“আদিবাসী সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিকাশ বিঘ্নিত না করে, এই রকম জবরদস্তিমূলক রূপান্তর থেকে রক্ষা করাটা কেবল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য নয় বরং সমগ্র মানব সমাজের জন্যে জরুরি।”
Published : 02 Feb 2024, 07:38 PM
‘সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প, আগ্রাসন ও রাষ্ট্রের উদাসীনতায়’ আদিবাসীদের সংস্কৃতি বিপণ্ন হয়ে পড়েছে বলে মত এসেছে চট্টগ্রামের এক সেমিনারে।
শুক্রবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে উদীচী চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির আয়োজনে ‘আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক বিপণ্নতা ও আমাদের দায়’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এই মত দেন।
উদীচীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রণেশ দাশ গুপ্ত স্মারক সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন উদীচী চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির আহ্বায়ক মোল্লা হাবিবুর রাছুল মামুন।
উদীচীর বিভাগীয় সদস্য সচিব জহির উদ্দিন বাবরের সঞ্চালনায় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক ও আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ।
তিনি বলেন, “আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যে বিপণ্ন সেটা নিয়ে বিতর্ক নেই। সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর চাপে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অস্বাভাবিকভাবে এমন পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছে যাতে তা নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে।
“সেই সাথে হারিয়ে গেছে আদিবাসী সমাজের দীর্ঘদিনের অর্জিত জ্ঞান, যার ভিত্তিতে ওদের জীবনধারণের বৈশিষ্ট্যগুলো গড়ে উঠেছে। এতে এমন সব ক্ষতি হচ্ছে, যেটা পরিবেশকেও বিপণ্ন করে, আর সাধারণভাবে সকল মানুষের জীবন কোনো না কোনোভাবে বিপণ্ন হয়।”
ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, “আদিবাসী সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিকাশ বিঘ্নিত না করে, এই রকম জবরদস্তিমূলক রূপান্তর থেকে রক্ষা করাটা কেবল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য নয় বরং সমগ্র মানব সমাজের জন্যে জরুরি।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন বলেন, সমতলের বর্মণ, কোচ ইত্যাদি জাতি তাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, পাহাড়ের খিয়াং জাতির ভাষা হারাতে বসেছে। চাঁদপুরের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বর্তমান প্রজন্মের মানুষ নিজের ভাষায় আর কথা বলতে পারে না।
“এ দেশের আদিবাসীদের রয়েছে বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধ সাহিত্য। সেসব আজ নিঃশেষ হতে চলেছে পৃষ্ঠপোষকতা ও সুস্থ পরিবেশের অভাবে। শুধু সংস্কৃতি নয়, আদিবাসী মানুষের জীবনের মূল্যও আজ আর নেই।”
উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের চলচ্চিত্র ও চারুকলা বিভাগের সম্পাদক কবি রহমান মুফিজ বলেন, “আদিবাসী নারীদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন নিত্যদিনকার ঘটনা। কথা ছিল এ দেশে একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। সে লক্ষ্যে একটি মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করা হয়েছিল।
“বাঙালি ও আদিবাসীর রক্তে গড়া এ স্বাধীনতা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে আদিবাসীরা এখনো পরাধীন রয়ে গেছে। আদিবাসী হিসেবে তারা এখনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করেনি।”
উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সভাপতি সাংবাদিক জসিম চৌধুরী সবুজ বলেন, “শত শত বছর ধরে বঞ্চনার কারণে পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিক্ষা উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও- এসব কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।
“শত শত আদিবাসী গ্রামে এখনো কোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। শিক্ষানীতিতে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও আদিবাসী শিশুরা সরকারের সাধারণ কর্মসূচির সুবিধা পর্যন্ত ভোগ করতে পারছে না।”
জসিম চৌধুরী সবুজ বলেন, “আমাদের শিক্ষানীতির লক্ষ্য যদি হয় একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, তাহলে আমাদের পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুকে সেভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে এমন কোনো বিষয় থাকা উচিত হবে না, যা একজন শিশুর মনে সাম্প্রদায়িক বা সংকীর্ণ চিন্তাধারার বিকাশ ঘটায়।
“পরিবারে বা সমাজে শিশু যদি কোনো সাম্প্রদায়িক বা সংকীর্ণ চিন্তা-চেতনার শিক্ষা পেয়ে থাকে, সে নেতিবাচক শিক্ষা যাতে শিশুর মন ও চিন্তা থেকে দূরীভূত হয় বরং সেই শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুকে পেতে হবে।”
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ সাধারণ সম্পাদক শরৎ জ্যেতি চাকমা বলেন, “অর্থনীতি, ভূমির মালিকানা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদারত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, শিক্ষা, ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি-সর্বক্ষেত্রে এ দেশের আদিবাসীরা প্রান্তিক অবস্থানে স্থিত।
“এ দেশের আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে, প্রতিনিয়ত তারা তাদের ভাষা হারাচ্ছে, তাদের লোকজ সাহিত্য হারিয়ে যাচ্ছে, সার্বিকভাবে তাদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন।”
শরৎ জ্যেতি চাকমা বলেন, “বিপণ্নতা ও প্রান্তিকতা থেকে উত্তরণের জন্য এবং সকল ক্ষেত্রে মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠীর সম পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য রাষ্ট্রকে বিশেষ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
“এ জন্য দরকার রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা। গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার পাশাপাশি চলে। আদিবাসীদের, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে তাদের মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না।”
অন্যদের মধ্যে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য জহিরুল ইসলাম স্বপন, উদীচী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি কবি ইউসুফ মুহম্মদ, কুমিল্লা জেলা সংসদের সভাপতি শেখ ফরিদ আহমদ, ফেনী জেলা সংসদের সভাপতি মহিবুল হক চৌধুরী রাসেল, বান্দরবন জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, কক্সবাজার জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছোটন দাশ, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোরশেদুল আলম, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গা আলোচনায় অংশ নেন।