অক্সিজেন প্ল্যান্টটির ‘এয়ার সেপারেশন কলাম’ থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত বলে ধারণা তদন্ত কমিটির।
Published : 05 Mar 2023, 08:47 PM
চট্টগ্রামে যে অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত হয়েছেন, সেখানে এক সময় ‘ত্রুটি’ পেয়েছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।
পরিদর্শনে সেই ত্রুটি পাওয়ার পর সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টকে নোটিসও দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মিনা মাসুদ উজ্জামান।
তবে কী ধরনের ত্রুটি ছিল, সে বিষয়ে তিনি এখন কিছু বলতে রাজি হননি। বিষয়টি এখন তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন উদ্দিন দাবি করছেন, কারখানা পরিচালনায় তাদের কোনো গাফিলতি ছিল না।
সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাছে বেসরকারি ওই কারখানায় শনিবার বিকালে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে কারখানাটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। নিহত হন মোট ছয়জন। বিস্ফোরণে কারখানার বিভিন্ন সরঞ্জাম উড়ে কয়েকশ গজ দূরে গিয়েও পড়ে।
১৯৯৬ থেকে সচল এই কারখানাটিতে যে প্ল্যান্টটি বিস্ফোরিত হয়েছে তা ২০১৭ সালে চালু হয় বলে কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন।
এই ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটি রোববার পরিদর্শনের পর ধারণা করছে, প্ল্যান্টের ‘এয়ার সেপারেশন কলাম’ থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত।
বিস্ফোরণে আহতদের দেখতে রোববার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান কল কারখানা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মিনা মাসুদ উজ্জামানসহ কয়েকজন কর্মকর্তা।
ঘনবসতির মধ্যেই সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট; উবে গেল প্রাণ, রেখে গেল ধ্বংসচিহ্ন
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের বিভীষিকা আহতদের বয়ানে
অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ ‘এয়ার সেপারেশন কলাম থেকে’
সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ: নিখোঁজের তথ্য নেই, ২২ ঘণ্টা পর উদ্ধারে ইতি
সেখানে মিনা মাসুদ উজ্জামান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমাদের দপ্তর থেকে এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত শেষে জানা যাবে সেখানে কী হয়েছিল? যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আমরা তাদের সহযোগিতা করতে এসেছি।”
শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে দুই লাখ টাকা এবং দাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছে। আহতদের দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকা করে।
সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের এক বছরের মধ্যে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ ঘটল। ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে- জানতে চাইলে মিনা মাসুদ উজ্জামান বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত পরির্দশন করে থাকি। ভুল-ত্রুটি থাকলে তা শোধরানোর জন্য নোটিস দিয়ে থাকি।”
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে পরিদর্শন হয়েছিল কি না কিংবা তাতে কোনো ত্রুটি পেয়েছিলেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যে ত্রুটি ছিল, তা পরিদর্শন করে কারেকশন অ্যাকশন প্ল্যান (সিএবি) দেওয়া হয়েছিল, যাতে তারা সংশোধন করতে পারে। সে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, নোটিসও দেওয়া হয়েছিল।”
কী ত্রুটি ছিল- জানতে চাইলে মাসুদুজ্জামান বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, “তা এখন বলতে পারব না। যারা স্থানীয় অফিস থেকে (নোটিস) দিয়েছেন, তারাই জানেন। তারাই বলতে পারবেন।”
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাতও এসময় উপস্থিত ছিলেন।
কবে নোটিস দেওয়া হয়েছিল, কী ত্রুটি ছিল- তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে যান। পরে তার মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
রোববার সকালে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট পরিদর্শন করেন বিস্ফোরক অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন।
তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানটির ২০২২ সাল পর্যন্ত বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স নবায়ন করা ছিল।
চলতি বছরের লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করা হয়েছে বলে কারখানাটির মালিকপক্ষ দাবি করেছে।
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছেন, কারখানা পরিচালনায় তাদের কোনো গাফিলতি ছিল না। কারখানা পরিচালনার জন্য যা যা দরকার, সবকিছু মেনেই তারা কারখানা পরিচালনা করছেন।
এই বিস্ফোর তদন্তে প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটিকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাসও দেন তিনি।
দুর্ঘটনার পরপরই প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা রোববার বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন, প্ল্যান্টের ‘এয়ার সেপারেশন কলাম’ থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হতে পারে।
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান এই ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি বলছেন, সঠিক বিষয়টি জানতে আরও তদন্ত প্রয়োজন।
বেসরকারি ওই কারখানায় অনুমোদনহীন অক্সিজেন সিলিন্ডারের সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন সিলিন্ডারও পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
কারখানার সুপারভাইজার সানাউল্লাহ জানান, সীমা গ্রুপের দুটি অক্সিজেন কোম্পানি আছে। তার মধ্যে অক্সি অক্সিজেনের তিনটি ও দুর্ঘটনা কবলিত সীমা অক্সিজেন কোম্পানির দুটিসহ পাঁচটি প্ল্যান্ট ছিল। তার মধ্যে অক্সি অক্সিজেন কোম্পানির তিনটি প্ল্যান্ট বন্ধ আছে। আর বিস্ফোরণে সীমা প্ল্যান্টের দুটি প্ল্যান্ট ধ্বংস হয়ে গেছে।
দুর্ঘটনাকবলিত প্ল্যান্টটিতে উৎপাদন করা হত অক্সি-এসিটিলিন গ্যাস। এটি মূলত শিল্পে ব্যবহার করা অক্সিজেনের প্ল্যান্ট। অক্সি-এসিটিলিন গ্যাসের শিখা দিয়ে লোহার পাত কাটা হয়। একই সঙ্গে রি রোলিং মিলে লোহা গলাতে ব্যবহার করা হয়।
আশপাশের জাহাজভাঙা শিল্প ও স্টিল রি-রোলিং মিলে ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করা হয় সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে।
সুপারভাইজার সানাউল্লাহ বলেন, এখন জাহাজ কাটার কাজ কম থাকায় অক্সিজেন উৎপাদনও কম হচ্ছে। তাই কাজে শ্রমিকও কম ছিল। শিফটিং ডিউটিতে শনিবার দুর্ঘটনার সময় ছয়জন ডিউটিতে ছিলেন। তাদের মধ্যে তিনজন নামাজের জন্য বের হয়ে যান।