পানি কমেছে কাপ্তাইয়ে, লবণ বাড়ছে হালদায়, সংকটে চট্টগ্রাম ওয়াসা

“চৈত্র-বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠে সচরাচর বৃষ্টি কম হয়। এ পরিস্থিতি চললে আগামী তিন মাস পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হবে,” বলছেন গবেষক ইদ্রিস আলী।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2023, 07:09 PM
Updated : 23 March 2023, 07:09 PM

চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে কাপ্তাই হ্রদের উজানে পর্যাপ্ত পানি নেই। ফলে সেখান থেকে পানি ছাড়া হচ্ছে খুবই কম, সেই স্বল্প পানি বিপরীতমুখী সাগরের পানিকে জোরাল বাধা দিতে পারছে না। ফলে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণ সাগরের নোনা পানি ঢুকছে হালদা নদীতে।

এই তীব্র লবণাক্ততার কারণে জোয়ারের সময় নদী থেকে পানি নেওয়া বন্ধ রাখছে চট্টগ্রাম ওয়াসার দুই পানি পরিশোধন কেন্দ্র। তাতে দৈনিক পানি পরিশোধন কমেছে প্রায় ৫ কোটি লিটার, আর চাহিদা অনুযায়ী পানি না পেয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে চট্টগ্রামবাসীকে।

উৎপাদন কমায় নগরীর হালিশহর, উত্তর কাট্টলী, পতেঙ্গা, বাকলিয়া, লালখান বাজার, শুলকবহর, আমানবাজার, আমবাগান, শেরশাহ, কালুরঘাট শিল্প এলাকা, চন্দনপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগের সংখ্যা ৭৮ হাজার ৫৪২টি, আর বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি।

চন্দনপুরা এলাকার বাসিন্দা শফিকুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পানিতে গত সপ্তাহ খানেক ধরে লবণ বেশি। আগের মতো পানিও সবসময় থাকছে না। রমজান শুরু হচ্ছে। তখনো এ অবস্থা চললে ভোগান্তি চরমে উঠবে।”

নগরীর লালখান বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. আজগর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত সপ্তাহে পানিতে ময়লা এসেছিল। এ সপ্তাহে ময়লা কিছুটা কমেছে। তবে পানি আগের চেয়ে কম দিচ্ছে।”

নগরীর পাথরঘাটার গুর্খা ডাক্তার লেইনের বাসিন্দা বাপ্পা ভট্টাচার্য বলেন, কখন পানি আসে তার ঠিক নেই। কখনও রাতে, আবার কখনও দিনে আসে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে পানিতে লবণের পরিমাণ বেশি। এখনও পানির স্বাদ নোনা।

ওয়াসা বলছে, এটা ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’, বৃষ্টি না হলে এই সংকট কাটবে না।

তবে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, বিকল্প রিজার্ভার বা পানির সরবরাহ নিশ্চিত না করে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া ‘অদূরদর্শী’ সিদ্ধান্ত। ভবিষ্যতে পানির সংকট আরও বাড়তে পারে।

কাপ্তাইয়ের পানিতে নির্ভরতা

১৯৬২ সালে কাপ্তাইয়ে নির্মিত কর্ণফুলী পানি ‍বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বর্তমানে ৫টি ইউনিটের উৎপাদন সক্ষমতা মোট ২৪২ মেগাওয়াট। উজানে পর্যাপ্ত পানি থাকলে সবগুলো ইউনিট চালু থাকে। কিন্তু এখন মাত্র একটি ইউনিট চালু আছে, যা থেকে বিদ্যুৎ মিলছে দিনে ২৫ মেগাওয়াট।

কাপ্তাই হ্রদের সর্বোচ্চ পানি ধারণ ক্ষমতা ১০৯ এমএসএল (মিন সি লেভেল)। এর বেশি হলে বাঁধ থেকে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। বুধবার কর্ণফুলী পানি ‍বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানিয়েছে, পানি আছে ৭৬ দশমিক ৮৬ এমএসএল।

কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এ টি এম আব্দুজ্জাহের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উজানে বৃষ্টি না হওয়ায় আমাদের এখানে পানি নেই। যে পানি আছে, তাতে একটি মাত্র ইউনিট চালু রাখা সম্ভব। সেটিও চালু রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি পরিশোধনের কথা বিবেচনায় রেখে।

“পানি ৭০ এমএসএলের নিচে নামলে সেটিও চালু রাখা সম্ভব হবে না। এ মাসের শেষ দিকে বৃষ্টি না হলে সেটিও চালু রাখা যাবে কি না বলতে পারছি না। সামনে গ্রীষ্ম মৌসুম, আগামী মাস দুয়েক পানি বাড়ার তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। পুরোটাই বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল, প্রাকৃতিক বিষয়।”

কাপ্তাই বাঁধ থেকে ছাড়া পানি তীব্র গতিতে এসে কর্ণফুলী নদী হয়ে সাগর থেকে আসা বিপরীতমুখী জোয়ারের লবণাক্ত পানির প্রবাহকে বাধা দেয়। ফলে হালদায় লবণ পানি কম ঢোকে। কাপ্তাই থেকে আসা পানি হালদাতেও প্রবেশ করে।

কিন্তু কাপ্তাই বাঁধ থেকে পানি কম পরিমাণে ছাড়ায় তা বিপরীতমুখী সাগরের পানিকে বাধা দিতে পারছে না। ফলে হালদায় সাগরের নোনা পানি ঢুকছে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণে। মূলত শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর-মার্চ) কাপ্তাই বাঁধ থেকে পর্যাপ্ত পানি ছাড়া না হলে হালদায় লবণাক্ততা বাড়ে।

ওয়াসার দুই প্রকল্পে উৎপাদন কমেছে

হালদা নদী যেখানে কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশেছে, তার আধা কিলোমিটারের মধ্যে মোহরা পানি শোধানাগার ফেইজ-১ এর জন্য দিনে ৯ কোটি লিটার পানি তোলা হয়।

দুই নদীর সংযোগস্থলের ছয় কিলোমিটার উজানে মদুনাঘাটের শেখ রাসেল পানি শোধনাগারের জন্যও দৈনিক ৯ কোটি লিটার পানি লাগে।

মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী সাদেক উদ্দিন চৌধুরী বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বুধবার পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ মিলেছে ৩০৬০ মিলিগ্রাম/লিটার। মঙ্গলবার তা ছিল ২৭০০ মিলিগ্রাম/লিটার। সাধারণত ৬০০ মিলিগ্রাম/লিটার থাকলে আমরা পরিশোধনের জন্য সেই পানি নিয়ে থাকি।”

এর আগে গত সপ্তাহে হালদা নদীর মোহরা অংশের পানিতে লবণাক্ত ছিল ১৯০০ মিলিগ্রাম/লিটারের মতো।

নির্বাহী প্রকৌশলী সাদেক উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “পরিশোধন শেষে যে পানি সরবরাহ করা হয় তাতে লবণের পরিমাণ থাকে ৩৫০ মিলিগ্রাম/লিটার। পরিস্থিতির কারণে আমরা জোয়ারের সময় এখন নদী থেকে পানি নিচ্ছি না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১০ ঘণ্টাই পরিশোধন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন প্রায় তিন কোটি লিটার কম হচ্ছে।”

মোহনা থেকে তুলনামূলক দূরে হওয়ায় নদীর মদুনাঘাট অংশে লবণাক্ততার পরিমাণ কিছুটা কম বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী সাদেক উদ্দিন চৌধুরী।

মঙ্গলবার মদুনাঘাট অংশে জোয়ারের সময় প্রতি লিটার পানিতে লবণের পরিমাণ ছিল ১৮০০ মিলিগ্রাম/লিটার। আগের দিন সোমবার তা ছিল ১১০০ মিলিগ্রাম/লিটার।

এ কারণে ওয়াসার এই প্রকল্পটিতেও দৈনিক উৎপাদন দেড় থেকে দুই কোটি লিটার কম হচ্ছে বলে জানান সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

ওয়াসার ভরসা এখন বৃষ্টিতে

চট্টগ্রাম ওয়াসার চার প্রকল্প ও গভীর নলকূপ মিলে পানি পরিশোধন ক্ষমতা ৫০ কোটি লিটার। এর মধ্যে কর্ণফুলী তীরের শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার-১ ও ২ থেকে দিনে আসে ১৪ কোটি লিটার করে মোট ২৮ কোটি লিটার।

মোহরা ও শেখ রাসেল পানি শোধনাগারের সক্ষমতা ৯ কোটি লিটার করে মোট ১৮ কোটি লিটার। আর নগরজুড়ে থাকা ৫০টি গভীর নলকূপ থেকে আসে ৪ কোটি লিটার পানি।

গত মঙ্গলবার নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডির সাথে দেখা করে নগরবাসীর পানির সংকট নিরসনে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছেন।

বুধবার স্থানীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিয়ে পানি উৎপাদন কমায় সরবরাহে ‘বিঘ্নের’ বিষয়টি উল্লেখ করে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেছে ওয়াসা। পাশাপাশি নগরবাসীকে পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে তারা।

জানতে চাইলে ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী এ কে এম ফজল্লুলাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি পরিশোধনের। অন্য সময় চাহিদা অনুসারে আমরা দৈনিক ৪৭-৪৮ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করি।

“এখন কাপ্তাই বাঁধ থেকে পানি কম ছাড়ায় উৎপাদন কমে ৪১-৪২ কোটি লিটারে দাঁড়িয়েছে। সচরাচর গভীর নলকূপের পানি মিশিয়ে বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা হয়। এখন শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় সেটাও পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের রেশনিং করতে হচ্ছে।”

ওয়াসা এমডি বলেন, “পুরো বিষয়টাই প্রাকৃতিক। বৃষ্টি না হলে কিছু করার নেই। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি।”

চট্টগ্রাম ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগের সংখ্যা ৭৮ হাজার ৫৪২টি, আর বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি।

জানতে চাইলে কর্ণফুলী নদী নিয়ে গবেষণা করা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওয়াসা কিন্তু পানি লবণমুক্ত করে না, শুধু পরিশোধন করে। অন্য পানির সাথে মিশিয়ে লবণাক্ততা কমিয়ে বাসাবাড়িতে সরবরাহ করে। তার পরও এখন পানিতে লবণের উপস্থিতি অন্য সময়ের তুলনায় বেশি।

“এখন সবে চৈত্র মাস চলছে। এরপর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ আরও দুই মাস আছে। এই সময়ে বৃষ্টির সচরাচর কম হয়। এ পরিস্থিতি চললে আগামী তিন মাস পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হবে।”

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, “অন্য সময় কাপ্তাই বাঁধের দুটি গেট খোলা রাখে শুষ্ক মৌসুমে। এবার পানি না থাকায় তাও সম্ভব হচ্ছে না। তাই আগে থেকেই যোগাযোগ করে বিষয়টা সমন্বয় করা দরকার ছিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাথে।

“কাপ্তাই বাঁধের ও হ্রদের পুরো বছরের তথ্য নিয়ে হালদায় দ্বিতীয় পানি শোধন প্রকল্পটি করা হয়েছিল কি না- এ প্রশ্ন তাই এসেই যায়। অন্তত শুষ্ক মৌসুমের ২-৩ মাসের জন্য বিকল্প রিজার্ভার রেখে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল।”

ভবিষ্যতে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে বন্দর নগরীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পানির চাহিদা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, বৃষ্টির স্বল্পতা, কাপ্তাই হ্রদের গভীরতা ফিরিয়ে আনা, কাপ্তাই বাঁধে পানির প্রাপ্যতা- এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ওয়াসা ও সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন পরিবেশবিদ মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী।