“দলীয় নির্বাচনের কারণে জনগণ তার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপে কাজ করা যায় না” বলেন, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন।
Published : 29 Dec 2024, 08:19 PM
স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রভাবমুক্ত করার সাথে একদিনে সব করার পক্ষে মতামত এসেছে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত ‘স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের’ মতবিনিময় সভা থেকে।
রোববার চট্টগ্রামের একটি হোটেলে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ সদস্যদের পাশাপাশি সরকারি আমলারাও তাদের মতামত তুলে ধরেছেন।
পাশাপাশি, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপের মত বিষয়গুলোও তুলে ধরেছেন আলোচকরা।
সভা শেষে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আরও কয়েকটি জেলায় সভা করেছি। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন কেউ চাচ্ছে না। কিন্তু দলের ‘প্রভাবমুক্ত’ হবে এটা হলফ করে কেউ বলবে না। কারণ দলেরতো প্রভাব থাকবে। কারণ যারা নির্বাচন করেন তারাতো রাজনীতিও করেন।”
নির্বাচনে দলীয় প্রভাব থাকলেও তাতে অসুবিধা থাকতে পারে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “হয়ত একদল থেকে একাধিক ক্যানডিডেট দাঁড়াবে।”
এর আগে সভায় কমিশন প্রধান তোফায়েল আহমেদ সরকারি চাকরিজীবীদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচন করার সুযোগ দিলে পরিষদের মান ভালো হতে পারে বলেও নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন।
সভায় রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় করতে হবে। দলীয় নির্বাচনের কারণে জনগণ তার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপে কাজ করা যায় না।
প্রকল্প বন্টনেও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপের কারণে ভাইস চেয়ারম্যানরা কোনো প্রকল্প পান না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
উপজেলা পরিষদ আইনে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টা পদ বাতিলের প্রস্তাবনা দিয়েছেন পটিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ইদ্রিস মিয়া।
সাতকানিয়া উপজেলার সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান দুরদানা ইয়াসমিন সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপে কাজ করতে না পারার অভিযোগ করেন। পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন একসাথে করারও প্রস্তবনা দেন।
সভায় বিভিন্ন উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম এসএসসি এবং চেয়ারম্যানদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি রাখার প্রস্তাব করেন।
তবে এ প্রসঙ্গে কমিশন চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, “বিভিন্ন জেলার মতবিনিময় সভায় তারা শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে প্রস্তবনা পেয়েছেন। তাই বিষয়টি আমরাও বিবেচনায় নিয়েছি।
“শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে করা যাবে না। কারণ জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে যদি শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি না থাকে তাহলে স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে আনাটা ডিফিক্যাল্ট হবে। এটা আমরা সবাই মিলে আলোচনা করব।”
সভায় রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, “আমরা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীয় সরকার নির্ভর। স্থানীয় সরকারকে সক্রিয় করার জন্য তাকে তার জুরিশডিকশনে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। কারণ ছোট কোনো বাজেট বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হয়।”
স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিকে নির্দলীয় রাখার পরামর্শ দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী শাব্বির ইকবাল বলেন, “এলজিইডি মানে লোকাল গভর্ণমেন্ট। কিন্তু এখানে সবকিছুই হয় সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে। স্থানীয় সেবাকে স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত করতে হবে।”
তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “বেশিরভাগ মানুষের মতামত হচ্ছে যেহেতু অন্তবর্তীকালীন সরকার আছে এবং কোনো পলিটিক্যাল বিষয়ে ইনফ্লুয়েন্স করার বিষয় থাকবে না তাই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করতে হবে।
“আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলিনি। আমরা আরও দেখি। আরও সময় আছে, আলোচনা হবে.. পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর থেকেও মতামত আহ্বান করেছি। তারা কী মতামত দেন সেটাও আমাদের দেখতে হবে।”
কমিশন প্রধান তোফায়েল আরও বলেন, “সংসদীয় এবং রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি এ দোলাচলের মধ্যে আমরা অনেক রকমের মতামত পাচ্ছি। বিশেষ করে যখন মেম্বার, কাউন্সিলর এবং সাধারণ লোক সিভিল সোসাইটি এবং আমাদের অ্যাকাডেমিয়া তারা বেশিরভাগ সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে।
“চেয়ারম্যান-মেয়র সাহেবরা এটার বিরোধিতা করছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে ‘আমরা চেয়ারম্যান ছিলাম এতদিন এখন মেম্বার হয়ে দাঁড়াব’। তার মানে মেম্বারশিপটাকে চারদিক থেকে নেগলেক্ট করা হচ্ছে।”
নির্বাচনি খরচ না কমলে ‘ভালো’ মানুষ নির্বাচনে আসতে পারবেন না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেজন্য একটা চিন্তা আছে- চাকরি করেন, অন্য পেশায় আছেন তাদের কাউন্সিলর বা মেম্বার হতে বাধা নেই। তারা মেম্বার/ কাউন্সিলর হতে পারে। কিন্তু ফুল টাইম এক্সিকিউটিভ বডিতে থাকতে পারবেন না।”
কলকাতা সিটি করপোরেশনের উদাহারণ দিয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল বলেন, এ ধরনের পদ্ধতি নিয়ে কমিশন বিবেচনা করছে।
আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন কমিশন প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল।
নির্বাচনে ‘না’ ভোট দেওয়ার ব্যবস্থার বিষয়টি ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংষ্কার কমিশন’ বিবেচনায় নিয়েছে বলেও জানান কমিশনটি সদস্যেরও দায়িত্বে থাকা তোফায়েল আহমেদ।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধানের পাশাপাশি নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্যের দায়িত্ব থাকা অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইউনিয়ন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে ২৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।
“নির্বাচনগুলোতে ১৯ লাখ লোককে নিয়োগ করা হয়েছে। নির্বাচন করতে তফসিলসহ ২২৫ দিন লেগেছে।”
সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন একসাথে করার পক্ষে মতামত দিয়ে তিনি বলেন, “আলাদা আলাদা নির্বাচন ব্যয়বহুল, সময় ক্ষেপণকারী ও দেশে অনেক অস্থিরতাও সৃষ্টি করে। অনেক কাজকর্ম ব্যাহত হয়।
“এটাকে যদি আইন পরিবর্তন করে আমরা একসাথে করতে পারি তাহলে খরচ হবে ৫০০-৬০০ কোটি টাকা। সময় লাগবে ৪০-৪৫ দিন।”
মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার জিয়া উদ্দিন, চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আসফিকুজ্জামান আক্তার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার শারমিন জাহান, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমসহ বিভিন্ন উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রকৌশলী, উন্নয়নকর্মীরা।