নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে বিএম ডিপো নামের ওই কন্টেইনার টার্মিনালে শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুন লাগে। পরে রাসায়নিকের কন্টেইনারে একের পর এক বিকট বিস্ফোরণ ঘটতে থাকলে বহু দূর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সবগুলো ইউনিট চেষ্টা করেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় রাতে সাড়ে ৩টার দিকে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে অগ্নি নির্বাপক গাড়ি পাঠাতে অনুরোধ করা হয়।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিছুর রহমান জানান, ডিপোতে রাসায়নিক থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে তাদের বেগ পেতে হয়েছে। রাতে বারবার বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে বার বার। রোববার সকালে তারা আগুন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেও পুরোপুরি নেভাতে পারেননি।
ওই ডিপোতে রাসায়নিকায় অগ্নিকাণ্ডের পর বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে বলেও জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অনেকে।
চট্টগ্রামের সহকারী কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার প্লাবন কুমার বিশ্বাস জানান, রাত ১০টা পর্যন্ত ৪১ জনের মৃত্যুর তথ্য তারা পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৩ জনের পরিচয় জানা গেছে। নিহতদের মধ্যে ৯ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী।
সিভিল সার্জনের কার্যালয় জানিয়েছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, পার্কভিউ হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতালে আহত বা দগ্ধ মোট ১৮২ জন ভর্তি আছেন। ওই দুই হাসপাতাল থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে ১২ জনকে। আরও ১০০ জনের বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
আহত ও দগ্ধদের মধ্যে অন্তত ১১ জন পুলিশও রয়েছেন। তাদের মধ্যে দুই পুলিশ সদস্যকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
“এখনো পর্যন্ত মালিকপক্ষের কারো সাথে যোগাযোগ হয়নি। সেনাবাহিনীর দল এসেছে। গতরাতে আগুন লাগে, আপনারা দেখছেন, এখনো জ্বলছে। ডিপোতে ড্রেন আছে, সেই ড্রেন হয়ে খালে গেছে সেই খাল আবার সাগরের সাথে সংযোগ আছে। রাসায়নিক যাতে সাগরে না যায় সে লক্ষ্যে উনারা কাজ করছেন।”
সেনাবাহিনীর ১ ইঞ্জিনিয়ার কোরের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিরা সুলতানা বলেন, “সমুদ্রে যাতে রাসায়নিক না যায়, সেটা প্রটেক্ট করাই এখন আমাদের মূল কাজ। সে লক্ষে কাজ চলছে। কিন্তু কয়টা কন্টেইনারে রাসায়নিক ছিল তা এখনো জানা যায়নি।”
বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাজাহান ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের বলেন, “এই ডিপো যারা পরিচালনা করছেন, তাদের আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। তারা ফায়ার ব্রিগেডকে গাইড করতে পারবে কোথায় কোন কন্টেইনার আছে। তাহলেই আগুন নেভানো সম্ভব। তাদের আহ্বান করছি তারা যেন দ্রুত এখানে আসে।
“এখানে সব রপ্তানি পণ্য আসে। রপ্তানির মধ্যে রাসায়নিক থাকতে পারে। ফায়ার ব্রিগেড জানিয়েছে রাসায়নিকের ২৬টি কন্টেইনার ছিল। ভিতরে গিয়ে দেখলাম ইকুইপমেন্ট আছে, কিন্তু লোকজন নেই ডিপোর। এমনকি ট্রেইলারও সেখানে রয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “আমরা বন্দর থেকে একটি তদন্ত কমিটি করেছি। অনিয়ম ছিল কিনা তা তদন্ত কমিটি অনুসন্ধান করে বলবে, নিরাপত্তায় বা অগ্নি নির্বাপণে কোনো ঘাটতি ছিল কিনা। বিস্ফোরণের কারণে আগুন ছড়িয়ে গেছে। শুরুতেই যদি সাহসিকতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যেত, তাহলে এত ব্যাপক হত না।”
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাঈনুদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, কুমিল্লা ও ফেনীর ২৫টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করছে। সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানিও অগ্নি নির্বাপণ ও উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছেন।
“এখানে কয়েকটা ড্রামে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড লেখা পেয়েছি। সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল এসেছেন। মালিকপক্ষের কাউকে আমরা পাইনি। কোথায় কোন পণ্যের কন্টেইনার রেখেছেন তা তো আমরা জানি না।”
আগুন কীভাবে লাগল প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “তদন্তের পর বোঝা যাবে, কেন আগুন লাগল। স্যাবোটাজও হতে পারে। কী হয়েছে কেবল তদন্ত বলতে পারবে।
“সরকারের কাছে আহ্বান, পুরো তদন্ত হোক। মূলত পোশাক ও খাদ্য পণ্য রপ্তানির জন্য ছিল। পোশাকের কন্টেইনারে আগুন লাগলেও তা ছড়িয়ে যেতে পারে।”
তার সঙ্গে থাকা ডিপোর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমস বিষয়ক সম্পাদক আশরাফুল আলম খান স্বপন বলেন, “হাজার কোটি টাকার পণ্য আছে এই ডিপোতে। শত শত কন্টেইনার পুড়েছে। রাতে সব রকমের কর্মীরা কাজ করছিল। দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি। কারণ এখানে বেশিরভাগ রপ্তানি পণ্য।”
এ ঘটনায় কত টাকার ক্ষতি হয়েছে, তা বুঝতে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বিজিএমইএ সহ সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেছেন, ১ থেকে ৪ জুনের মধ্যে তাদের সদস্যদের প্রায় এক হাজারের বেশি কন্টেইনার ওই ডিপোতে এসেছিল।
“এর মধ্যে রপ্তানি পণ্যই বেশি। এইচএন্ডএম ব্র্যান্ডের পণ্যও আছে। যে অক্ষত কন্টেইনারগুলো আছে সেগুলোকে পৃথক করা গেলে হয়ত কিছু রক্ষা পাবে।”
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডিপোতে আগুনের ঘটনায় দুইশজন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, “মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে জেনেছি। ডিপোতে আগুনে আহতদের চিকিৎসায় হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে কাজ করছেন, তা নজিরবিহীন। অনেক চিকিৎসক তাদের ছুটি বাতিল করে কাজে যোগ দিয়েছেন।”
জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান সন্ধ্যায় হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ফায়ার সার্ভিসের যে দলটি প্রথমে আগুন নেভাতে গিয়েছিল, সে দলের নয়জন নিহত হয়েছেন। আগুন লাগার পর বিস্ফোরণ শুরু হওয়ায় সেখানে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। পরে বিস্ফোরণ কমলে আবার কাজ শুরু করা হয়।
“ডিপোর দেড় কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচটি পুকুর আছে। ওইসব পুকুরের পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় কাজে বেগ পেতে হয়েছিল। তবে পুনরায় ২৫টি ইউনিট কাজ চালিয়ে গেছে।”
অগ্নিকাণ্ডের শুরুতে ডিপোর কর্মীরাই আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এরপর স্থানীয় কুমিরা স্টেশনের দুটি ইউনিটের গাড়ি ঘটনাস্থলে যায়। কিন্তু রাসায়নিকের একটি কন্টেইনারে আগুন লাগার পর বিস্ফোরণের ঘটে বলে ফায়ার সার্ভিস কর্মী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান।
স্থানীয়রা বলছেন, ডিপো থেকে তিন কিলোমিটার দূরের বাসিন্দারাও বিকট ওই বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। আশপাশের এলাকায় অনেক বাড়িঘরের কাঁচ ভেঙে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের আগ্রাবাদ স্টেশন থেকে সব গাড়ি রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয়। এরপর রাত বাড়ার সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরীর সব স্টেশনের সব গাড়িই সেই ডিপোতে আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত হয়। পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দাসহ স্থানীয় প্রশাসনের লোকজনও ডিপোর বাইরে জড়ো হয়।
ফায়ার সার্ভিসের বিভাগীয় পরিচালক মো. আনিসুর রহমান উপস্থিত সাংবাদিকদের রাতে বলেন, “আমরা যতটুকু লোকবল ও সরঞ্জাম আছে তার সব নিয়ে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু এখনো আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। কিছুক্ষণ পর পর আগুন লাগছে কন্টেইনারে। সেখানে বিস্ফোরণও হচ্ছে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেমিকেলের কন্টেইনারে আগুন লাগার পর পানি দিলে তা আরও বেড়ে যায়। এতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এসময় আগুন নেভাতে গেলে সীতাকুণ্ড থানা পুলিশের একজনের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।”
বিস্ফোরণের কারণেই আগুন বা বার ছড়িয়ে পড়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক শাহজাহান শিকদার জানান।
বিএম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ আগুন লাগার কারণ সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি। ডিপোর এক কর্মকর্তা জানান, রাতের পালায় তাদের নিজস্ব দু’শর মত কর্মী ডিপোতে কাজ করেন। এরসঙ্গে আরও যুক্ত থাকেন কয়েকশ ট্রাক ও কভার্ডভ্যানের চালক, সহকারী ও শ্রমিক।
প্রায় ২৪ একর জমির ওপর ওই ডিপোটি অবস্থিত। সেখানে কয়েক হাজার কন্টেইনার ছিল। শুরুতে আগুনের মাত্রা কম থাকলেও সময় যত গড়ায়, আগুনের বিস্তার তত বাড়তে থাকে। ডিপোতে থাকা কর্মচারী, ট্রাক চালক, শ্রমিক ও আগুন নেভাতে এগিয়ে আসা স্থানীয়রাও আহত বা দগ্ধ হন।
ডিপোতে যে রাসায়নিকের কন্টেইনার থেকে বিস্ফোরণ হয়, সেটির আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে রাত ১টার দিকে। এসময় ডিপোর ভিতর থেকে বেশ কয়েকটি কাভার্ডভ্যান চালিয়ে বের হয়ে আসেন চালকরা। এসময় ভিতর থেকে আহত অনেককে উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
বিজেএমইএ সহ সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে, তাদের কয়েকটি কাভার্ডভ্যানের চালক ও গাড়ির খোঁজ নেই।
আহতদের ঘটনাস্থল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া আরেক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। প্রশাসনের নির্দেশনায় সীতাকুণ্ডের সব অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি মেডিকেল এলাকায় থাকা সব অ্যাম্বুলেন্সকেও সীতাকুণ্ডে পাঠানো হয়।
এক পর্যায়ে সীতাকুণ্ড থেকে দ্রুত হাসপাতালে পৌছাতে ফৌজদারহাট থেকে বায়েজিদ পর্যন্ত বায়েজিদ লিংক রোডটি শুধু আহতদের বহনকারী যানবাহনের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামের সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী রাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সব চিকিৎসককেও মেডিকেলে গিয়ে সেবায় যোগ দিতে আহ্বান জানান। রাত ৩টা পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক্তার ও নার্সদের হাসপাতালে ছুটে আসতে দেখা যায়।
সেবা কার্যক্রমে যোগ দেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, গাউসিয়া কমিটি, নগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা ও তাদের অনুসারীরা।
সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াস চৌধুরী জানান, বেশিরভাগই অগ্নিকান্ডের সময় ধোঁয়া গলা ও শ্বাসনালীতে গিয়ে অসুস্থ হয়েছেন। তাদের বাহ্যিক আঘাতের পরিমাণ কম। তবে দগ্ধ ও অন্যভাবে আহতরাও আছেন।
পুরনো খবর