পুলিশ বলছে, শিশুটির লাশ ছয় টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে তাদেরই ভাড়াটিয়ার ১৯ বছরের ছেলে।
Published : 25 Nov 2022, 07:04 PM
অন্যদিনের মতোই মসজিদে আরবি পড়তে ঘর থেকে বেরিয়েছিল পাঁচ বছরের শিশু আলিনা ইসলাম আয়াত। গলিতেই খুব পরিচিত একজন তাকে কোলে নেয়, যে কি না মরণ হয়ে শিশুটিকে ডেকেছিল। কেবল শিশুটিই নয়, আশপাশের কেউই ধারণা করতে পারেনি এমন ঘনিষ্ঠ কেউ এতটা বিভৎসভাবে তাকে মেরে ফেলতে পারে।
চট্টগ্রামের নিখোঁজ ওই শিশুর সন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) জেনেছে, ‘মুক্তিপণের’ জন্যই শিশুটিকে অপহরণ করে খুন করেছে তাদের ভাড়াটিয়ার ১৯ বছরের ছেলে আবীর আলী। শিশুটিকে ছয় টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে সে।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক ইলিয়াস খান বলেন, “টানা জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে বৃহস্পতিবার রাতে আবীর যখন খুনের বর্ণনা দিচ্ছিল, সেটা ছিল গা শিউরে ওঠার মত। প্রথমে তার কথা পুলিশও বিশ্বাস করতে পারছিল না।”
আবীর আলীকে নিয়ে শুক্রবার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আলামত উদ্ধার করে পিবিআই। তবে সাগরের পানিতে ‘লাশ ভেসে যাওয়ায়’ শিশুটির মৃতদেহ উদ্ধার করা যায়নি।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, আয়াত ইপিজেড থানার নয়ারহাট ওয়াছমুন্সী বাড়ি এলাকার সোহেল রানার মেয়ে। তাদের বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া থাকে আবীরের পরিবার।
১৪ নভেম্বর আয়াত নিখোঁজ হওয়ার পর তার পরিবারের পক্ষ থেকে ইপিজেড থানায় জিডি করা হয়েছিল। তার সন্ধান চেয়ে পোস্টার ও প্রচারপত্রও বিলি করা হয় এলাকায়। তার দাদা পিবিআইয়ের কাছে আবেদন করেন নাতনির সন্ধান চেয়ে।
“এরপর থেকে আশেপাশের বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ভিডিও বিশ্লেষণ করে আর স্থানীয় শিশুদের সাথে কথা বলে প্রতিবেশী আবীরকে আটক করা হয়। তাকে বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সে আয়াতকে খুন করে লাশ ছয় টুকরো করে সাগরের পানিতে ভাসিয়ে দেওয়ার তথ্য জানায়।”
পুলিশ সুপার জানান, আবীরের পরিবার প্রায় ২১ বছর ধরে নয়ারহাটে আয়াতদের বাসার ভাড়াটিয়া। তার জন্মও ওই বাড়িতে। তবে বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি তার মা আকমল আলী রোড পকেট বাজার এলাকায় আলাদা একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন। তবে বাবা এখনও আয়াতদের বাড়িতেই থাকেন।
“দীর্ঘদিন ওই বাসায় ভাড়াটিয়া থাকায় আয়াতের পরিবারের সবার সাথে সু-সম্পর্ক ছিল আবীরের। সে সুযোগে সে তাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করেছিল। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মূলত ১৪ নভেম্বর বিকালে আয়াতকে কোলে করে তাদের নিচ তলায় বাবার ভাড়া বাসায় নিয়ে যায় আবীর। সেখানেই আয়াতকে খুন করা হয় বলে দাবি করেছে আবীর।”
যেভাবে পুলিশের জালে
পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, আবীরের মা পকেট বাজার এলাকায় আলাদা বাসা নিলেও তার বাবা আয়াতদের বাসার নিচতলায় থাকেন। ওই বাসায় মালামাল থাকায় আবীর বিভিন্ন সময়ে বাসাটিতে যাওয়া আসা করত।
তারা জানায়, ১৪ নভেম্বর বিকাল সোয়া ৩টার দিকে পাশ্ববর্তী মসজিদে আরবি পড়তে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয় আয়াত। ওই সময় আবীর তাকে কোলে নেয়। যেটা ওই এলাকায় খেলাধূলা করা অন্যান্য শিশুরাও দেখেছিল। পাশাপাশি সিসি ক্যামেরায়ও সেটি দেখা গেছে। তবে আয়াতকে আর বের হতে দেখা যায়নি।
পরে পিবিআই তদন্ত করতে নেমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবীরকে আটক করে।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক মর্জিনা আক্তার জানান, “আবীরকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে স্বীকার করে যে বেশ কিছু দিন ধরে সে পরিকল্পনা করেছিল আয়াতকে অপহরণ করে তার পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করার। ওই জন্য রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটি সিমও সে সংগ্রহে রেখেছিল। যাতে ওই নম্বর থেকে ফোন করে টাকা দাবি করতে পারে। কিন্তু সিমটি সচল না থাকায় সে আর ফোন করতে পারেনি বলে দাবি করেছে।
“জিজ্ঞাসাবাদে আবীর জানিয়েছে আয়াতদের নিচ তলায় যে বাসাটিতে তার বাবা থাকেন, সেটির চাবি তার কাছেও ছিল। ১৪ নভেম্বর বিকালে আয়াতকে কোলে নিয়ে তাদের ঘরে ঢুকে অল্প সময়ের মধ্যেই শ্বাসরোধ করে খুন করে।
“খুন করে লাশটি সে তার বাবার একটি পুরনো লুঙ্গি পেঁচিয়ে ব্যাগে করে আকমল আলী রোড পকেট বাজারে তার মার বাসায় নিয়ে বাথরুমের ওপরে মালামাল রাখার শেডে রেখে দেয়। আরেকটি ব্যাগে আগের বাসা থেকে বিছানা পত্র নিয়ে যাওয়ায় তার মা ও বোন বিষয়টি নিয়ে কোনো সন্দেহ করেনি।”
মর্জিনা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে খুনের কথা স্বীকার করলেও আবীর পুলিশকে বিভ্রান্ত করারও চেষ্টা করেছিল। তবে বৃহস্পতিবার রাতেই মূলত সে হত্যাকাণ্ডের আদ্যপান্ত স্বীকার করে আলামত কোথায় আছে তা পুলিশকে জানায়।
‘মা-বোনকে আয়াতদের বাসায় পাঠিয়ে লাশ ছয় টুকরা করে আবীর’
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক ইলিয়াস খান বলেন, “টানা জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে বৃহস্পতিবার রাতে আবীর খুনের বর্ণনা দিতে শুরু করে। ঘটনার সময়, তারিখ জানিয়ে কোন স্থানে, কোন আলামত ফেলা হয়েছে সেগুলোর বর্ণনা দেয় সে।
“পেশাদার অপরাধীর মত করে কীভাবে লাশের আলামত নষ্ট করা যায়, তার সবকিছুই করেছে আবীর।”
ইলিয়াস খান বলেন, “আয়াতের লাশ আকমল আলী রোডে আবীর তার মায়ের বাসায় রেখে পুনরায় আয়াতদের বাসায় চলে আসে। যাতে করে তাকে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। প্রতিবেশী অপরাপর শিশুদের কাছে আয়াতকে আবীর কোলে নেওয়ার কথা শুনে তার (আয়াতের) দাদা আকমল আলী রোডে আবীরদের বাড়িতে নাতনির সন্ধান করতে যায়।
“ওই সময় আবীর তার মা ও বোনকে আয়াতের খোঁজ নিতে তাদের বাসায় পাঠায়। তার মা-বোনও আয়াতের বাসায় গিয়ে তার খোঁজ খবর নিতে শুরু করে।”
আবীর পুলিশকে জানায়, মা-বোনকে আয়াতের বাসায় পাঠিয়ে সে রাতে একটি কাটার ও কিছু পলিথিন কেনেন। কাটার দিয়ে আয়াতকে কেটে টুকরো করার চেষ্টা করেন। না পেরে বাসায় থাকা বটি দিয়ে আয়াতের মৃতদেহ বাথরুমে গিয়ে শরীর থেকে হাত, পা ও মাথা বিচ্ছিন্ন করে পলিথিনে মুড়িয়ে স্কচ টেপ দিয়ে পুনরায় মালামাল রাখার শেডে রেখে দেন। পরদিন সকালে ও রাতে সাগর সংলগ্ন একটি নালায় তিনটি করে ছয়টি প্যাকেট ফেলে দেন।
পরিদর্শক ইলিয়াস বলেন, “আলামত নষ্ট করার জন্য আয়াতকে কেটে টুকরো করেছিল বাথরুমে। পরে যে স্থানে পলিথিনগুলো রাখা হয় সেখানে ট্যালকম পাউডার ছিটিয়ে পারফিউম ব্যবহার করা হয়। যাতে কোনোভাবেই সেখান থেকে দুর্গন্ধ না ছড়ায়।”
ক্রাইম পেট্রোল ও সিআইডি দেখে ‘আলামত নষ্ট করা শিখেছে’ আবীর
পিবিআই সুপার নাঈমা সুলতানা বলেন, আবীর জানায় যে ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ‘ক্রাইম পেট্রোল’ ও ‘সিআইডি’ তার পছন্দের সিরিয়াল। সেসব অনুষ্ঠান থেকেই অপরাধ করার বোধ তার জন্ম নেয়।
“মূলত মুক্তিপণ আদায়, লাশ গুম, আলামত নষ্ট সবকিছুই সেখান থেকে শিখেছে বলে দাবি করেছে আবীর।”
নাঈমা সুলাতানা বলেন, আয়াতকে খুন করে আবীর পুনরায় তাদের বাসায় গিয়েছিল এবং তার পরিবারের সদস্যদের সাথে আয়াতের খোঁজ নিতে বিভিন্ন স্থানে আসা যাওয়া করেছে। যাতে তাকে কেউ সন্দেহ করতে না পারে।
আবীর দাবি করেছে, কোথাও রাখার জায়গা না পেয়ে সে আয়াতকে ঘরে নিয়েই খুন করেছিল। যাতে লাশ গুমের পর তার বাবার কাছে টাকা আদায় করতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে থাকা সিম থেকে কল করতে না পেরে আর মুক্তিপণ দাবি করতে পারেনি।
আবীরকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান ও আলামত সংগ্রহ
পিবিআই পরিদর্শক ইলিয়াস খান বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে যখন আবীর সবকিছু পুলিশকে জানাচ্ছিল এক পর্যায়ে তা বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না। কিন্তু সে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলায়, আশেপাশে সিসি ক্যামেরায় তার গতিবিধিগুলো পর্যবেক্ষণ করে সত্যতা পাওয়া যায়।
“সে যে দোকান থেকে কাটার ক্রয় করেছিল সেখানে গিয়েও তার প্রমাণ মেলে এবং কোন জায়গায় কী রেখেছে সেগুলোর বর্ণনা দিতে থাকে।”
আবীরের দেওয়া তথ্যে শুক্রবার পিবিআই সদস্যরা আকমল আলী রোডে তার মায়ের বাসার সামনে একটি ঝোপ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বটি উদ্ধার করে। বাসার কাছে একটি নালায় আয়াতের পোশাক ও স্কার্ফ ফেলার কথা বলা হলেও সেগুলো খুঁজে পাওয়া যায়নি। পিবিআই কর্মকর্তাদের ধারণা সেগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে।
এছাড়া আয়াতের বাসার পাশে কবরস্থানে তার (আয়াতের) পায়ের স্যান্ডেল ফেলা হয়েছে বলে পুলিশকে জানায় আবীর।
আবীরকে নিয়ে যখন পুলিশ আলামত সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান করছিল তখনও আয়াতের পরিবারের সদস্যরা জানত না তাকে খুন করে লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পিবিআই সদস্যরা আবীরকে নিয়ে আয়াতের বাসার সামনের কবরস্থানে যায়। ওই সময় আয়াতের ব্যবহৃত স্যান্ডেলগুলো দেখিয়ে দেয়। সেগুলো উদ্ধার করে আয়াতের মা ও পরিবারের সদস্যদের দেখানো হলে তারা স্যান্ডেল জোড়া আয়াতের ছিল বলে শনাক্ত করে।
এরপর আবীর পিবিআই কর্মকর্তাদের নিয়ে যায় আকমল আলী সড়কের স্লুইচ গেইট সংলগ্ন নালায় এবং পরবর্তীতে আউটার রিং রোড সংলগ্ন বে-টার্মিনাল এলাকার সমুদ্র পাড়ে। সেখানে কীভাবে লাশের টুকরোগুলো ফেলা হয়েছে তা দেখায় আবীর।
আবীর জানায়, ১৫ নভেম্বর সকালে তিনি বাসা থেকে তিনটি প্যাকেট নিয়ে বের হন। ওই প্যাকেটগুলোতে আয়াতের দুই হাত ও শরীরের অংশ ছিল। সেগুলো বে-টার্মিনাল সংলগ্ন সাগরের পানিতে ফেলে দেন।
সাগরে যখন ভাটা শুরু হচ্ছিল তখনই তিনি প্যাকেট তিনটি ফেলে দেন, যাতে করে সেগুলো সাগরের দিকে চলে যায়। আর ওইদিন রাত ৯টার দিকে দুই পা ও মাথা ভর্তি তিনটি ব্যাগ আকমল আলী সড়কের স্লুইচ গেইট সংলগ্ন নালায় ফেলে দেন।