নগর পুলিশের জনসংযোগ শাখা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, শুক্রবার থেকে ১১টি থানায় সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
Published : 09 Aug 2024, 10:43 PM
শেখ হাসিনার পতন ঘিরে থানায় থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে অস্ত্র নিয়ে নেওয়া, পুলিশ হত্যার ঘটনায় উদ্ভূত আতঙ্ককজনক পরিস্থিতিতে চার দিন অরক্ষিত থাকার পর চট্টগ্রামে শুক্রবার থেকে পুলিশ সদস্যদের অফিসে ফিরতে দেখা গেছে।
যেসব থানায় হামলায় হয়নি, সেগুলোতে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি বেশি এবং সেগুলোতে কাজ হতে দেখা গেছে। তবে আক্রান্ত থানাগুলোর বেশ কয়েকটি ঘুরে শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে দেখা গেছে।
এদিকে সন্ধ্যায় নগর পুলিশের জনসংযোগ শাখা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, শুক্রবার থেকে ১১টি থানায় সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে হালিশহর, ডবলমুরিং, কোতোয়ালি ও ইপিজেড থানার কার্যক্রম শুরু হবে। আর পতেঙ্গা থানার কার্যক্রম শুরু করার জন্য নতুন ভবন খোঁজা হচ্ছে।
নগরীর অন্যতম ব্যস্ত থানা কোতোয়ালি। শুক্রবার বিকাল ৪টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটক বন্ধ। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সেনা সদস্যরা। থানার ভেতর এখনও পড়ে আছে জ্বালিয়ে দেওয়া সাঁজোয়াযান ও গাড়ি। যেগুলোর পোড়া গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছে পাঁচ দিন পরও।
দায়িত্বরত সেনা সদস্যরা বলেন, পুলিশ সদস্যরা এসেছেন। তবে থানায় বসার কোনো পরিবেশ নেই। পুরো থানা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ভেতরে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে।
ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কোতোয়ালির থানার ওসির বক্তব্য নিতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
গত ৫ অগাস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর হামলায় চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানায়। এ থানার সব কিছুই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। থানা প্রাঙ্গণে রাখা পুলিশের সাঁজোয়াযান, মোটরসাইকেল ও বিভিন্ন ধরনের পোড়া গাড়ি পড়ে আছে। পাশাপাশি তিনতলা ভবনের প্রতিটি কক্ষেই ভাঙচুর করা ও আগুন দেওয়া হয়।
নগর পুলিশের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হচ্ছে, শনিবার থানা প্রাঙ্গণে কোতোয়ালি থানার কাজ সীমিত পরিসরে শুরু হবে। আর নিউমুরিং ফাঁড়িতে হবে ইপিজেড থানার কার্যক্রম।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে নগরীর সদরঘাট থানায় গিয়ে দেখা যায়, এক দল ছেলে-মেয়ে থানা পরিষ্কারের কাজ করছেন। আর কিছু লোককে দেখা গেছে ট্রাকে করে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মোটরসাইকেল এনে সেগুলো থানার সামনে মূল সড়কে স্তূপ করে রাখছে।
সদরঘাট থানায় দেখা পাওয়া যায় ওসি ফেরদৌস জাহানের। তাকেও থানার এলোমেলো সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখতে দেখা গেল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ওসি বলেন, ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর হামলাকারীরা থানা কম্পাউন্ডে রাখা গাড়িতে আগুন দেয়। কিছু নথিপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হামলাকারীরা থানার অস্ত্রাগার, মালখানায় হাত দিতে পারেনি। সেগুলো অক্ষত আছে। অধিকাংশ কক্ষের গ্লাস ভাঙচুর করা হয়েছে।
ওসি ফেরদৌস জাহান বলেন, “আমাদের পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তার খাতিরে থানা ছেড়ে বের হলেও আশেপাশে অবস্থান নেন। তারা প্রতিদিনই থানায় এসে দেখাশোনা করছেন।”
থানা থেকে বের হওয়ার পথে দেখা যায় কয়েকজন যুবক একটি মিনি ট্রাকে করে কিছু ভাঙাচোরা, ক্ষতিগ্রস্ত মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছেন।
তাদের মধ্যে একজন মো. সোহেল বলেন, ভাঙা মোটরসাইকেলগুলো তারা মাদারবাড়ি বালুর মাঠ এলাকা থেকে সংগ্রহ করে থানায় জমা দিতে এনেছেন।
“থানা ও ডাম্পিং স্টেশনের বেশ কিছু মোটরসাইকেল লুট হয়েছে। আমরা ঘটনার দিন থেকে যেখানে যা পাচ্ছি, তা সংগ্রহ করে বালুর মাঠে রাখছিলাম। অনেকে এসব মোটরসাইকেল রেখেছে ঝোপঝাড়ে। সেগুলো সংগ্রহ করছি।”
সকাল থেকে তারা দুই ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত মোটরসাইকেল সংগ্রহ করে থানায় জমা করেছেন বলে দাবি করেন সোহেল।
সদরঘাট থানার সামনেই নগর পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের ডাম্পিং স্টেশন। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ অগাস্ট থানায় হামলার পর অনেক মোটরসাইকেল লুট হয়েছে সেখান থেকে।
বিকাল সোয়া ৫টার দিকে পাহাড়তলী থানায় গিয়ে দেখা যায় অন্যান্য থানাগুলোর মত সেখানেও আছেন সেনা সদস্যরা।
থানার সামনে খোলা জায়গায় রাখা আছে বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র ও মালামাল। সেখানে কোনো পুলিশ সদস্যের দেখা পাওয়া যায়নি।
দায়িত্বরত এক সেনা সদস্য জানান, কয়েকজন পুলিশ সদস্য এসেছিলেন। থানার ভেতরে অবস্থা খুব নাজুক। সেখানে বসার কোনো পরিবেশ নেই। এমন কোনো কক্ষ নেই, যেগুলো ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়নি।
থানার সামনে রাখা বিভিন্ন আসবাবপত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, এগুলো সব লুট হয়েছিল। গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিকাল থেকে সেগুলো ফেরত দিতে আসছে লোকজন। থানা থেকে লুট করা মালামাল ফেরত দিতে মাইকিং করা হচ্ছে। অনেকেই এসে সেগুলো ফেরত দিয়ে যাচ্ছেন।
দুপুরে থানার পাশে একটি মসজিদ থেকে ১২টি আগ্নেয়াস্ত্র হেফাজতে নেওয়ার কথা জানিয়ে ওই সেনা সদস্য বলেন, “ঘটনার দিন পুলিশ সদস্যরা সেগুলো নিরপত্তার জন্য মসজিদে রেখে নিরাপদে সরে গিয়েছিলেন। আজ (শুক্রবার) অস্ত্রগুলো আমাদের হেফাজতে নিয়েছি “
হেফাজতে নেওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে দুটি চায়নিজ রাইফেল, ৯টি শট গান ও একটি গ্যাস গান।
বিকালে ডবলমুরিং থানার ওসি ফজলুল কাদের পাটোয়ারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো থানায় নিয়মিত আসছি। কিন্তু আমাদের কোনো লজিস্টিক সাপোর্ট নাই। সব কিছু ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। যার কারণে অপারেশনাল কার্যক্রম করা যাচ্ছে না।”
নগরীর ১৬টি থানার কমবেশি প্রায় থানায় হামলা হলেও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পুরোপুরি উপযোগী রয়েছে চকবাজার, বাকলিয়া, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, খুলশী, বায়েজিদ বোস্তামী ও বন্দর থানা।
চকবাজার থানার ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবর বলেন, “আমরা কেউ থানা ছেড়ে যায়নি। আমাদের এখানে কোনো ধরনের ঘটনা ঘটেনি। যার কারণে থানার কার্যক্রমও বন্ধ হয়নি।”
বাকলিয়া থানার ওসি আফতাব হোসাইন বলেন, “আমাদের থানায় কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। যার কারণে সবাই থানায় হাজির আছেন। কিন্তু সাধারণ লোকজন থানায় আসছে না।”
কাজের উপযোগী থাকলেও কিছু থানার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
থুলশী থানার ওসি কবিরুল ইসলাম বলেন, “আমরা থানায় বসছি। কিন্তু ইন্টারনেট না থাকায় অনলাইন জিডি হচ্ছে না। আমরা একটি ম্যানুয়াল জিডি নিয়েছি।”
ছাত্র জনতার বিপুল গণআন্দোলনে মুখে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকেই থানাসহ পুলিশের স্থাপনাগুলোতে একের পর এক হামলা হতে থাকে। নির্বিচারে আক্রমণ হতে থাকে থানায়; ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় অনেক থানায়।
এসব হামলায় অনেক পুলিশ হতাহত হলে অন্যরা নিরাপদে সরে যেতে থাকেন। এতে করে পুলিশবিহীন এক নজিরবিহীন অবস্থা তৈরি হওয়ার কথা বলছেন চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তারা।
৭ অগাস্ট দায়িত্বভার নিয়ে ঢাকায় নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নবনিযুক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ সদস্যদের স্ব স্ব ইউনিটে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার শেষ সময় ছিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা।
দেশের চলমান পরিস্থিতির জন্য বাহিনীর কিছু ‘উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার’ কর্মকর্তার সিদ্ধান্তকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে ‘আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার’ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ময়নুল ইসলাম।
বিভিন্ন জেলায় ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন পুলিশ সদস্যরা।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিজ্ঞপ্তিতে কার্যক্রম চলমান থাকা থানাগুলোর মধ্যে রয়েছে চান্দগাঁও, বায়েজিদ বোস্তামী, খুলশী, পাঁচলাইশ, সরদঘাট, চকবাজার, বাকলিয়া, পাহাড়তলী, আকবরশাহ, কর্ণফুলী ও বন্দর থানা।