“ক্যাম্প-৩ এর উপরে খাড়া ঢালগুলো দুঃস্বপ্নের মত ছিল;আর একটানা ১৭০০ মিটার আরোহণ কোনো মজার বিষয় ছিল না,” বলেন তিনি।
Published : 11 Apr 2025, 12:55 PM
তুষার ধস ও ঝড়ের মধ্যে যেমন পড়েছেন, তেমনই যাত্রাপথে বাধার মুখে সহযাত্রীদের পিছুটানও দেখেছেন। সব মিলিয়ে অন্নপূর্ণা-১ চূড়ায় পৌঁছানোর লড়াইটি এভারেস্ট চূড়ায় ওঠার চেয়েও কঠিন ঠেকছিল বাবর আলীর কাছে।
আগেই ধারণা ছিল, নেপালের এই রূপসী কন্যাকে জয় করা বেশ কঠিন। কিন্তু অন্নপূর্ণা এতটা পরীক্ষা নেবে সেটা ভাবেননি বাবর আলী। ধারণার চেয়ে কঠিন এই লড়াইয়েও জয়ী হয়েছেন বাংলাদেশের এই পবর্তারোহী।
এভারেস্ট ও লোৎসের পর এবার আরোহণ করেছেন অন্নপূর্ণা-১ এ। বাবরই প্রথম কোনো বাংলাদেশি, যিনি ওই পবর্তে আরোহণের নজির গড়লেন। এ নিয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ ১০টি পবর্তের মধ্যে তিনটির চূড়া স্পর্শ হয়েছে তার।
কঠিন ঝুঁকির যাত্রা শেষে ফেরার পথে বাবর নেপালের পোখরা থেকে ফোনে কথা বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে। তুলে ধরেছেন অন্নপূর্ণা-১ এর যাত্রাপথ।
বৃহস্পতিবার রাতে যখন বাবর আলীর সাথে কথা হচ্ছিল, তখন তার কণ্ঠের উচ্ছ্বাসই বলে দিচ্ছিল কতটা খুশি তিনি।
উত্তর-মধ্য নেপালের পোখরা শহরের উত্তরে কালী গণ্ডকি ও মার্সেয়ান্দি নদীর উপত্যকায় প্রায় ৩০ মাইল দীর্ঘ এক শৈলশিরার নাম অন্নপূর্ণা।
এই পর্বত প্রাচীর ছয়টি পর্বতের এক অনন্য সম্মেলন। যেন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে সব বিরাটকার পর্বত। এর চারটি প্রধান শৃঙ্গ হলো অন্নপূর্ণা- ১,২ ৩ ও ৪। সাথে আছে আরো দুটি অনন্য পর্বত অন্নপূর্ণা সাউথ ও গঙ্গাপূর্ণা। এরমধ্যে অন্নপূর্ণা-১ সবাইকে ছাড়িয়ে একটু বেশি উঁচু। বাকি পাঁচটিও ৭ হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার।
অন্নপূর্ণা-২ ৭৯৩৭ মিটার, অন্নপূর্ণা-৩ ৭৫৫৫ মিটার ও অন্নপূর্ণা-৪ এর উচ্চতা ৭৫২৫ মিটার। গঙ্গাপূর্ণা ৭৪৫৫ মিটার এবং অন্নপূর্ণা সাউথ ৭২১৯ মিটার উচ্চতার।
এই পর্বতশ্রেণির সর্ব পশ্চিমের অন্নপূর্ণা-১ এর উচ্চতাই সবার চেয়ে বেশি; ৮ হাজার ৯১ মিটার (২৬ হাজার ৫৪৫ ফুট)।
অন্নপূর্ণা-১ অভিযানের জন্য বাবর আলী বাংলাদেশ থেকে নেপালে যান ২৪ মার্চ। অন্য প্রস্তুতি শেষ করে ২৬ মার্চ কাঠমান্ডু থেকে বিমানে উড়ে যান পোখরা। এরপর কিছু পথ গাড়িতে ও বাকি পথ পায়ে হেঁটে ২৮ মার্চ পৌঁছে যান বেসক্যাম্পে।
একদিন বিশ্রাম নিয়েই পরদিন চড়তে শুরু করেন উচ্চতার সাথে মানিয়ে নিতে। ক্যাম্প-১ (৫২০০ মিটার) এ দুই রাত এবং ক্যাম্প-২ (৫৭০০ মিটার) এ এক রাত কাটিয়ে ২ এপ্রিল বাবর নেমে আসেন বেসক্যাম্পে।
কথা ছিল, এরপর অনুকূল আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবেন আর কিছুটা বিশ্রামও নেওয়া হবে চূড়ান্ত লড়াইয়ের আগে।
বাবর আলী বলেন, “কিন্তু নেমে আসার পরই জানতে পারলাম, ওয়েদার ফোরকাস্ট অনুসারে অনুকূল আবহাওয়া থাকবে ৩ এপ্রিল থেকে ৬ এপ্রিল। তাই ২৪ ঘন্টা বিশ্রাম নিয়েই যাত্রা শুরু করি।”
৩ এপ্রিল রওনা করে বাবর ক্যাম্প-২ তে পৌঁছে যান পরদিন। ৪ এপ্রিল বিকাল থেকে শুরু হয় তুষার ঝড়। এরমধ্যেই ৫ এপ্রিল তিনি গিয়ে পৌঁছান ক্যাম্প-৩ তে (৬৪০০ মিটার উচ্চতায়)।
তুষার ঝড়ের পরিস্থিতি বর্ণনা করে বাবর আলী বলেন, “ক্রমাগত তুষার পড়ছিল। অনেকটা টানা বৃষ্টির মত। কিন্তু থামারও কোনো উপায় নেই। এমনকি দু’পাশের ঢাল থেকে পাথরও পড়ে। যত দ্রুত ওই এলাকা পাড় হওয়া যায়। তাই গতি কমানোরও কোনো উপায় ছিল না।
“যদি ঝড় থামার অপেক্ষা করি- তখন সূর্য উঠলে বরফ গলে গলে বড় টুকরো ঝরে পড়বে। তাই তুষার ঝড়ের ভেতরেই ঝুঁকি নিয়ে ওই পথ পেরোতে হয়।”
তার সঙ্গে থাকা এস্তোনিয়ার নাগরিক আরেক পরর্তারোহী ওই তুষার ঝড়ে পড়ে বলে জানান বাবর।
সাধারণত অন্নপূর্ণা-১ এর ৭৪০০ মিটার উচ্চতার ক্যাম্প-৪ থেকে সামিট পুশ শুরু করেন আরোহীরা। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় আরো নিচ থেকে অর্থাৎ ক্যাম্প-৩ থেকেই সামিট পুশ শুরুর সিন্ধান্ত নেন তিনি।
বাবর আলী বলেন, “এর মানে হলো আরো অনেকটা বেশি পথ টানা উঠতে হবে। একটানা প্রায় ১৭০০ মিটার পথ।”
চূড়া পর্যন্ত পথ তৈরি এবং আবহাওয়ার উন্নতির জন্য ক্যাম্প-৩ এ অতিরিক্ত একদিন অপেক্ষা করে ৬ এপ্রিল বিকালে রওনা হন বাবর।
বাবর আলী বলেন, “৬ এপ্রিল বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে ক্যাম্প-৩ থেকে যাত্রা শুরু করি। ৭ এপ্রিল সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে পৌঁছাই অন্নপূর্ণা-১ এর চূড়ায়। ”
কতক্ষণ ছিলেন চূড়ায়? কেমন ছিল সেই মুহূর্তের অনুভূতি?
বাবর বললেন, “তখন আবহাওয়া মোটামুটি ভালো ছিল। চূড়ায় ছিলাম ১০ মিনিটের মত। আমার সাথে ছিলেন গাইড পূর্বা অংগেল শেরপা। পিকটা এমন সেখানে একসাথে দু’জন দাঁড়ানোও বেশ কঠিন।”
বাবর যেদিন অন্নপূর্ণা-১ চূড়ায় প্রথমবারের মত বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান সেদিন আরো কয়েকজন পর্বতারোহী ওই চূড়ায় পৌঁছান। তবে বাবরের অভিযান দলে যে দু’জন এস্তোনিয়ান ও একজন হাঙ্গেরিয়ান পর্বতারোহী ছিলেন, তারা সামিট শেষ করতে পারেননি।
“সহযাত্রীদের ফিরে যেতে দেখা সহজ নয়, এতে অজান্তেই হয়ত মনের উপর চাপ পড়ে, বলছিলেন বাবর।
চূড়ায় পৌঁছার অনুভূতি ‘অন্যরকম’ মন্তব্য করে বাবর আলী বলেন, “এটা টেকনিক্যালি এভারেস্টের চেয়ও কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং সামিট। আমি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আরোহণ করেছি, সেটা বলতে চাই না।
“এরপরও বাংলাদেশ থেকে যারাই অন্নপূর্ণা-১ আরোহণ করবেন, সেটা অনন্য হয়েই থাকবে।”
দুর্গম এই যাত্রা পথের পুরোটা শেষ করতে পারা আসলেই কঠিন। পরিসংখ্যানও সেই কথাই জানাচ্ছে।
বিশ্বের দশম শীর্ষ পর্বত হলেও আরোহণের সময় প্রাণঘাতি হওয়ার তালিকার এর অবস্থান শীর্ষে।
সেই কথাই বৃহস্পতিবার রাতে নিজের ফেসবুক পোস্টে জানিয়ে বাবর আলী লেখেন, “এক আশ্চর্যজনক অভিযানের পর পোখরায় পৌঁছেছি। অন্নপূর্ণা-১ আমার সমস্ত প্রাণশক্তি ও ইচ্ছাশক্তির পরীক্ষা নিয়েছে। জানতাম এটা কঠিন হবে। কিন্তু কখনও ভাবিনি অন্নপূর্ণা-১ আমার এবং তার ঢালে থাকা সবার এভাবে পরীক্ষা নেবে!
“ক্যাম্প-২ থেকে ক্যাম্প-৩ এর মধ্যকার বিশাল করিডরটি সবার নিঃশ্বাস কেড়ে নিল যেন। ক্যাম্প-৩ এর উপরে খাড়া ঢালগুলো দুঃস্বপ্নের মত ছিল। আর একটানা ১৭০০ মিটার আরোহণ কোনো মজার বিষয় ছিল না।”
বাবর আলী লেখেন, “চূড়ায় পৌঁছাতে ১৭ ঘণ্টা লেগেছিল। আর পুরো যাত্রা প্রায় ২৬ ঘণ্টার, যা আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম।”
কেবল চূড়ায় আরোহণ নয়, ফেরাও সহজ ছিল না বাবর আলীর জন্য। ৭ এপ্রিলই তিনি নামতে শুরু করেন। সেদিন নেমে আসেন ক্যাম্প-২ পর্যন্ত।
বাবর আলী বলে, “ফিরে আসার সময় পায়ে আঘাত পাই। আমার দৃষ্টিসীমাতেই আরেকজন আরোহী তুষার ঝড়ের কবলে পড়েন। ”
এতসব বাধা পেরিয়েও নিরাপদে ফিরেছেন বাবর। অন্নপূর্ণা শিখর ছুঁয়ে ফিরে আসাটা কেন বিশেষ?
দশম সর্বোচ্চ পর্বত হলেও অন্নপূর্ণা-১ চূড়ায় প্রথম মানুষের পা পড়েছে ১৯৫০ সালের ৩ জুন; ফ্রান্সের মরিস হেরজগ ও লুইস লেচেনাল এই পর্বত চূড়া প্রথম স্পর্শ করেন, যা আট হাজার মিটার বেশি উচ্চতার কোনো পর্বতে মানুষের প্রথম সফল অভিযানও।
অন্নপূর্ণা-১ এ সফল সামিটের বিপরীতে মৃত্যুর হার প্রায় ১৪ শতাংশ, যা ২০১২ সাল পর্যন্ত ছিল ৩২ শতাংশ। গত মৌসুম পর্যন্ত এই পর্বত সামিট করেছেন ৫১৪ জন, যাদের মধ্যে ৭৩ জন মারা গেছেন।
অন্নপূর্ণা-১ জয়ের পর বাবর আলীর পরবর্তী লক্ষ্য আরেক আট হাজারি পর্বত, মানাসলু। নেপালের এই পর্বতটি বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সেই যাত্রা করতে চান বাবর।
কিন্তু এর মাঝে জীবনের অন্য কোন যাত্রারও কি ইঙ্গিত দিলেন বাবর? ফেইসবুক পোস্টের শেষ বাক্যে লিখেছেন, “ইতোমধ্যে অনেকে জানতে চেয়েছেন, এরপর কী? আমার উত্তর হল, নারী-পুরুষের জীবনে আরো কিছু অন্নপূর্ণা আছে।”
তবে কি জীবনের পথেও নতুন কোন অ্যাডভেঞ্চার যোগ করতে চান বাবর? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষায় রেখেছেন তিনি।