১৯৭১ সালে কালরাতের আগেই প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামে; বাঙালি নিধনে করাচি থেকে আসা ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস ঠেকায় ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা।
Published : 24 Mar 2022, 09:44 PM
২৪ মার্চ শুরু হওয়া সেই প্রতিরোধ চলে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত। যদিও পরদিন অস্ত্র খালাসে সক্ষম হয় পাকিস্তানি বাহিনী, আর খালাস কাজে বাধ্য হওয়া বাঙালি সৈন্যদেরও হত্যা করা হয়।
সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে সবমিলিয়ে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারালেও নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন।
“২৪ মার্চ বিকালে নিউমুরিং কলোনির মাঠে আমরা সভা করি। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে যাই সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাস ঠেকাতে। রাতে জনতার উপর গুলি চালানো হয়। অনেকে শহীদ হয়। আমরা অস্ত্র খালাস ঠেকিয়ে দিই।”
সেই প্রতিরোধের অন্যতম সংগঠক বর্ষীয়ান রাজনীতিক, প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা আহসানউল্লাহ চৌধুরী ৫১ বছর আগের সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেন এভাবেই।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে ভোটের পর বাঙালিদের ক্ষমতা না দিয়ে উল্টো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা চিরতরে দমনের লক্ষ্যে পাকিস্তানিরা তলে তলে যে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিল, তার নজির সোয়াতে করে অস্ত্র পাঠানো।
৯২২৩ টন ওজনের ৪৭০ ফুট দীর্ঘ সোয়াত জাহাজে চেপে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র আনা হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসেই। সেই খবর কীভাবে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, প্রতিরোধই বা কীভাবে গড়ে ওঠে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সোয়াত নামের জাহাজটি করাচি বন্দর থেকে অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসে ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকালে।
“মার্চের শুরুতে বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা বাইরে আওয়ামী লীগ নেতাদের এ খবর পৌঁছে দেন। আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান, আবদুল্লাহ আল হারুন, সিরাজুল হক মিয়া, এম এ মান্নান, আতাউর রহমান খানসহ নেতারা সম্মিলিতভাবে অস্ত্র খালাস ঠেকানোর সিদ্ধান্ত নেন।”
সব ষড়যন্ত্র আঁচ করে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
শামসুল হক জানান, পরে জাহাজটি বন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে ভেড়ানো হয়। ১৮ মার্চ অস্ত্র খালাসের চেষ্টা হলে বন্দরে শ্রমিক-কর্মচারীরা তাতে অস্বীকৃতি জানান।
চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক কর্মচারী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম রইসুল হক বাহার সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধ ও চট্টগ্রাম বন্দর’ এবং দৈনিক আজাদীর ৩৫তম বর্ষপূর্তিতে প্রকাশিত ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ বইতে সেদিনের ঘটনার পূর্বাপর বর্ণনা আছে।
সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাস প্রতিরোধে অংশগ্রহণকারী প্রয়াত আ ক ম রইসুল হক বাহার জীবদ্দশায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন।
বাহারের কথায়, “২৪ মার্চ বিকালে বন্দরের নিউমুরিং কলোনির মাঠে সমাবেশ আহ্বান করা হয়। আমাদের দায়িত্ব ছিল মাইক লাগানো ও বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে চেয়ার-টেবিল এনে মঞ্চ সাজানো। মাইক আনা হয় এজাহার মিয়ার কাছ থেকে। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম কলেজ শাখার নেতা শামসুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে আমরা এসব কাজ করেছিলাম।”
বিকাল ৪টায় শুরু হওয়া সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ নেতা বাদশা মিয়া। বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ও স্থানীয় এম এ মজিদ মিয়া (এম এ আজিজের ভাই)। এম এ হান্নান সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধের ঘোষণা দেন সভায়।
‘মুক্তিযুদ্ধ ও চট্টগ্রাম বন্দর’ বইতে ‘সোয়াত জাহাজ অবরোধ’ শীর্ষক নিবন্ধের বর্ণনা অনুযায়ী, “সভায় বিপুল সমাবেশ হয়। সভা চলাকালে চিটাগাং স্টিল মিল থেকে একটি মিছিল আসে। চার-পাঁচ হাজার লোকের মিছিলে প্রত্যেকের হাতে ছিল ৮/১০ ইঞ্চি দীর্ঘ স্টিলের রড।
“মিছিল সমাবেশ স্থলে পৌঁছলে সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় এবং সমবেত জনতা আরও বড় মিছিল নিয়ে তিন নম্বর জেটি গেইটের দিকে রওনা হয়। কারণ ততক্ষণে সবাই জেনে গেছে, অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি জাহাজ সোয়াত জেটিতে ভিড়েছে। সমাবেশ থেকে এ খবর জানিয়ে অস্ত্র খালাস ঠেকাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়।”
গবেষক শামসুল হক বলেন, “অস্ত্র খালাস ঠেকানোর সিদ্ধান্তে পরোক্ষ সায় ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারের।
“তাই অস্ত্র খালাস নিশ্চিত করতে পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম আসেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। চট্টগ্রামের দায়িত্ব দেওয়া হয় অবাঙালি ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে। তিনি ঘোষণা দেন, ‘যে কোনো মূল্যে গোলাবারুদ-অস্ত্র নামাতে হবে’।”
‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ বইয়ের বর্ণনায়- “আওয়ামী লীগের তৎকালীন সম্পাদক এম এ হান্নান অস্ত্র খালাস স্থগিত রাখার ব্যাপারে ব্রিগেডিয়ার আনসারীর সাথে আলাপ করলে সে খালাসের বিষয়ে অটল বলে জানিয়ে দেয়। আলোচনা ব্যর্থ হবার পর জনতা বন্দর থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড বসায়।
“রহমত উল্লাহ চৌধুরী, আবুল বাশার, আহসানউল্লাহ চৌধুরী, আবুল কালাম, মান্নান সিকদার, নজরুল ইসলাম, ওমর ফারুক প্রমুখ শ্রমিক নেতৃবৃন্দ অস্ত্র খালাস না করার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।”
নিউমুরিং কলোনির সভা শেষের মিছিলের গন্তব্য ছিল ৩ নম্বর জেটি গেইটের অদূরে নেভি ফ্লিট ক্লাব। কারণ সেসময় ১ নম্বর জেটি থেকে নিউমুরিং এলাকার নৌঘাঁটি পর্যন্ত সব সামগ্রিক কার্যক্রম চলত এ্ ফ্লিট ক্লাব থেকে।
তখনকার কমিউনিস্ট নেতা আহসানউল্লাহ চৌধুরী (৮৬) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা মিছিল নিয়ে ৩ নম্বর গেইটের দিকে যেতে থাকি। আরও মিছিল আসতে থাকে। সন্ধ্যা হয়ে যায়। পরে পাকিস্তানি আর্মি গুলি চালায়। অনেকে মারা যায়। কিন্তু মানুষ রাস্তা থেকে সরেনি। আমরা অস্ত্র খালাস ঠেকিয়ে দিই।”
গবেষক শামসুল হক বলেন, “সেদিন প্যারেড ময়দানে নাট্যকার মমতাজউদ্দিন আহমদের নাটক ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মঞ্চায়ন হচ্ছিল। গুলির খবর পেয়ে নাটক দেখা বন্ধ করে জনতা মিছিল নিয়ে বন্দরের দিকে ছুটতে থাকে।”
‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, “কোনো হুঁশিয়ারি ছাড়াই গুলি চললে প্রথমে ৮ জন শহীদ হয়। কিন্তু জনতার প্রতিরোধে এতটুকু চিড় ধরেনি। শ্রমিক জনতার কাছে ছিল লাঠি, বর্শা আর কিছু বন্দুক। অন্যদিকে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র। সারারাত সংঘর্ষ চলার পর নিহত হলেন ২০ জনের মতো আর আহত হন শতাধিক।
“রাত আড়াইটার সময় প্রতিরোধকারীর সংখ্যা ২৫ হাজারে পরিণত হয়। স্লোগানে স্লোগানে বন্দর এলাকা মুখরিত হয়ে উঠে। শেষ পর্যন্ত অস্ত্র নামানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।”
‘মুক্তিযুদ্ধ ও চট্টগ্রাম বন্দর’ বইতে সে রাতের ঘটনায় গুলিতে ২৩ জন নিহত হওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়।
২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’র প্রস্তুতি গুছিয়ে ফেলেছে, যার লক্ষ্য নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা। সেই কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় অসংখ্য নিরীহ বাঙালি প্রাণ হারায়। আটক করা হয় বঙ্গবন্ধুকে।
শামসুল হক বলেন, “২৫ মার্চ বেলা ১টার দিকে প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ২৭ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্রহরায় দুই প্লাটুন বাঙালি সৈন্য বন্দরে আনা হয় অস্ত্র খালাসের জন্য। ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একটি দলও প্রতিবন্ধক সরিয়ে যেতে থাকে বন্দরের দিকে।
“আগ্রাবাদ এলাকায় ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের কাছে তিনি শোনেন, ঢাকায় বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের আক্রমণের কথা। এ সময় বন্দর এলাকায় গিয়ে বিপদে পড়তে পারেন ভেবে জিয়াউর রহমান ফিরে যান ষোলশহরের দিকে।”
বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীদের অসহযোগিতার কারণে অস্ত্র খালাসে সামরিক কর্তৃপক্ষ ২০ নম্বর বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানির সাথে ৫০ জন বাঙালি সৈন্যকে বন্দরে পাঠিয়েছিল ২৪ মার্চেই।
গবেষক শামসুল বলেন, “২৫ মার্চের কালো রাতের পর পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। ২৬ মার্চ দুপুরের পর পাকিস্তানি সেনারা ট্যাঙ্ক নিয়ে রাস্তার সব প্রতিবন্ধকতা সরায়। পরে তারা অস্ত্র নামাতে সক্ষম হয়।”
অস্ত্র খালাসে বাধ্য হওয়া বাঙালি সেনাদের পরিণতি সম্পর্কে ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, “নিরস্ত্র বাঙালি সৈন্যদের সোয়াত জাহাজেই আটকে রাখা হয়। তাদের ছাউনিতে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিছু খেতেও দেওয়া হয়নি। ২৭ মার্চ বিকেল ৪টায় বাঙালি সেনাদের জেটির প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা হয়। তাদের মধ্যে দুজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।”
চট্টগ্রামের এ প্রতিরোধ সম্পর্কে গবেষক শামসুল বলেন, “এই প্রতিরোধ লড়াইয়ে শতাধিক বা কারও কারও মতে দু’শ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। অথচ আজও এই গৌরবের ইতিহাস সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। অবশ্যই এ স্মৃতি সংরক্ষণ করা উচিৎ।”
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল সোয়াত জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যায়। ততদিনে স্বাধীন সরকার গঠন করে প্রতিরোধ যুদ্ধে বাংলাদেশ। আর নয় মাসের রক্তাক্ত সেই সংগ্রামের পথ ধরে আসে বিজয়।