বছরের মাঝামাঝিতে চট্টগ্রামে বিএম ডিপোর আগুন নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে, মাস দুয়েক পর মিরসরাইয়ে ট্রেন-মাইক্রোবাস দুর্ঘটনাও দীর্ঘদিন শোকের ছায়া নামিয়েছিল চট্টগ্রাম নগরীতে; আগুনে পোড়া লাশের গন্ধ আর সেই ক্ষত চিহ্ন মুছে নতুন বছরে পা দিচ্ছে বন্দর নগরবাসী।
চট্টগ্রামে গত এক বছরে আলোচিত ঘটনার মধ্যে ছিল বিএম ডিপোর আগুন, যে ঘটনায় প্রাণ গিয়েছিল ৫১ জনের। এরপর মিরসরাইয়ে মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় শিক্ষার্থীসহ ১৩ জনের মৃত্যু হয়।
বছরের শেষ দিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে বাঁক বদলের সূচনা হিসেবে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি আর লড়াইয়ের উত্তাপও ছিল চট্টগ্রামে।
সেইসঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা, খুন, নির্বাচনী সহিংসতা আর আলোচিত মামলা রায়ের মতো অনেক ঘটনার সঙ্গে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় একসঙ্গে চারটি সাদা বাঘ শাবকের জন্মের মত আশা জাগানিয়া খবরও ছিলো।
অন্যদিকে নতুন বছরে আশার আলো দেখাচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম টানেল, যা বছরের শুরুর দিকেই উদ্বোধনের কথা রয়েছে। কর্ণফুলীর দুই তীরকে এক করছে এ টানেল, যাতে পথ খুলছে ভবিষ্যত বাণিজ্যের।
বিএম ডিপোর আগুন
সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগে গত ৪ জুন রাতে। ডিপোতে থাকা রাসায়নিকের কন্টেইনারগুলো বোমার মতো বিস্ফোরিত থাকে। ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মিলে ৮৬ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
মর্মান্তিক ওই ঘটনার সময় ডিপোর ভেতর থেকে একে একে বের হতে থাকে পোড়া লাশ; ফায়ার সার্ভিস সদস্যসহ সবমিলিয়ে ৫১ জনের প্রাণহানি ঘটে।
আগুনের তেজ কমলে ডিপোতে অনুসন্ধান চালালে পাওয়া যায় মানবদেহের অংশ বিশেষ। পোড়া লাশগুলোর পরিচয়ও শনাক্ত করা যাচ্ছিল না।
বাবা, সন্তান, স্বামী, ভাই কিংবা নিকটাত্মীয়ের ছবি নিয়ে ডিপোর এলাকা আর হাসপাতালে ভিড় করেন স্বজনরা। তাদের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সেই ঘটনার আলোড়ন ছড়ায় আন্তজার্তিক সংবাদমাধ্যমেও।
ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের কারণে ডিপোর অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। গঠিত হয় একাধিক তদন্ত কমিটি। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নিয়ে বছরের শেষ প্রান্তে এসে আবার ডিপোটিতে রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং শুরু হয়েছে।
মিরসরাইয়ে ট্রেন-মাইক্রোবাস সংঘর্ষ
বিএম ডিপো দুর্ঘটনার ঠিক দুই মাস পর মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ঝর্ণায় পিকনিক করতে গিয়ে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় শিক্ষার্থীসহ ১৩ জনের।
গত ২৯ জুলাইয়ের ওই ঘটনা ঘটে খৈয়াছড়া ঝর্না রেল ক্রসিংয়ে। সেখানে চট্টগ্রামের দিকে ছুটে চলা মহানগর প্রভাতী ট্রেনের ধাক্কায় একটি মাইক্রোবাস দুমড়ে মুচড়ে যায়। মাইক্রোবাসটিতে হাটহাজারীর আরএনজে কোচিং সেন্টারের ছাত্র ও শিক্ষকরা ছিলেন।
সেসময় ঘটনাস্থলেই চালকসহ ১১ জন মারা যান। এর পর সাতজনকে আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর সপ্তাহ খানেক পর মারা যায় আরও দুই জন।
শিশু আয়াত হত্যা
বছরজুড়ে পারিবারিক সহিংসতা, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে বেশকিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। এর মধ্যে আলোচনায় ছিলো নভেম্বরে পাঁচ বছরের শিশু আয়াত হত্যাকাণ্ড।
গত ১৪ নভেম্বর আলিনা ইসলাম আয়াত নিখোঁজ হওয়ার পর ইপিজেড থানায় জিডি করে তার পরিবার। পরে পিবিআই তদন্তে নেমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবীর আলী নামে এক কিশোরকে আটক করে।
জিজ্ঞাসাবাদে আবীর পিবিআই কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, আয়াতের মৃতদেহ ছয় টুকরো করে ছয়টি প্যাকেটে ভরে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দিয়েছিল সে।
দুই দফায় হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর আটক কিশোরকে নিয়ে অভিযানে গত ১ ডিসেম্বর আকমলী আলী রোড স্লুইচ গেইট এলাকার নর্দমা থেকে উদ্ধার করা হয় আয়াতের দুই পা ও পলিথিনে মোড়ানো মাথা। মর্মান্তিক ওই ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে।
আয়াত খুনের ঘটনার ছাড়াও গত ৬ মার্চ বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ দরবার শরীফ পরিচালিত আল্লামা শাহসুফী অছিয়র রহমান (ক.) মাদ্রাসা থেকে উদ্ধার করা হয় কায়দা শাখার শিক্ষার্থী সাত বছরের ইফতেখার মালিকুল মাশফির গলাকাটা লাশ। প্রথমে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে মাদ্রাসার তিন শিক্ষককে আটক করেছিল পুলিশ।
পরে পিবিআই মামলার তদন্তভার নিয়ে গত ১৯ জুন জানায় শিক্ষক নয়, এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল মাদ্রাসারই দুই শিক্ষার্থী।
এর দুই দিন পর নগরীর পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর ডানকান হিল পিলখানা এলাকার 'আলী বিন আবী তালিব' মাদ্রাসার পেছন থেকে উদ্ধার করা হয় ১৪ বছর বয়েসী আরমান নামে এক শিক্ষার্থীর লাশ।
জঙ্গল সলিমপুর
গত ১ জুলাই জঙ্গল সলিমপুরে পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে থাকা খাস জমিতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, স্পোর্টস ভিলেজ, ক্রিকেট স্টেডিয়াম, আইকনিক মসজিদ ও ইকো পার্কসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন চট্টগ্রামের বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান।
ওই এলাকায় মোট ৩ হাজার ১০০ একর জমির মধ্যে ৮৮ একর অবৈধ দখলদারদের হাতে থাকার কথা সেদিন জানিয়েছিলেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
২২ জুলাই থেকে সেখানে অবৈধ বসতি উচ্ছেদে যায় জেলা প্রশাসন। সেসময় এলাকার বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। যার প্রতিবাদে এলাকাবাসী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে নামলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
উচ্ছেদ অভিযানে বেশকিছু ভূমি উদ্ধারের কথা জানানো হয়েছিল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তবে মাস খানেক অভিযান চলার পর থমকে যায় ওই উচ্ছেদ অভিযান।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমাবেশ
জাতীয় নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকতে চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে গত ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির বিভাগীয় মহাসমাবেশ। ওই সমাবেশের পর সারাদেশে প্রায় ১০টি স্থানে সমাবেশ করে দলটি।
চট্টগ্রামে সমাবেশ পরবর্তী বিএনপি নেতাদের মূল্যায়ন ছিল, তাদের সমাবেশটি দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ‘মাইলফলক’ সৃষ্টি করেছে। জনগণের উপস্থিতি ‘অবিশ্বাস্য ও স্মরণীয়’। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কথার লড়াইয়ে যুক্ত হন প্রধান দুই দলের নেতারা।
এরপর চট্টগ্রামে ৪ ডিসেম্বর সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে সেখানে বক্তব্য দেন।
মামলা
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডে বরখাস্ত পুলিশ পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে মামলার রায় নিয়ে আলোচনায় ছিল চট্টগ্রাম।
গত ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজারের আদালতে আসামি প্রদীপ দাশ ও লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। এরপর গত ২৭ জুলাই চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন এবং অর্থ পাচারের দায়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপকে মোট ২০ বছর এবং তার স্ত্রী চুমকি কারণকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
এদিকে বছর আগে মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে গত ১৩ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পিবিআই। ছয় বছর আগে মিতু হত্যার ঘটনায় বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলাতেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
এছাড়া চট্টগ্রামের মিয়াখান নগরে বাড়ির মালিককে ফাঁসাতে পানির ট্যাংকে ফেলে দুই বছরের শিশু আবদুর রহমান আরাফকে হত্যার দায়ে গত ১৮ মে তিন আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত।
বঙ্গবন্ধু টানেল
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’, যা দক্ষিণ এশিয়ায় নির্মিত প্রথম টানেল। চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।
এ টানেলের প্রথম টিউবের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়ায় গত ২৬ নভেম্বর সেটির উদ্বোধন করেন প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা। দ্বিতীয়টিও প্রায় শেষের পথে। নভেম্বরের হিসাবে সব মিলিয়ে টানেলের কাজ এগিয়েছে ৯৩ শতাংশ।
এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে একটি নতুন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বানানো হচ্ছে এ টানেল। নির্মাণ কাজ করছে চীনা কোম্পানি ‘চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’।
বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ অর্থায়নে টানেল প্রকল্পের শুরুর দিকে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। অনুমোদনের দুই বছর পরে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শুরু হলে ব্যয় বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা করা হয়। পাশাপাশি মেয়াদ বাড়ানো হয় সদ্য বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
পুরনো খবর-