দুর্গা পূজা শঙ্কাহীন থাকবে, আশায় চট্টগ্রামের পূজারীরা

গুজব ছড়িয়ে জলঘোলা করে কেউ সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে আয়োজকদের এমন আশঙ্কা থাকলেও পুলিশের দাবি, হুমকি নেই, রয়েছে নজরদারি।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2022, 11:40 AM
Updated : 1 Oct 2022, 11:40 AM

গেল বছরের দুর্গা পূজায় দেশব্যাপী যে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়, তার আঁচড় বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও পড়েছিল। বছর ঘুরে আবারও শুরু হয়েছে দুর্গা পূজা। দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে শনিবার থেকে শুরু হওয়া এবারের এ উৎসব শঙ্কাহীন কাটাতে চায় সনাতন ধর্মের অনুসারীরা।

এতে প্রশাসনের ‘ভালো সহযোগিতা’ পাওয়ার কথা জানালেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ‘গুজব’ নিয়ে আয়োজকদের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম পূজা পরিষদের নেতারা এসব শঙ্কার কথা জানালেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, এ বছর তেমন কোনো হুমকির তথ্য নেই। আর সবদিক বিবেচনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে তাদের ভাষ্য।

মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের সাথে বৈঠক হয়েছে। সার্বিক দিক থেকে মনে হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র সক্রিয় আছে।

“আমরা বারবার বলেছি, কেউ যাতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে জলঘোলা করে সম্প্রীতি নষ্ট করতে না পারে। কেউ কোনো কিছু লিখলে সেটার যেন সত্যতা যাচাই-বাছাই করা হয়।”

এদিকে গেল বছরের হামলায় জড়িত সন্দেহে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তারা সবাই জামিনে রয়েছেন; এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সেই আশঙ্কার কথা এর আগে জানিয়েছিল পূজা কমিটি।

আর বৃহস্পতিবার মণ্ডপ পরিদর্শন গিয়ে নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “পূজায় কোনো ধরনের হুমকি নেই। যারা জামিনে আছেন, তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। পুনরায় তারা এ ধরনের কাজ করছে কি না সেটা নিয়েও ফলোআপে রাখা হয়েছে।”

তিনি সেদিন আরও বলেছিলেন, “শৃঙ্খলা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে প্রতিটি মণ্ডপ এলাকায় জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শৃঙ্খলা কমিটি করা হয়েছে। তারা পুলিশের সাথে কাজ করবে। সবার উপস্থিতিতে এ উৎসবকে সার্বজনীন নিরাপত্তায় শেষ করতে চায়।”

কোনো হুমকি বা বিশৃঙ্খলার তথ্য পুলিশের কাছে নেই জানালেও যেকোনো ‘খারাপ পরিস্থিতি’ মোকাবেলারও প্রস্তুতি সিএমপির রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।

এ বিষয়ে নগর পূজা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল সেন উজ্জ্বল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভালো সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি। ৫ অক্টোবর পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকলে আশা করছি ভালো ভাবে পূজা শেষ করতে পারব।

দেশে বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়ে থাকে বলে বিষয়টি নিয়ে শঙ্কার কথাও জানান উজ্জ্বল।

“আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন। অতীতে বিভিন্ন সময়ে আমরা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়েছি। এ বছর যাতে সেটা না হয় আমরা সে বিষয়টি নিয়ে সজাগ থাকার জন্য অনুরোধ করেছি।”

এবারে জেএম সেন হল প্রাঙ্গণসহ নগরীর ১৬টি থানায় ব্যক্তিগত ও সার্বজনীন উদ্যোগে ২৮৩টি পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

‘এখনও তদন্ত শেষ হয়নি ’

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ২০২০ সালের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সীমিত পরিসরে। গেল বছরে সেই পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এ উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতিও ছিল ব্যাপক। কিন্তু কুমিল্লার নানুয়ার দিঘি পাড়ে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগ এনে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক হামলা হয়।

সেসময় বিভিন্ন জেলার মন্দির ও পূজা মণ্ডপে হামলা হয়। তা ঠেকাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও বাঁধে, বিভিন্ন স্থানে প্রাণহানীর মতো ঘটনাও ঘটে।

ওই ঘটনার জেরে বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের আগে চট্টগ্রাম নগরীর জেএম সেন হল মণ্ডপে হামলা হয়।

সেদিন ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজের পর মিছিল করে জেএম সেন হল মণ্ডপে হামলা এবং গেইট ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা চালানো হয়। পরে পুলিশ ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের সেল নিক্ষেপ করে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে।

ওই হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে কোতোয়ালী থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে। সেখানে ৮৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও কয়েকশ আসামি করা হয়।

সেই হামলায় ভিপি নূরের নেতৃত্বাধীন ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদের নেতারা নেতৃত্বে ছিল বলে অভিযোগও ওঠে। গ্রেপ্তার হয় সংগঠনটির চট্টগ্রামের শীর্ষ কয়েক নেতা। তবে মামলাটির এখনও অভিযোগপত্র জমা দেয়নি পুলিশ।

পূজা কমিটির সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা পুলিশকে অনুরোধ করেছি অভিযোগপত্রটি দ্রুত আদালতে জমা দেওয়ার। পুলিশও আশ্বাস দিয়েছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়ও দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।

জেএম সেন হলের হামলার ঘটনায় ১০২ জনের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানা নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালী জোন) মুজাহিদুল ইসলাম।

তিনি বলেন, এজাহারের ৮৪ জনের বাইরেও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও তদন্তের মাধ্যমে আরও ১৪ জনের নাম জানা গেছে। তারা গ্রেপ্তারও হয়েছিল।

“এটি একটি স্পর্শকাতর ঘটনার মামলা। আমরা পুঙ্খনাপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে মামলার তদন্ত করছি, যাতে নিরাপরাধ কেউ এর সাথে জড়িয়ে না যায়।”

এদিকে সম্প্রতি এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পান কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আতিকুর রহমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “১০দিন আগে মামলার ডেকেট বুঝে নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিতে পারব।

“ঘটনার পরপর পাওয়া বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণ যাচাই-বাছাই চলছে; যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি এ মামলায় জড়িয়ে না যায়, আবার অপরাধ করে কেউ পার পেয়ে না যায়।

“১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) ধারায় মামলাটির অভিযোগপত্র প্রস্তুত হচ্ছে।”

মামালার প্রধান অভিযুক্ত ইমরান মাজেদ রাহুল। টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক এক নেতার আত্মীয় ইমরানকে গত বছর গ্রেপ্তারের পরপরই পুলিশ জানিয়েছিল তিনি (ইমরান) টেরিবাজার, খলিফাপট্টি, ঘাটফরহাদবেগসহ বিভিন্ন এলাকার দোকানের কর্মচারীসহ স্থানীয় অনেককেই মিছিলে জড়ো করেছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে… অভিযোগপত্রে ১০২ জনের বিষয়টি তুলে আনার চেষ্টা করছি। তবে তাদের অনেকেই গ্রেপ্তারের পর নাম-ঠিকানা ‘ভুল’ জানিয়েছিল। সে বিষয়গুলো যাতে সঠিকভাবে আদালতে উপস্থাপন করা যায় সেজন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।”

এদিকে মামলার সাক্ষ্য না পাওয়া যাচ্ছে না বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার ভাষ্য।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সাক্ষি না পাওয়াটা মামলার অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

“অনেকেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। কিন্তু কেউ আদালতে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। অভিযোগপত্র দিতে হলে সাক্ষির প্রয়োজন। কিন্তু সাক্ষি যদি হাজির করা না যায় তাহলেতো অনেকেই পার পেয়ে যাবেন।”

আরও খবর

Also Read: চট্টগ্রামে মণ্ডপে হামলা: যুব অধিকার পরিষদের এক নেতার ‘স্বীকারোক্তি’

Also Read: চট্টগ্রামে মণ্ডপে হামলার পেছনে নূরের সংগঠনের তিন নেতা: পুলিশ

Also Read: চট্টগ্রামে পূজামণ্ডপে হামলা: ৮৩ জন শনাক্ত, মামলা

Also Read: মণ্ডপে হামলার আসামি জামিনে, চট্টগ্রাম পূজা পরিষদের শঙ্কা