চট্টগ্রামে নালায় পড়ে মৃত্যু: দায় কার?

সবজি ব্যবসায়ী সালেহ আহমদের পর চট্টগ্রাম নগরীতে নালায় পড়ে সেহেরীন মাহবুব সাদিয়ার মৃত্যুতেও দায় নিতে চাইছে না সিটি করপোরেশন কিংবা সিডিএ।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Sept 2021, 02:43 PM
Updated : 28 Sept 2021, 02:43 PM

সরকারি দুটি সংস্থাই একে অন্যকে দোষ দিচ্ছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বলছে, দুদিকে ফুটপাত করলেও খালের মুখটি অরক্ষিত রেখেছে সিডিএ। তাই এর দায় সিডিএর।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ বলছে, খালের মালিকানা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। তাই খালের মুখে সুরক্ষা নিশ্চিতের দায়িত্বও তাদের।

নালা-খালে একের পর এক মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ নগরবাসী। তারা বলছেন, দায় এড়ানোর এই প্রবণতা প্রমাণ করে সেবা সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবর্তে নগরবাসীর ‘মৃত্যুফাঁদে’ পরিণত হয়েছে।

গত ২৫ অগাস্ট মুরাদপুর এলাকায় খালে পড়ে তলিয়ে যান সালেহ আহমদ। তার খোঁজ আর মেলেনি। তার আগে গত ৩০ জুন ষোলশহর চশমা হিল এলাকাতেও এমন দুর্ঘটনায় মারা যান দুজন।

সবশেষ সোমবার রাতে আগ্রাবাদে নবী টাওয়ারের কাছাকাছি নাছিরছড়া খালে পড়ে তলিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাদিয়া। পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় কয়েক টন আবর্জনার স্তূপ সরিয়ে ১৯ বছর বয়সী সাদিয়ার লাশ উদ্ধার হয়।

সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া।

সোমবার রাতে যেখানে সাদিয়া পড়ে যান, শেখ মুজিব সড়ক সংলগ্ন সেই খালের মুখটি ছিল খোলা। দু’পাশে ৬ ফুট চওড়া ফুটপাত থাকলেও খালের মুখে তা মাত্র আড়াই ফুট চওড়া।

সরু সেই অংশের উপর দিয়ে হেঁটে পেরোনোর সময় পড়ে যান সাদিয়া। আবর্জনায় ভরা সেই খালের মুখ থেকে সাদিয়া পানির টানে চলে যান শেখ মুজিবের সড়কের নিচে। সেই সড়কের নিচে বক্স কালভার্ট। কালভার্টের স্ল্যাব ভাঙার পর সাদিয়ার সন্ধান মেলে।

শেখ মুজিব সড়কের উপর দিয়ে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ চলছে। নিচের সড়কটি প্রশস্ত করছে সিডিএ। সেই কাজের অংশ হিসেবে রাস্তা চওড়া করার পর পাশে নতুন করে নালা করা হয়।

এর আগে সালেহ আহমেদ নিখোঁজ হওয়ার পর সিডিএ ও সিটি করপোরেশন একে অন্যের দিকে অভিযোগের তীর ছুড়েছিল। এবারই একই চিত্র।

কালভার্টের নিচে আবর্জনার স্তূপ থেকে বের করা হয় সেহেরীন মাহবুব সাদিয়ার লাশ।

সিটি কর্পোরেশনের ভাষ্য

মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থলে যান চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি দৃশ্যত সিডিএর উপর দায় চাপান।

রেজাউল বলেন, “ওখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের যে নালাটা ছিল সেখানে, নালার পাশে রেলিং ছিল। সেগুলো এখন নেই। বৃষ্টি পড়ায় ফুটপাতের ‍উপর কাদা জমে গেছে। যেটুকু খবর পেয়েছি কাদায় স্লিপ করে মেয়েটি পড়ে গেছে।

“এখানে যারা প্রকল্পের কাজ করছে, তাদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। একটা বাঁশ দিয়ে যদি লাল ফ্ল্যাগ দেওয়া হত, তবু মানুষ জানতে পারত। মনে করি, কিছুটা অবহেলা আছে, অবশ্যই যারা কাজ করছে তাদের।”

সিটি করপোরেশনের কোনো দায় আছে কি না- প্রশ্ন করা হলে রেজাউল বলেন, “এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দেওয়ানহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত যে কাজ চলছে, তা সিডিএর আওতায়। এখানে সড়ক সংস্কার থেকে পরিষ্কার রাখা সব তাদের। অনেক গর্ত হয়েছে। কয়েকদিন আগেও সিডিএ চেয়ারম্যানকে ফোন করেছি। উনারা মেরামতের কিছু কাজ করেছে। তাদের অবহেলা ও অসতর্কতার জন্য এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।”

সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী বলেন, “মাসখানেক আগে কাজ করতে গিয়ে সিডিএ ওখানকার নালার স্ল্যাব কেটে আড়াই ফুট করে ফেলে। তারা কাজ করলেও খালের মুখে রেলিং আর দেয়নি। সকালে গিয়ে আমরা ঘিরে দিয়েছি।”

সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া পড়ে গিয়েছিলেন এই স্থান দিয়ে।

সিডিএ কী বলছে

সিডিএর এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা ওদের (সিসিসি) খাল। খালটা অনেক আগে থেকেই ওপেন ছিল। সেটা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। তারা যদি খালের উপর স্ল্যাব না দেয় আমরা কী করব?

“খাল যদি কাভার করে দিই, এটা পরিষ্কার করা যাবে? ঘটনা যেখানে সেখানে কি ফ্লাইওভারের কাজ হচ্ছে? সেখানে কি পিলার বা গার্ডার পড়েছে? আমরা যেখানে ড্রেন করেছি, সেখানে স্ল্যাব বসিয়েছি। খালের উপরে স্ল্যাব সিটি করপোরেশন করবে। তাহলে দোষ কার?”

“মেয়র মহোদয় যে বলেছেন, সিডিএর কারণে হয়েছে। তা সঠিক নয়। এখানে সিডিএর কোনো দোষ নেই,” বলেন সিডিএ প্রকৌশলী।

সেহেরীন মাহবুব সাদিয়ার পড়ে যাওয়ার পর এখন নালার মুখ ঘিরে দেওয়া হয়েছে।

সরু পথ কাদামাখা আর অন্ধকার

সোমবার সাদিয়া খালে পড়ে যাওয়ার পর আশেপাশের লোকজন ছুটে আসে তাকে উদ্ধারে।

তাদের একজন আবুল কালম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত দুই সপ্তাহে হেঁটে যাওয়ার সময় কয়েকজন ওই খালে পড়ে গেছে। এলাকার লোকজন ধরে তাদের তুলেছে। খাল পুরা ময়লায় ভরা থাকে।

“রাস্তার পাশে নালা করা হয়েছে কয়েক মাস আগে। কিন্তু এই অংশটা একদম সরু। এখান দিয়ে হেঁটে যাওয়া বিপজ্জনক। কিন্তু নিচেও রাস্তা কাদায় ভরা। মানুষ হাঁটবে কোথায়?”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক চশমা দোকানের কর্মচারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জায়গাটাতে কোনো সড়কবাতি নেই। কাল মেয়েটা পড়ে যাবার পর অন্ধকারে তাকে খুঁজতে হয়েছে। অন্ধকারে কিছু দেখাও যায় না। যাদের দায়িত্ব তাদের প্রত্যেকের শাস্তি হওয়া উচিৎ। নালা কার, খাল কার এসব আমরা জানি না।”

একে অন্যকে দোষারোপের এই প্রবণতা আর কত- বিক্ষোভে প্রশ্ন চট্টগ্রাম নগরবাসীর।

আবর্জনায় ভরা খাল

ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক শামীম হাসান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সাদিয়া যেখানে পড়ে যান, সেটি ১৫ ফুট গভীর ও প্রচুর আবর্জনায় ভরা ছিল। প্রায় তিন-চার টন আবর্জনার স্তূপ সরিয়ে তাকে উদ্ধার করা হয়।

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে সিটি মেয়রকে নগরীতে এধরনের বিপজ্জনক স্থানগুলো ফিতা দিয়ে চিহ্নিত করে দিতে অনুরোধ করা হয়েছে।

সিসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, “খালটি শেখ মুজিব সড়কের নিচের বক্স কালভার্টের সাথে যুক্ত। ওই বক্স কালভার্ট দীর্ঘদিন পরিষ্কার করা হয়নি। সেখানে স্কেভেটর ঢোকে না। পানির তোড়ে সব আবর্জনা গিয়ে খালের মুখটাতে জমে থাকে।”

সাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় দোষীদের বিচার দাবিতে মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে মানববন্ধন চলাকালে এক শিক্ষার্থী এন মোহাম্মদ নাদিম বলেন, “খালে পড়লে কীভাবে মানুষ মরে? কারণ খাল পরিষ্কার ছিল না, উপরে ঢাকনা ছিল না। সিডিএ-সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব ছিল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।”

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকতার কবীর চৌধুরী বলেন, “একে অন্যকে দোষারোপের এই প্রবণতা আর কত। ক্ষতিগ্রস্তদের উচিত দুই পক্ষকেই আসামি করে মামলা করা। এরপর তাদের বোধোদয় হবে। নালা-খাল খোলা থাকবে, ম্যানহোলে ঢাকনা থাকবে না। আর তাতে পড়ে মানুষ মারা যাবে এটা তামাশা নাকি?”

খালে আবর্জনা দায়ও সিডিএর উপর চাপিয়ে মেয়র রেজাউল বলেন, “যেহেতু কাজ চলছে, কাজের সমস্ত ময়লা সেখানে গিয়ে পড়ছে। পাশে যে ফেন্সিং ছিল তা থাকলে দুর্ঘটনা ঘটত না। রেলিং ছিল এবং বড় স্ল্যাব ছিল। এগুলো সব কাজ করতে গিয়ে নষ্ট করা হয়েছে।”

আরও পড়ুন