পরিবেশবিদরা বলছেন, জীব বৈচিত্র্য কিংবা বাস্তুতন্ত্রে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তা নিশ্চিত হয়েই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়া উচিত।
Published : 15 Dec 2024, 08:40 AM
শুষ্ক মৌসুমের সংকট কাটাতে এবং ভবিষ্যত চাহিদা মাথায় রেখে ৬৩ কোটি লিটার পানি পরিশোধন ক্ষমতার নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিতে চায় চট্টগ্রাম ওয়াসা।
সংস্থাটি বলছে, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের ভাণ্ডালজুড়ি বা যে অংশে সারা বছর প্রবাহ ভালো থাকে, সেরকম কোনো স্থান থেকে এই পানি নিতে চায় তারা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেছেন, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রাথমিক প্রস্তাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অনুমতি দিয়েছে। দুই-তিন মাসের মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হতে পারে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, দৈনিক ৬৩ কোটি লিটার পানি নিলে কর্ণফুলী নদীর জীব বৈচিত্র্য কিংবা বাস্তুতন্ত্রে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা, তা নিশ্চিত হয়েই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়া উচিত।
প্রস্তাবিত প্রকল্পটির নাম 'লবণাক্ততা পরিহারের লক্ষ্যে মোহরা পানি শোধনাগারের ইনটেক স্থানান্তর এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’।
ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ২০৪২ সালে গিয়েও নগরীতে পানির বর্ধিত চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
হালদা নদী যেখানে কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশেছে, তার আধা কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসার মোহরা পানি শোধনাগার ফেইজ-১। এর জন্য দিনে ৯ কোটি লিটার পানি তোলা হয়।
দুই নদীর সংযোগস্থলের ছয় কিলোমিটার উজানে মদুনাঘাট পানি শোধনাগারের জন্যও প্রতিদিন ৯ কোটি লিটার পানি প্রয়োজন পড়ে।
চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টির অভাবে কাপ্তাই হ্রদের উজানে পর্যাপ্ত পানি থাকে না। ফলে সেখান থেকে পানি ছাড়া হয় তুলনামূলক কম। সেই স্বল্প পানি বিপরীতমুখী সাগরের পানিকে জোরালো বাধা দিতে পারে না। ফলে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণ সাগরের নোনা পানি ঢুকে পড়ে হালদা নদীতে।
এই তীব্র লবণাক্ততার কারণে জোয়ারের সময় নদী থেকে পানি নেওয়া বন্ধ রাখতে হয় চট্টগ্রাম ওয়াসার দুই পানি পরিশোধন কেন্দ্রে। তাতে দৈনিক পানি পরিশোধন কমে যায় প্রায় ৫ কোটি লিটার। তখন চাহিদা অনুযায়ী পানি না পেয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয় চট্টগ্রামবাসীকে।
গত কয়েক বছর ধরেই এই সংকট চলছে। শুষ্ক মৌসুমে নগরীর হালিশহর, উত্তর কাট্টলী, পতেঙ্গা, বাকলিয়া, লালখান বাজার, শুলকবহর, আমানবাজার, আমবাগান, শেরশাহ, কালুরঘাট শিল্প এলাকা, চন্দনপুরাসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হয়।
চলমান এই সংকটের সঙ্গে আছে পানির বর্ধিত চাহিদা। চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, ২০৩২ সালে চট্টগ্রামে পানির দৈনিক চাহিদা ৭৫ কোটি লিটার ছাড়িয়ে যাবে। ২০৪২ সালে চাহিদা হবে ১০০ কোটি লিটারের বেশি।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমানে পানির দৈনিক গড় চাহিদা ৫৮ কোটি লিটার। বিপরীতে সরবরাহ করা হয় ৪৮ থেকে ৪৯ কোটি লিটার।”
চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদনের বিবরণী অনুযায়ী, গত অক্টোবরে প্রতিদিন গড়ে ৪৯ কোটি ৫০ লাখ লিটার পানি উৎপাদন হয়েছে। এরমধ্যে ৩ দশমিক ৩ কোটি লিটার পানি এসেছে গভীর নলকূপ থেকে। বাকি ৪৬ কোটি লিটারের কিছু বেশি পানি পাওয়া গেছে চারটি শোধনাগার থেকে।
চলতি বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম পানি উৎপাদন হয়েছিল এপ্রিলে; দিনে গড়ে ৪৪ দশমিক ৮৭ কোটি লিটার। তার আগের মাসে এই গড় ছিল ৪৫ দশমিক ২৩ কোটি লিটার।
পানির সংকট মেটাতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৫টি গভীর নলকূপ বসাতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা।
এই প্রকল্পের পরিচালক চট্টগ্রাম ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল আহসান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মোহরা কালুরঘাটসহ যেসব স্থানে পানির লেয়ার ভালো এবং যেসব এলাকায় পানির সংকট আছে, সেসব এলাকায় গভীর নলকূপগুলো বসানো হবে।
“এসব গভীর নলকূপ বসানোর কাজ আগামী বছর শুরু হয়ে কয়েক ধাপে ২০৩০ সাল নাগাদ শেষ হতে পারে।”
৫৫টি গভীর নলকূপ বসানোর সঙ্গে সঙ্গে ৬৩ কোটি লিটার পানি পরিশোধন সক্ষমতার প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন করতে চায় চট্টগ্রাম ওয়াসা।
মাকসুদ আলম বলেন, “প্রস্তাবিত প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে চায় কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ)। তারা নিজস্ব খরচে সম্ভাব্যতা যাচাই করে সম্ভাব্য ইনটেক (পানি তোলার স্থান) নির্ধারণ করবে।”
তিনি বলেন, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রাথমিক প্রস্তাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অনুমতি দিয়েছে। আগামী বছরের শুরুতে ইডিসিএফ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করতে পারে।
নতুন শোধনাগারের জন্য পানি সংগ্রহ করতে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের ভাণ্ডালজুড়ি বা অন্য কোনো এলাকা বেছে নিতে চায় ওয়াসা।
মাকসুদ আলম বলেন, কর্ণফুলী নদীর যে অংশে পুরো বছর পানির প্রবাহ ভালো থাকে এরকম স্থানে ‘ইনটেক’ তৈরি করা হবে।
“পরিশোধনাগার নির্মাণের জন্য মোহরায় (নদীর উত্তর পাড়ে) চট্টগ্রাম ওয়াসার নিজস্ব জমি আছে। ইনটেক থেকে মোহরার পরিশোধনাগারের নির্ধারিত স্থান পর্যন্ত পানি আনা হবে কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে।”
সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সময় পাইপলাইন নির্মাণসহ এই প্রকল্পের সম্ভাব্য খরচ নির্ধারণ করা হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই প্রকল্পে বিনিয়োগে এরই মধ্যে আগ্রহ দেখিয়েছে কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক।
“সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। ২০২৪ সালে শুরু করে ২০২৯ সালে এই প্রকল্প শেষ করতে চেয়েছিলাম আমরা। তবে এখনো সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়নি। তবে ২০২৫ সালে প্রকল্পের কাজ শুরুর বিষয়ে আশাবাদী।”
ওয়াসার এই উদ্যোগের বিষয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভূগর্ভের পরিবর্তে নদীর পানি পরিশোধন করা ভালো। কিন্তু নদী থেকে কতটুকু পানি উত্তোলনযোগ্য, সেটা আগে জানতে হবে।
“সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় কর্ণফুলী নদীতে পানির পর্যাপ্ততা বা ইকোলজিক্যাল ফ্লো (ই-ফ্লো) নির্ধারণ করাটা অত্যন্ত জরুরি। প্রকল্পের কারণে নদীর জীববৈচিত্র এবং ইকো সিস্টেমের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেটা আগে নিশ্চিত করতে হবে।”
তিনি বলেন, “কর্ণফুলী জোয়ার-ভাটার নদী। হয়ত পানি পরিশোধনের জন্য তুলে নিলে তা আবার জোয়ারের পানিতে পূরণ হবে। কিন্তু কতটুকু পানি দৈনিক নেওয়া হবে, সম্ভাব্যতা যাচাই না করে সেটা বলাটা ঠিক হবে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “এখনো দুটি প্রকল্পে দৈনিক ১৮ কোটি লিটার পানি কর্ণফুলী থেকে নেওয়া হয়। যে প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে, তাতে প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি পানি তোলা হবে দিনে। তাই এতে অবশ্যই নদী ও পরিবেশের প্রভাব বিবেচনা করতে হবে।”
আরও পড়ুন
হালদায় ওয়াসার আরেক প্রকল্প, পক্ষে-বিপক্ষে মত
পানি কমেছে কাপ্তাইয়ে, লবণ বাড়ছে হালদায়, সংকটে চট্টগ্রাম ওয়াসা
বৃষ্টি নেই, নদীতে শৈবাল, বন্দরনগরে পানির জন্য হাহাকার