Published : 24 Aug 2023, 09:18 PM
দুই বছর আগে জলাবদ্ধ চট্টগ্রামে খালে পড়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন সবজি ব্যবসায়ী সালেহ আহমদ। যাদের গাফিলতিতে বাবাকে হারাতে হল, তার বিচার এখনও পাননি সাদেকুল্লাহ মহিম। কবর দিতে বাবার লাশটিও পাননি, সেই বেদনা নিয়েই চলছেন এই যুবক, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সংসারের ভার। অসহায় মহিম চাইছেন প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি।
বাবাকে হারানোর দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগের দিন বৃহস্পতিবার বিকালে নগরীর মুরাদপুরে সালেহ আহমদের খালে পড়ে যাওয়ার স্থানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মহিম।
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থা হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে আমাদের জীবন থেকে চিরতরে বাবা শব্দটা মুছে গেছে।
“তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাস্থলের ওই খালে কোনো নিরাপত্তা দেয়াল থাকলে কিংবা জলাবদ্ধতা না হলে দুর্ঘটনার কোনো প্রশ্নই আসে না। খালে ময়লা-আবর্জনা না থাকলে বাবার লাশটা অন্তত ফিরে পেতাম।”
২০২১ সালের ২৫ অগাস্ট জলাবদ্ধতার মধ্যে নগরীর মুরাদপুর মোড়ে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চশমা খালে পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হন ৫৫ বছর বয়সী সালেহ আহমেদ। বর্জ্যে ভরা ওই খালে ও আশেপাশের কয়েকটি খালে টানা কয়েকদিন অভিযান চালিয়েও তার হদিস মেলেনি।
সালেহ চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কুসুমপুরা ইউনিয়নের মনসা এলাকার বাসিন্দা। তিনি নগরীর চকবাজারে সবজি বিক্রি করতেন। তাতেই চলত স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার।
নালায় পড়া বৃদ্ধের সন্ধান মেলেনি দুই দিনেও
মহিম বলেন, “ঘটনার পর আপনারা দেখেছেন, সিটি করপোরেশন বা সিডিএ কেউ দায় নেয়নি। একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়েছে।”
সৌদি আরবে দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন কাটিয়ে বছর কয়েক আগে নগরীর চকবাজারে একটি ছোট দোকানে সবজির ব্যবসা শুরু করেছিলেন সালেহ।
মহিম বলেন, “বাবাই ছিলেন আমাদের পুরো পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। তিনিই পরিবারের সব ব্যয় নির্বাহ করতেন। নিজে কষ্ট করলেও আমাদের কখনও কষ্ট পেতে দেননি। অভাব বুঝতে দেননি।”
সালেহ নিখোঁজ হওয়ার পর মাস দেড়েক পর তার ছেলে সাদেকুল্লাহ মহিমকে চাকরি দিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। নগর সংস্থার ওয়ার্কশপে সহকারী পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
তখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র মহিমকে সিটি করপোরেশনের পাম্পে গাড়িতে গ্যাস দেওয়ার কাজ করতে হত দিনে প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা। দুই মাস বাদেই সেই চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।
সেই পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে মহিম বৃহস্পতিবার বলেন, “ওই সময় আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ছিল সামনে। লেখাপড়ায় মনোযোগ না দিয়ে পাম্পে ১২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কাজ করা সম্ভব ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে চাকরিটি ছাড়তে হয়েছে।
“মেয়র মহোদয়কে কয়েকবার অনুরোধ করেছি যেন চাকরিটা পরিবর্তন করে দেন। সিটি করপোরেশনের কোনো অফিসে পিয়ন হিসেবে দেওয়া যেত আমাকে। কিন্তু উনি বললেন- এই চাকরিই করতে হবে।”
ওই চাকরি ছাড়ার পর আর কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি জানিয়ে মহিম বলেন, “এক বছর পর আমরা উচ্চ আদালতে ক্ষতিপূরণের জন্য রিট করি। ঘটনার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তদন্ত করে সিটি করপোরেশন ও সিডিএকে দায়ী করে প্রতিবেদন দিয়েছিল।
“সেটা আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আদালত আমাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য চার সপ্তাহের রুল জারি করেছিলেন।”
এরপর তার আর কোনো অগ্রগতির খবর পাননি তিনি।
মহিম বলেন, “আমার সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, বাবার কবর জিয়ারত করার সুযোগও আমার নেই। কোথায় গেলে বাবার কবরটা অন্তত পাব? একটু দোয়া করতে পারব?
“আপনাদের মাধ্যমে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। উনি পিতৃহারা কোনো সন্তানের আবেদন ফেলবেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি ও আমার ছোটবোন দুজনই শিক্ষার্থী। আমরা পড়াশোনা করতে চাই। আমাদের পড়াশোনার সুযোগ দিন।”
প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার আরেকটি আরজি- “যাদের কারণে আমরা বাবার আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি, আপনি তাদের বিচার করুন। তাদের অবহেলার কারণে লাখ লাখ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। তাদের কারণে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আপনি দয়া করে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনুন।”
মহিম বর্তমানে স্নাতক (পাস) শ্রেণির ছাত্র এবং তার বোন একাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন। মহিম জানান, মামারা ও আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় চলছে তাদের তিন সদস্যের পরিবার ও ভাই-বোনের লেখাপড়া।
মহিমের মামা গিয়াস উদ্দিন বলেন, “একজন মানুষ এভাবে হারিয়ে গেল, কারও যেন কোনো দায় নেই! এই পরিবারটা কিভাবে চলে- এতদিনেও কেউ খবর নিল না। দুটো ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, সংসার – কিভাবে চলছে?
“মানবিক আবেদন, মহিমকে একটি চাকরি দেওয়া হোক, যাতে সে লেখাপড়াটা চালিয়ে নিতে পারে; সাথে মা-বোনকে দেখতে পারে।”