আগুনে বিভিন্ন ধরনের ৩৭টি স্থাপনা পুড়েছে। বেশির ভাগই জাল রাখার ঘর। চায়ের দোকান, ভাঙ্গারি ও তেলের দোকানও আছে এর মধ্যে।
Published : 17 Nov 2024, 05:20 PM
একটু ভালো করে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে দুই যুগ আগে হাতিয়া থেকে চট্টগ্রামে এসে সাগর তীরের আকমল আলী সড়কে বসতি গড়েছিলেন কিরণ জলদাশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা কিরণ এবার সর্বস্ব হারিয়েছে আগুনে।
ভয়াবহ আগুনে কিরণের পুড়েছে জালসহ মাছ ধরার নানা রকম সরঞ্জাম। বিভিন্ন সময়ে ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে বারবার স্বপ্নভাঙ্গা কিরণ ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও এবার আর ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখছেন না।
নগরীর আউটার রিং রোডের বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী আকমল আলী সড়কে শনিবার রাতের ওই অগ্নিকাণ্ডে কিরণ জলদাশের মত সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছেন অনেকে। তাদের বেশির ভাগই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের হিসাব অনুযায়ী, আগুনে বিভিন্ন ধরনের ৩৭টি স্থাপনা পুড়েছে। বেশির ভাগই জাল রাখার ঘর। চায়ের দোকান, ভাঙ্গারি ও তেলের দোকানও আছে এর মধ্যে।
রাত ১২টায় লাগা এ আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে সকাল ৭টার দিকে। আগ্রাবাদ, বন্দর, ইপিজেড ও কেইপিজে স্টেশনের ৯টি ইউনিট প্রায় সাত ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে বলে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়।
ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য হিসাব করতে নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত করবে ফায়ার সার্ভিস। তবে ক্ষতিগ্রস্থদের দাবি, আগুনে তাদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
আউটার রিং রোডের সাথে লাগোয়া সাগর পাড়েই গড়ে উঠেছে এসব স্থাপনা। জেলেরা তাদের মাছ ধরার জালসহ বিভিন্ন মালামাল রাখতেন সেখানে। পাশাপাশি সেখানে গড়ে উঠেছে জ্বালানি তেলের দোকান, চায়ের দোকান, মাছের বোট মেরামতের ওয়ার্কশপ ও কয়েকটি বসত ঘর।
রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে গিয়ে দেখা যায়, তখনও চারদিকে ধোঁয়া, বাতাসে থেমে থেমে বেড়ে যাচ্ছে আগুন। বেলা দেড়টার পরও সেখানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
আগুনে সবকিছু বিলীন হয়ে যাওয়া খালি জায়গায় মা ও সন্তানকে নিয়ে আগুন সড়িয়ে কিছু খুঁজছিলেন কিরণ।
কী খুঁজছেন জিজ্ঞাসা করতেই কিরণ বলে ওঠেন- “সবকিছুইতো শেষ। খুঁজে দেখছি তবু কিছু পাওয়া যায় কিনা।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কিরণ বলেন, “আগে পরিবার নিয়ে এখানে থাকতাম। বছর খানেক আগে পরিবার নিয়ে গেছি উপরে (লোকালয়ে)। এখন এখানে জাল রাখার ঘর করেছি। গত বৈশাখে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ঘর বানিয়েছি জাল রাখতে। এখন সব শেষ।”
আক্ষেপ করে কিরণ বলেন, “২০০১ সালে বাপ-দাদুর (দাদা) সাথে হাতিয়া থেকে চট্টগ্রামে চলে এসেছি। দাদুর চারটা বোট ছিল। সেগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে। পরে নিজে দুইটা বোট নিয়েছি। দুই বছর আগে ঘূর্ণিঝড়ে একটা নষ্ট হয়ে গেছে। আর ঠিক করতে পারিনি। এখন একটা বোট দিয়ে চলে।”
৩০/২০ ফুটের কাঁচা ঘরে ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের ৪০টি জাল, মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জামসহ প্রায় ১১ লাখ টাকার মালামাল ছিল বলে দাবি তার।
কিরণের ভাষ্য, এ নিয়ে পাঁচ বার দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
“এবার সহ পাঁচ বার ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। আমরাতো ছোটবেলা থেকে সাগরের সাথে লড়াই করে বেড়ে ওঠা মানুষ। আগে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতি হয়েছে। সেময় কিছু না কিছু রক্ষা করেছি। কিন্তু এবার আগুন চোখের সামনেই সব শেষ করে দিয়েছে। আগের বার ধার দেনা করে কোনমতে টিকে গিয়েছিলাম। এখনতো আর দাঁড়াতেও পারব না।”
কিরণের আক্ষেপ, “এত টাকা কে দেবে? আগে নিজের বোটে স্টাফদের (শ্রমিক) নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম। এখন অন্যের বোটে কাজ করে খেতে হবে।”
তিনি বলেন, “পূর্ণিমার জো চলছে, রাতে অনেক জোয়ার ছিল, যার কারণে বাতাসও ছিল। বাতাসে আগুন খুব দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে গেছে। মূল সড়ক দিয়ে আমরা এখানে আসতে পারছিলাম না। পেছন দিকে আসার পরও কিছু বের করতে পারিনি।
ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সেখানে যাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তারা সবাই ছোট বোটের মালিক (প্লাস্টিকের লাইফ বোট)। সাগরের তীর থেকে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই তারা মাছ ধরেন।
বেশিরভাগ জেলেই বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে সাগরে বোট ভাসাতেন। পরে মাছ বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করতেন।
গত ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা ছিল। নিষেধাজ্ঞা ওঠার পরও জালে মাছ কম আসায় অনেকেই এখনও সাগরে বোট ভাসায়নি। সে কারণে বেশিরভাগ জাল তাদের তীরেই রাখা ছিল, যেগুলো সব পুড়েছে আগুনে।
কিরণের মত একই অবস্থা জেলে ইলিয়াসের। পরিবার আকমল আলী সড়কের নব্বই কলোনিতে থাকলেও তার ব্যবসার সবকিছুই রাখা ছিল এখানে।
ইলিয়াস জানান, ৪০/৩০ ফুটের জাল ঘরে ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের ২০০ জাল, তিন টন রশিসহ চারটি বোটের মালামাল ছিল। সেগুলোর আনুমানিক দাম ৩৫ লাখ টাকা।
তিনি বলেন, “গত রাত সোয়া ১২টার দিকে ফোনে একজন আমাকে আগুন লাগার কথা জানায়। দ্রুত সময়ের মধ্যে চলে আসি।কিন্তু এত বেশি আগুন ঘরের সামনেই যেতে পারিনি। আগুনের তাপে টিকে থাকতে না পেরে সবাই সাগরে বুক সমান পানিতে নেমে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। সেখানেও আগুনের তাপে দাঁড়াতে পারছিলাম না।
ইলিয়াস বলেন, “বিভিন্ন গদি (ব্যবসায়ী) থেকে অগ্রিম ১৩ লাখ টাকা নিয়েছিলাম। আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতদের কাছ থেকে আরও সাত থেকে আট লাখ টাকা ঋণ। এখন কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।”
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, শনিবার রাতে লাগা আগুনে তিনটি তেলের দোকান, দুই ভাঙ্গারি, পাঁচটি চায়ের দোকান, ২৪ জন বোট মালিকের ৩০টি জাল ঘর (জাল ও মাছ ধরার সরঞ্জাম রাখার ঘর) পুড়ে গেছে।
জালঘরের পাশাপাশি ওই এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন মাহবুব আলম। আগুনে সর্বস্ব হারিয়ে মাহবুব এখন দিশেহারা। আগুন লাগা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সবকিছুর সাক্ষী মাহবুব।
রোববার দুপুরে দেখা যায়, মাহবুব আগুনে পুড়ে যাওয়া মালামাল হাতড়াচ্ছেন লোকজন নিয়ে।
মাহবুবের ভাষ্য, পূর্ব দিকের একটি জাল ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত। ওই জালঘরের লোকজন রাতে মাছ ধরতে সাগরে গিয়েছিলেন। তালাবন্ধ ঘর থেকে আগুন বের হতে দেখেন তার। মুহূর্তে তা ছড়িয়ে যায়।
মাহবুব জানান, দুটি কাঠের তৈরি বড় এবং পাঁচটি ছোটসহ সাতটি ফিশিং বোট আছে তার। সেগুলোর মধ্যে বড় দুটি ট্রলার সাগরে। মাছ কম থাকায় ছোট ট্রলারগুলো সাগরে নামননি। বসত ঘরের পাশে তার চারটি জালঘর, একটি তেলের দোকান পুড়েছে।
“ছোট বোটগুলোর ইঞ্জিন খুলে রেখেছিলাম, অনেকগুলো জাল, মাছ ধরার সরঞ্জাম ছিল। সব মিলিয়ে কোটি টাকার মালামাল ছিল আমার। সবকিছু আমার শেষ হয়ে গেছে।”
পরোক্ষ ক্ষতির মুখে দেড়শ পরিবার
ক্ষতিগ্রস্ত জেলেরা বলছেন, তারা সংখ্যায় ২৪ জন হলেও তাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অন্তত আরও দেড়শ পরিবার।
ইলিয়াস জানান, তার চারটি বোটে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। সাগরে বোট নামালে তারা মাসিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করেন। আবার মাছ ধরা বন্ধ থাকলে অনেকে শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেন। তখন তারা অন্য কাজ করেন।
এই ক্ষতি সহজে কাটিয়ে ওঠা যাবে না জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, তারা কেউ সাগরে বোট নামাতে পারবেন না। মাছ ধরার মৌসুম শুরু হলেও তাদের শ্রমিকরা বেকার বসে থাকবেন।