ও সীতাকুণ্ড স্টেশনের যে দুটি গাড়ি শনিবার শুরুতে আগুন নেভাতে গিয়েছিল সে দুটিই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে একটি গাড়ি ডিপো থেকে সরিয়ে নেওয়া হলেও অন্যটি এখনো ডিপোর ভেতরেই আছে।

মঙ্গলবার উদ্ধার করা দুটি দেহাবশেষের একটি ওই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির কাছ থেকেই উদ্ধার করা।

ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, “ডিপোতে শুধু গার্মেন্টস পণ্য ছিল না। এর বাইরে খাদ্যপণ্য, বিভিন্ন কাঁচামাল এবং গার্মেন্টস এক্সেসরিজও ছিল। যা আগুনের জন্য সহায়ক।

“এ ধরণের অবকাঠামোতে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক থাকলে এর নিরাপত্তায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনা থাকতে হয়। পাশাপাশি কর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও রাখতে হয়।”

বিএম ডিপোতে এমন নিরাপত্তা ছিল কি না জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কি না তা আমাদের তদন্ত কমিটি অনুসন্ধান করে দেখবে।”

তবে অগ্নি নির্বাপনে নিয়োজিত একাধিক সংস্থার কর্মীরা নিশ্চিত করেছেন, ওই ডিপোতে কোনো ফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল না। যা এরকম বড় অবকাঠামোতে আগুন নেভাতে প্রয়োজনীয়।

বিএম ডিপোর মালিক পক্ষ স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপক (অ্যাডমিন) মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড আমদানি-রপ্তানি পণ্য। দেশের ৬টি কোম্পানি এটি উৎপাদন করে।

“স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য পণ্যের মত এটিও ডিপোতে শুল্কায়ন শেষে বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমাদের ডিপোর মাধ্যমেও পণ্যটি রপ্তানি হয়ে আসছে।”

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এখানে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের একটি অফিস আছে। তারা ডিপোতে আমদানি-রপ্তানি কাজে সার্বক্ষণিক তদারকি করেন। তাদের অনুমতি ব্যতীত কন্টেইনার তো দূরের কথা এক কেজি পণ্যও ডিপোতে প্রবেশ কিংবা বের করা অসম্ভব।

“ডিপোতে হাজার হাজার কন্টেইনারের মধ্যে মাত্র একটি কন্টেইনারের বিস্ফোরণ হওয়া রহস্যজনক। ডিপো কর্তৃপক্ষ এ ঘটনার একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চায়।”

তবে ডিপোর অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কিছু উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে রোববার বিএম ডিপোর জিএম (সেলস ও মার্কেটিং) নাজমুল আকতার খান জানিয়েছিলেন, ডিপোতে অগ্নি নির্বাপনের সব রকম সরঞ্জাম ও প্রস্তুতি ছিল।

আরও পড়ুন: