হাতি বনাম মানুষ, কার ঠিকানায় কে?

স্থানীয়রা চান, ওই এলাকা থেকে হাতিগুলো সরানো হোক; তবে তা ‘সম্ভব না’ বলে জানাচ্ছেন বন বিশেষজ্ঞরা।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Nov 2023, 02:25 AM
Updated : 4 Nov 2023, 02:25 AM

গত ছয় বছর ধরে চট্টগ্রামের পাহাড়, হ্রদ ও বন ঘেরা জায়গায় বিচরণ হাতির দলটির। তাদের হামলায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, যাচ্ছে মানুষের প্রাণ। সম্প্রতি নবনির্মিত টানেল রোড পারাপারের ঘটনায় আবারও আলোচনায় এসেছে সেই হাতির পাল।

গত সপ্তাহের এক রাতে বঙ্গবন্ধু টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে নির্মিত অ্যাপ্রোচ রোডের পশ্চিম বৈরাগ অংশ পার হয় ওই পালের তিনটি হাতি। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে গত সেপ্টেম্বরেও একটি হাতি পারাপারের আরেকটি ভিডিও আলোচনায় আসে।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, আনোয়ারা ও বাঁশখালী উপজেলার ওপর দিয়ে চলাচল করে একাধিক হাতির পাল। ভিডিওতে দেখা গেছে তারই একটি দলকে। কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন জুড়ে তাদের বিচরণ।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই হাতির দলের তাণ্ডবে তারা সবসময় আতঙ্কে থাকেন। ধান ও কলা গাছসহ খাবারের খোঁজে প্রায় রাতেই হানা দেয় হাতি।

ওই এলাকার জনপ্রতিনিধিরা হাতিগুলো সরিয়ে নিতে বহুবার বন বিভাগকে চিঠি দিয়েছে। নিহত, আহত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়মিত ক্ষতিপূরণও দিচ্ছে বন বিভাগ।

তবে বন বিভাগ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেদের করিডোরে (চলাচলের পথ) কোনো বাধা হাতি সহ্য করতে পারে না। আর পূর্ব পুরুষের আবাসস্থল হওয়ায় ওই হাতির দলটি এ এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে না।

এল কোথা থেকে

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়ন এবং আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের প্রায় আড়াই হাজার একর পাহাড়ি ভূমিতে কোরিয়ান এক্সেপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৬-০৭ সালের দিকে।  

দেয়াং পাহাড় ঘেরা ওই এলাকায় ২০১২-১৩ সাল থেকেই হাতির আনাগোনা বেশি। আগেও হাতির আসা-যাওয়া ছিল, তবে তখন তুলনামূলক কম ছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও বন বিভাগের ভাষ্য।

২০১৮ সালের শেষ দিকে ওই হাতির দলটি স্থায়ীভাবে কেইপিজেড এলাকায় বসবাস শুরু করে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাতির আক্রমণে ওই এলাকায় মানুষের প্রথম মৃত্যু হয়।

কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান এবং আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ, বারখাইন, বটতলী ও বারশত; এই পাঁচ ইউনিয়নে গত ৬ বছর ধরে হাতির দলটি ‘তা্ণ্ডব’ চালাচ্ছে।

শুরুতে এই দলে দুটি বড় এবং একটি ছোট হাতি ছিল। মাঝে মাঝে আরো একটি বড় আকারের হাতিকে এ দলের সাথে দেখা যায়। স্থানীয়দের কাছে সেটি ‘লেজ কাটা’ হাতি নামে পরিচিত।

জলদি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১২-১৩ সালে ওই এলাকায় কর্মরত অবস্থায় দেখেছি, তখন থেকে সেখানে একাধিক হাতির দলের আনাগোনা ছিল। ২০১৮ সালের পর এই দলটি সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে গেছে।

“মূলত চুনতি অভয়ারণ্যে বেশকিছু হাতি আছে। বাঁশখালীর বনেও আছে। চুনতি থেকে বাঁশখালী হয়ে আনোয়ারার ওই এলাকা হাতির করিডোর। এই পথে হাতিদের কয়েকটি দল চলাচল করে। এই দলটিও একই পথে এসেছিল।”

বড়উঠান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, “এরা সন্ধ্যার পর থেকে খাবারের খোঁজে বিভিন্ন লোকালয়ে যায়। কিন্তু মধ্যরাতে বা ভোরের দিকে আবার কেইপিজেড এলাকায় ফিরে আসে। কথিত আছে, হাতির পূর্ব পুরুষ যেখানে থাকে পরের প্রজন্মের হাতিরাও সেখানে আসবে।”

প্রাণহানি ও ফসলের ক্ষতি

বড় উঠানের সুন্দরী পাড়া গ্রামটি দেয়াং পাহাড়ের কোলে। সেখানে প্রায় প্রতিরাতে আসে এই হাতির দল।

ওই গ্রামের বাসিন্দা মিলি আকতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাতে হাতি আসে ধান খেতে। যে বাড়িতে ধান আছে সে বাড়িতে হামলা করে। কলা গাছ খেয়ে ফেলে। বাড়ির সীমানা বেড়া এমনকি দেয়ালও লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলে। বহুবার উঠান থেকে আর গোলাতে রাখা ধান খেয়ে চলে গেছে। 

“গত কয়েক বছরে আমাদের এলাকায় একটা বাচ্চাসহ তিনজন মারা গেছে। রাতে পটকা, বাজি, মাইক নিয়ে এলাকার পুরুষরা পাহারা দেয়। গত ৮-১০ বছর ধরে হাতির উৎপাত বেড়েছে। আগে এরকম ছিল না।”

এলাকায় লোকজন ভয়ে রাতে চলাচল করে না জানিয়ে বড় উঠানের চেয়ারম্যান দিদারুল আলম বলেন, “সপ্তম শ্রেণির একজন ছাত্রসহ আমার এলাকার তিনজনকে হাতি মেরে ফেলেছে। আহত হয়েছে ২৫-৩০ জন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাতি হামলা করে। এমনকি শিক্ষার্থীরা লেখাপড়াও করতে পারে না শান্তিতে। পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার সময় আশপাশের এলাকার আত্মীয় বাড়িতে চলে যায়।”

পাশের বৈরাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নোয়াব আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত কয়েক বছরে পাঁচ ইউনিয়নে প্রায় ২০ জন মারা গেছে হাতির হামলায়।

“যে কোনো সময় এরা লোকালয়ে চলে আসে। চাষের জমিতে নেমে যায়। কয়েক কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি করেছে।”

হাতির হামলায় নিহত-আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রতি ২-৩ মাস পরপর ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় বলে জানান বন কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ।

টানেল রোডে হাতির দেখা

গত সপ্তাহে কর্ণফুলী টানেলের আনোয়ারা অংশে সংযোগ সড়কের পশ্চিম বৈরাগ অংশ দিয়ে পারাপার হতে দেখা যায় হাতির ওই পালকে। দলে ছিল তিনটি হাতি। টানেল সংযোগ পারাপারের বেশ কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা মো. দেলোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাত প্রায় ২টার দিকে আমি গাড়ি নিয়ে ওই পথে যাচ্ছিলাম। আমি যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন হাতিগুলো রাস্তা পার হয়ে অন্য পাশের জমিতে নেমে গেছে। দূর থেকে দেখি তারা চলে যাচ্ছে।”

বৈরাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নোয়াব আলী বলেন, “হাতির দলে কখনো তিনটা আবার কখনো চারটা হাতি থাকে। রাতে তারা কেইপিজেডের ওখান থেকে আসে। আগেও বহুবার আমাদের এলাকায় তারা এসেছে।

“এবার টানেল রোড দিয়ে তাদের দেখা গেল। কয়েকদিন পর টানেল খুলবে। তখন গাড়ি চলাচল হবে। সে সময় হাতি নামলে নিরাপত্তা ঝুঁকি হতে পারে। বন বিভাগকে আমরা বহুবার বলেছি। স্থানীয় প্রশাসনসহ সবাই হাতির বিষয়টি জানে।”

জলদি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ অবশ্য হাতির কারণে টানেল রেডে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে করেন না।

তিনি বলেন, “দেশের অন্য জায়গায় যেখানে হাতি আছে, সেখানেও চলাচলের সময় মূল সড়কে চলে আসে। হাতি দেখলে গাড়ি থেমে যায়। এতে গাড়ি চলাচলে কোনো সমস্যা হয় না।”

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুন অর রশিদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হঠাৎ হয়ত হাতির দল ওই পথে আসে। হাতি যখন আছে, তখন চলাচল তো করবেই।”

করিডোর আর আবাসভূমি

কেইপিজেড এলাকায় আছে প্রায় ২৫টির মত বড় আকারের লেক, বাগান এবং পাহাড়ি এলাকা। সেখানেই বেশিরভাগ সময় কাটে হাতির দলটির।

বন কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, শুরুতে কেইপিজেডের পাহাড়ি এলাকা ন্যাড়া ছিল। গাছপালা ছিল কম। আশপাশের এলাকায় মানুষের বসতিও বাড়ে তখন। পরে সেখানে গাছপালা বাড়ায় ও লেক তৈরি হওয়ায় হাতির আনাগোনা বাড়তে থাকে।

“একটি হাতির দিনে ৮০-১০০ লিটার পানি এবং প্রচুর খাবার প্রয়োজন। আর করিডোর হওয়ায় ওই এলাকায় একাধিক হাতির দল আসা-যাওয়া করত। যার মধ্যে একটি দল স্থায়ী হয়েছে। হয়ত তাদের পূর্ব পুরুষ এখানে ছিল। তাই তারা স্থায়ী হয়েছে।”

গত ৬-৭ বছরে চুনতি-বাঁশখালী-আনোয়ারা পথে হাতির আরো একাধিক দল চলাচল করলেও অন্য কোনো দল সেখানে স্থায়ী হয়নি।

ফরেস্ট অ্যাকাডেমি চট্টগ্রামের পরিচালক ড. মোল্যা রেজাউল করিম জানান, গত বছর ওই দলে একটি হাতি শাবকের জন্ম হয়েছে।

“হাতি করিডোর মেনটেইন করে। আনোয়ারা থেকে বাঁশখালী হয়ে চুনতি পর্যন্ত তাদের এই করিডোর প্রসারিত। চলাচলের পথে কোনো ধরনের বাধা হাতি সহ্য করে না। তাদের করিডোরে মানুষ একের পর এক স্থাপনা করেছে নানা কারণে। এতে তাদের করিডোর ব্লক হয়ে গেছে।”

মোল্যা রেজাউল করিমের ভাষ্য, হাতির স্মৃতিতে যে তথ্য থাকে তা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়। এই হাতিগুলোর পূর্বপুরুষও এই পথে চলাচল করত।

“হাতিগুলো তাদের করিডোরের এক প্রান্তে আটকে গেছে। হাতির আরেকটি প্রবণতা হল, একবার খাবারের পর তাদের প্রায় ৫০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। না হাঁটলে তাদের হজম ও মেটাবলিক নানা সমস্যা হয়। এজন্যই হয়ত রাতে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় হাতিগুলোকে দেখা যায়।”

বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যায় অবশ্য স্থানীয়দের উদ্বেগ কমছে না। হাতিগুলো সরাতে বারবার প্রশাসনকে জানানোর পরও কাজ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন বড় উঠানের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ দিদারুল আলম।

তিনি বলেন, “আগের জেলা প্রশাসক এই এলাকা ঘুরে গেছেন। ভূমিমন্ত্রী মহোদয়সহ বৈঠক হয়েছে একাধিকবার। তিনি বলেছেন, হাতি সরাতে টাকা লাগলে তিনি দেবেন। কিন্তু বন বিভাগ কোনো উদ্যোগ নেয়নি।”

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বন কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, “এগুলো প্রকৃতিতে জন্ম নেওয়া হাতি। সেখান থেকে তাদের সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।”

মোল্যা রেজাউল করিম অবশ্য ভিন্ন সমাধান দেখছেন। তিনি বলেন, চলাচলের ন্যূনতম জায়গা হাতিগুলোকে দিতে হবে। করিডোরে বাধার কারণে হাতি-মানুষে দ্বন্দ্ব হচ্ছে।

“কাপ্তাইয়ে ৮ কিলোমিটার সোলার ফেনসিং করার পর এখন দ্বন্দ্ব অনেকটা কমেছে। শেরপুরের নালিতাবাড়িতেও ২ কিলোমিটার সোলার ফেনসিং করা হয়েছে। এখানেও একই রকম সোলার ফেনসিং করে মানুষের বসতি নিরাপদ করা যেতে পারে। তবে তার আগে হাতিগুলো নিয়ে ভালো স্টাডি প্রয়োজন।”

পুরবো খবর:

Also Read: আনোয়ারায় হাতির আক্রমণে একজন নিহত

Also Read: চট্টগ্রামে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে বৃদ্ধ নিহত

Also Read: চট্টগ্রামে হাতির হামলায় বৃদ্ধ নিহত

Also Read: হাতির চলার পথ এখন মানুষের আবাস

Also Read: পাহাড়ে খাদ্যাভাব: লোকালয়ে হাতি, বানর ও সাপ

Also Read: বন আর চলার পথ ফিরে পাবে হাতি?

Also Read: হাতির করিডোর: ডিসেম্বরে প্রতিবেদন পাওয়ার আশা