“স্থানীয় মানুষের মনে সবসময় আতঙ্ক থাকে, কখন হাতি আসে… মানুষ বলছে এগুলো সরিয়ে নিয়ে যান, তাদের দিক থেকে তারা ঠিক; তারা সেটা বলতে পারে।”
Published : 12 Apr 2025, 01:19 AM
প্রতিরাতে তাণ্ডবে অতিষ্ট এলাকাবাসী মরিয়া হয়ে আন্দোলনে নামলেও বন্য হাতি সরিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা বন বিভাগের নেই।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার কোরিয়ান ইপিজেডে (কেইপিজেড) এলাকায় অবস্থান করা হাতির সাথে স্থানীয়দের ‘দ্বন্দ্ব’ হয়ে উঠেছে নিয়মিত ঘটনা।
শুধু ফসলহানি নয়, গত কয়েক বছর ধরে হাতির আক্রমণে প্রাণহানিও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এতে অতিষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ হাতি সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে শুরু করেছে বিক্ষোভ।
আন্দোলনের মুখে প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের আশ্বাস দেওয়া হলেও হাতিগুলো সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বনবিভাগের সক্ষমতা কতটুকু- সে বিষয়টি মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বনবিভাগের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এ বন্য হাতিগুলো অনেক শক্তিশালী এবং বনেই তাদের বিচরণ। এসব বন্য হাতিকে অবচেতন করার চেষ্টা করা হলে সেগুলো গভীর বনাঞ্চলে ঢুকে যাবে, যেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে আনার মত সক্ষমতা তাদের নেই। সবমিলিয়ে হাতি সরিয়ে নেওয়ার কাজটি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’।
স্থানীয়রা বলেছেন, হাতির দলের তাণ্ডবে তারা সবসময় আতঙ্কে থাকেন। ধান ও কলা গাছসহ খাবারের খোঁজে প্রায় রাতেই হানা দেয় হাতি।
কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান এবং আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ, বারখাইন, বটতলী ও বারশত; কয়েকটি ইউনিয়নে বেশ কয়েক বছর ধরে হাতির দলটি ‘তাণ্ডব’ চালাচ্ছে।
বিভিন্ন সময়ে চাষের ফসল ক্ষতির পাশাপাশি হাতির তাণ্ডবে গত কয়েক বছরে নারী-শিশুসহ বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে গত সাত মাসে ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে।
গত ২১ মার্চ রাতে কর্নফুলী উপজেলার শাহ মীরপুর এলাকায় এক বাড়িতে বন্যহাতি হানা দেয়। এসময় হাতি তিন মাস বয়েসী এক শিশুকে শুঁড় দিয়ে আছড়ে ফেলে।
এর আগে গত ২৩ অক্টোবর দক্ষিণ শাহ মীরপুর, ১১ সেপ্টেম্বর দৌলতপুরে, ২৩ সেপ্টেম্বর আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আশ্রয়ন প্রকল্প এলাকায় মো. কাশেম ওরফে দুলাল (৬০) এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডের খোশাল তালুকদার বাড়ি এলাকায় রেহানা বেগম (৩৮) হাতির আক্রমণে মারা যান।
এর আগে ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি আনোয়ারা উপজেলার বটতল নূরপাড়া এলাকায় হাতির আক্রমণে ৭০ বছর বয়েসী এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
হাতি সরোনোর দাবিতে স্থানীয় লোকজন বিভিন্ন সময়ে সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।
গত ২২ ও ২৭ মার্চ হাতি সরানোর দাবিতে কেইপিজেড গেইটে আনোয়ারা পিএবি সড়কে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে স্থানীয় লোকজন।
বিক্ষোভকারী স্থানীয় বাসিন্দা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে কর্ণফুলী উপজেলার শাহ মিরপুর, আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ও বড় উঠান ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় হাতি তাণ্ডব চালায়।
কেইপিজেড এলাকার চারটি হাতি এসব তাণ্ডব চালাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, তারা বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের কাছে এসব হাতি সরানোর জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।
যেভাবে এল হাতি
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়ন এবং আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের প্রায় আড়াই হাজার একর পাহাড়ি ভূমিতে কোরিয়ান এক্সেপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৬-২০০৭ সালের দিকে।
দেয়াং পাহাড় ঘেরা ওই এলাকায় ২০১২-১৩ সাল থেকেই হাতির আনাগোনা বেশি। আগেও হাতির আসা-যাওয়া ছিল, তবে তখন তুলনামূলক কম ছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও বন বিভাগের ভাষ্য।
২০১৮ সালের শেষ দিকে হাতির একটি দল স্থায়ীভাবে কেইপিজেড এলাকায় বসবাস শুরু করে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, ওই এলাকা চারটি হাতির আবাসস্থল। যেগুলো ওই এলাকায় তাণ্ডব চালাচ্ছে।
গত শনিবার কর্ণফুলী টানেলের অ্যাপ্রোচ সড়কে একটি বড় হাতির রাস্তা পারাপারের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে স্থানীয় লোকজনকে চিৎকার করে ও টর্চের আলো ফেলে হাতিটিকে তাড়িয়ে দিতে দেখা যায়।
এর আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরে তিনটি হাতি টানেলের অ্যপ্রোচ সড়ক পার হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের উপ বন সংরক্ষক আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শঙ্খ নদী পাড় হয়ে বাঁশখালীর পুকুরিয়া, জলদি, সাধনপুর এলাকায় বড় বনাঞ্চল দখল হয়ে গেছে। সেখানে হাতি তার পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। জলাশয় না থাকায় সে পানি পাচ্ছে না।
বন কর্মকর্তা ইয়াছিন নেওয়াজের ধারণা, সেখানে হাতির আবাসস্থল তৈরি করা গেলে হাতিগুলো নিজেরা সেখানে চলে যাবে। সেখানে জলাশয় থাকলে হাতিগুলো হয়ত আর এদিকে আসবে না।
তিনি বলেন, আগে এ এলাকায় হাতিগুলো নিয়মিত যাতায়াত করত, কিছুদিন থেকে আবার চলে যেত, কিন্তু কয়েকবছর ধরে সেগুলো সেখানে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করেছে।
“কেইপিজেডে বেশেকিছু জলাশয় তৈরি করা হয়েছে। হাতির জন্য পানি প্রয়োজন। তারা সে জলাশয়গুলোতে শরীর ডুবিয়ে বসে থাকতে পারে। কিন্তু সেখানে তেমন খাবার নেই। তারপরও তাদের জায়গাটি পছন্দ হওয়ায় তারা সেখানে আবাস গড়েছে।”
যা বলছে বন বিভাগ
বনবিভাগের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, হাতি সাধারণত পূর্বপুরুষের পথ ধরে চলাচল করে। শঙ্খ নদী তৈলার দ্বীপ পেরিয়ে আনোয়ারার এই পাহাড়ি এলাকায় আগেও হাতি আসত।
এই পুরো অঞ্চল জুড়ে এক সময় পাহাড় ছিল, সেখানে হাতি যাওয়া-আসা করত। এত প্রতিবন্ধকতা ছিল না। এখন এসব এলাকায় মানুষের বসতি গড়ে ওঠার পাশাপাশি চাষাবাদ হওয়ার কারণে হাতি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাতে বাড়ছে মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্ব।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগে চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণী ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য বলেন, হাতিগুলো বেশিরভাগ সময় কেইপিজেডের ভেতর থাকে। বিকাল ৪টার পর থেকে সেগেুলো লোকালয়ে বের হয়ে আসে।
“সেখানে দুটি পুরুষ ও দুটি মাদি হাতি, মোট চারটি প্রাপ্ত বয়স্ক হাতি আছে। যার মধ্যে একটি মাদি হাতি সম্প্রতি বাঁশখালীর দিকে চলে গেছে। এখন তিনটি হাতি আছে।”
তিনি বলেন, “স্থানীয় লোকজন বলছে, হাতি আগে এত ক্ষতি করেনি। আবার কেউ বলছে, তারা আগে কখনও হাতি দেখেনি। আসলে মূল বিষয় হল, একসময় ওখানে পাহাড়ি বনাঞ্চল ছিল। এখন সেখানে ঘনবসতি হয়ে গেছে। যার কারণে এখন হাতি আসা-যাওয়া করলেই কারো ফসলি জমি আবার কারো ঘরবাড়ি ক্ষতি হচ্ছে।
“শিল্পায়নের কারণ ক্রমান্বয়ে কেইপিজেড তাদের কারখানার সংখ্যা বাড়াচ্ছে, অনেক পাহাড় কাটা হচ্ছে। শিল্পায়নের ফলে সেখানে লোকালয় বাড়ছে, গড়ে উঠছে বসতি।”
হাতির কারণে ফসলের ক্ষতি হলে বনবিভাগের পক্ষ থেকে নিয়মিত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় জানিয়ে দ্বীপান্বিতা বলেন, “কিন্তু জীবনহানিতো আর আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে পোষানো সম্ভব না। মানুষের কাছে সেটা ভুলে থাকাও সম্ভব না। সাধারণ মানুষের কষ্টের বিষয়টা আমরাও ফিল করছি।”
হাতি উদ্ধারে সক্ষমতা নেই বন বিভাগের
বন্যার পানি ও পাহাড়ি ঢলে ২০১৬ সালের ২৬ জুন ভারতের আসাম হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্তে আসে একটি বুনো হাতি। এরপর দেড় মাসের বেশি সময় ধরে হাতিটি নদী ও স্থলপথ মিলিয়ে চার জেলার কয়েকশ কিলোমিটার পাড়ি দেয়।
৩ অগাস্ট ভারতীয় একটি উদ্ধারকারী দল জামালপুরে এসে হাতিটি উদ্ধার কাজে হাত লাগায়। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়।
প্রায় দুই মাস পর জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলার কয়রা গ্রামের একটি ধানক্ষেত থেকে অচেতন হাতিটিকে টেনে তোলা হয়।
আনোয়ারা উপজেলায় বিচরণ করা হাতিগুলো স্থানান্তর করতে যে পরিমাণ সক্ষমতা প্রয়োজন, তা নেই বলে মনে করেন বনবিভাগের কর্মকর্তারা।
উপ বন সংরক্ষক আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ বলেন, হাতি স্থানান্তরের কাজটি অনেক ‘কঠিন’; বনবিভাগের সে সক্ষমতা নেই।
“স্থানীয় মানুষের মনে সবসময় আতঙ্ক থাকে, কখন হাতি আসে… মানুষ বলছে এগুলো সরিয়ে নিয়ে যান। তাদের দিক থেকে তারা ঠিক; তারা সেটা বলতে পারে। কিন্তু এটা সরিয়ে নেওয়ার কারিগরি দক্ষতা ও সক্ষমতা আমাদের নেই। চার-পাঁচ টনের একটি অ্যানিমেল ক্যারি করবে সেটার সক্ষমতাতো আমার লাগবে।”
ইয়াছিন নেওয়াজের ভাষ্য, “এটা ওয়াইল্ড এলিফেন্ট, বনে বিচরণ করতে থাকে। সরানোর জন্য সেটাকে ধরতে হবে। সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে। সুবিধাজনক স্থানে আসলে ট্রাংকুলাইজ করতে হবে, এরপর হাতিটা পাঁচ-সাত কিলোমিটার চলে যাবে। সেজন্য আমাদের নজরদারি করতে হবে, কোথায় গিয়ে পড়ে। যদি পানিতে গিয়ে পড়ে সেটাকেতো আর বাঁচাতে পারব না।
“আমাদের কোনো এয়ার কার্গো নাই। সাথে দক্ষ জনবলও নাই, যারা ওয়াইল্ড এলিফেন্টগুলোকে রেসকিউ করতে পারে। আমাদের ভেট আছে দুই জন, একজন ডুলাহাজারাতে, একজন গাজীপুরে।”
অন্তত একটি হাতি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত
এলাকাবাসীর বিক্ষোভের পর স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, বনবিভাগ এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বৈঠকে বসেছিল গত ২৭ মার্চ।
হাতি স্থানান্তরের বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে উপ বন সংরক্ষক ইয়াছিন নেওয়াজ বলেন, “তিনটা হাতির মধ্যে যে হাতিটা বেশি ক্ষয়ক্ষতি করছে সেটাকে স্থানান্তর করতে বলা হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্য তিনটা হাতির মধ্যে যেটা বয়সে তরুণ, সেটাই বেশি ক্ষয়ক্ষতি করছে। তাদের ভাষায় সেটা ছোট হাতি।
“তবে এ হাতি সরিয়ে নেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। সেজন্য বিদেশেও যোগাযোগ করছি … তাদের বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ করছি। কী করা যায় সেটা তারা দেখবে। প্রয়োজনে তাদের একটা দল এখানে আসতে পারে। অন্তত একটাকে ট্রাংকুলাইজ করে কোনো বনে নেওয়া যায় কি না, সেটাও ভাবতে হবে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।”
স্থায়ী সমাধান মূল আবাসস্থল সমৃদ্ধ করা
উপ বন সংরক্ষক নাছের বলেন, হাতিগুলোর মূল আবাস বাঁশাখালীর বনাঞ্চল। চারটি হাতির মধ্যে একটি হাতি নিজ থেকেই চলে গেছে। তাই সে বনাঞ্চলটি সমৃদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “সেখানে জবরদখল থাকলে সেগুলো মুক্ত করে হাতির বিচরণের অবস্থা তৈরি করতে পারলে আমার মনে হয় ট্রাংকুলাইজ করার আগেই হাতিগুলো নিজ থেকেই চলে যেতে পারে।
“এখন বনে জলাশয় নেই, হাতির আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে গেছে, যার কারণে খাবারের সংকট তৈরি হয়েছে। কিছু কিছু স্থানে আকাশমনি গাছ, পেয়ারা বাগান, লেবু বাগান আবার লোকালয় হয়ে গেছে। সেখানে আবাস্থল তৈরি করা গেলে হাতিগুলো নিজ থেকেই চলে যাবে বলে আমার মনে হয়।”
এই বন কর্মকর্তা আরও বলেন, বিভিন্ন স্থানে কিছু জলাশয় করে দেওয়া হলে হাতিগুলো সেখানে অবস্থান করবে, যেটা তারা কেইপিজেডে করে। আর দখল হওয়া স্থানগুলো মুক্ত করে হাতির আবাস করে দিলে হাতিগুলো সেখানে চলে যাবে।