মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে পানি সরবরাহের লক্ষ্যে হালদা তীরে আরেকটি শোধনাগার করতে চায় চট্টগ্রাম ওয়াসা, যার পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে আপত্তি এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
Published : 28 Oct 2020, 08:11 PM
বিদ্যমান দুটি পানি শোধনাগারে হালদা নদী থেকে দিনে ১৮ কোটি লিটার পানি তোলা হয়। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি হলে দৈনিক আরও ১৪ কোটি লিটার পানি তোলা করতে হবে।
এতে শুষ্ক মৌসুমে হালদায় পানির প্রাপ্যতা কমে লবণাক্ততা বেড়ে প্রাকৃতিক এ্ই মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রে মা মাছের চলাচল ও ডিম ছাড়া বিঘ্নিত করতে পারে বলে এক পক্ষের মত।
আরেক পক্ষ বলছে, হালদা-কর্ণফুলীর সংযোগস্থলের কাছাকাছি থেকে নতুন প্রকল্পের জন্য পানি উত্তোলন খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।
তবে কাপ্তাই বাঁধ থেকে শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি না ছাড়ায় নদীটির পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে বলে একমত দু’পক্ষই।
পানি যাবে ৬৫ কিলোমিটার দূরে
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় ৩০ হাজার একর জমিতে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর’ স্থাপনে কাজ করছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
এই প্রকল্পে পানি সরবরাহের জন্য ৩৫৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪ কোটি লিটার শোধন ক্ষমতার ‘মোহরা পানি শোধনাগার ফেইজ-২’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় চট্টগ্রাম ওয়াসা।
হালদা নদীর মোহরা সংলগ্ন অংশ থেকে মিরসরাইয়ে শিল্প নগরের পানি পৌঁছে দিতে ৬৫ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপন করতে হবে।
শিল্প নগরে ২০৪০ সাল নাগাদ প্রয়োজনীয় সাড়ে ৯৬ কোটি লিটার পানির চাহিদা পূরণে মোহরায় ওয়াসার এই প্রকল্পের পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ভূগর্ভস্থ পানি, ফেনী-মুহুরী-সিলোনিয়া নদী, ছোট ফেনী নদী, ফেনী সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং সাগরের পানি ডিস্যালাইশেন প্ল্যান্টেরও পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ওয়াসার প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা ইন্সটিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
এরপর চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রকল্পটির এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট (ইআইএ) প্রতিবেদন জমা দেয় ওয়াসা। ওই প্রতিবেদন নিয়ে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অধিদপ্তরে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিচালক জমির উদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রকল্পের কারণে হালদা নদীতে ও আশেপাশে পরিবেশগত কী প্রভাব পড়বে, তার বিস্তারিত নেই। আলোচনায় উঠে আসা বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিবেদন দিতে ওয়াসাকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে।”
চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইডব্লিউএম আমাদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত নেয়নি। অনেক পুরনো তথ্য দিয়ে তারা প্রতিবেদন করেছে।
“শুষ্ক মৌসুমে এমনিতেই নদীতে পানি কমে যায়। আরও নিলে কী থাকবে? হালদা অন্য ১০টা নদীর মতো নয়। লিখিতভাবে আমরা মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে জানাব।”
হালদার কত পানি তোলা হয়
হালদা নদী যেখানে কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশেছে তার আধ কিলোমিটারের মধ্যে মোহরা পানি শোধানাগার ফেইজ-১ এর জন্য দিনে ৯ কোটি লিটার পানি তোলা হয়।
দুই নদীর সংযোগস্থলের ছয় কিলোমিটার উজানে মদুনাঘাট পানি শোধনাগারের জন্যও দৈনিক ৯ কোটি লিটার পানি লাগে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ দুটি প্রকল্প ছাড়াও হালদার উজানে ভুজপুর ও হারুয়ালছড়ি রাবার ড্যাম এবং ধুরং খালের বাঁধ আছে। আছে ১৮টি স্লুইস গেট এবং সাত্তারঘাটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্যারলাল ক্যানেল প্রকল্প।
“ইআইএ প্রতিবেদন অনুসারেই, পানি শোধনাগার ও সেচ প্রকল্পে প্রায় ৪২ কোটি লিটার পানি দৈনিক তোলা হয়। নতুন প্রকল্প হলে তা হবে ৫৬ কোটি লিটার। কিন্তু প্রস্তাবনায় শুধু পানি শোধনাগার প্রকল্পের পানির হিসাব দেওয়া হয়েছে।”
ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল আমীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে হালদা নদীতে পানির প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ৩০০ ঘনমিটার। এখন দুই প্রকল্পের জন্য তোলা হয় ২ দশমিক ২০ ঘনমিটার/সে। আর নতুন প্রকল্প হলে তা হবে মোট ৩ দশমিক ৮৮ ঘনমিটার/সে। তা মোট প্রবাহের ‘মাত্র’ ১ দশমিক ২৯ শতাংশ।
অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, আইডব্লিইএম যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তার ১৩৬ পৃষ্ঠায় ফেব্রুয়ারি-মার্চে পানির প্রবাহ দেখানো হয়েছে ১৯-২৫ ঘনমিটার/সে। ওই তথ্য সঠিক হলে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পানি তুলতে হবে।
“ওই প্রতিবেদনে ২০১৪ সালের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এবং এক জায়গায় একেক রকম তথ্য আছে।”
ওয়াসার ইআইএ প্রতিবেদন অনুসারে, দিনে ৫৬ কোটি লিটার পানি নেওয়া হলেও তা হবে হালদার মোট প্রবাহের ২ দশমিক ০৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে নদী গবেষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নদীর যে অংশে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে তা কর্ণফুলীর সাথে সংযোগের আধা কিলোমিটারের মধ্যে। সেখানে জোয়ার-ভাটার পানি আসা-যাওয়া করে। সেই পানিই নেওয়া হবে। এত অল্প পরিমাণ পানি পুরো সিস্টেমে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।”
বাঁধের প্রভাবে একমত
অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদার উজানে বাঁধ ও সেচ প্রকল্পের কারণে উৎসমুখ থেকে পানি প্রবাহ নেই বললেই চলে। কর্ণফুলী থেকে জোয়ারের পানি এবং কাপ্তাই বাঁধ থেকে ছাড়া পানি হালদার পানির উৎস।
“একারণে হালদায় লবণাক্ততার পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। আরেকটি প্রকল্পে পানি উত্তোলন করা হলে শুষ্ক মৌসুমে যখন কাপ্তাই বাঁধ থেকে পর্যাপ্ত পানি ছাড়া হবে না, তখন লবণাক্ততা আরও বাড়বে, যা মা মাছ ও ডিম ছাড়ার জন্য অনুকূল পরিবেশকে নষ্ট করবে।”
ওয়াসার সাবেক জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ এবং কর্ণফুলী ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্টের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মিলন কুমার চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কাপ্তাই বাঁধ থেকে তীব্র গতিতে আসা পানি কর্ণফুলী হয়ে আসা বিপরীতমুখী জোয়ারের লবণাক্ত পানির প্রবাহকে বাধা দেয়। কাপ্তাই থেকে আসা পানি হালদাতেও প্রবেশ করে।
“মূলত শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর-মার্চ) কাপ্তাই বাঁধ থেকে পর্যাপ্ত পানি ছাড়া না হলে লবণাক্ততা বাড়ে। গত তিন দশকে ২০০৭ সালে পানি সবচেয়ে কম ছাড়ায় লবণাক্ততা সবচেয়ে বেশি ছিল। ২০১৬ থেকে টানা তিনবছর শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা ছিল ৭২০ মিলিগ্রাম/লিটার (গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৬০০ মিলিগ্রাম/লিটার), যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার কাছাকাছি।”
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, কাপ্তাই বাঁধের পানি ছাড়া যদি নিয়মিত ‘মনিটর’ করা যায় তাহলে লবণাক্ততা তেমন বাড়বে না।
শিল্প নগর আর হালদা ‘দুটোই জরুরি’
ওয়াসা কর্মকর্তা মিলন কুমার চক্রবর্তী বলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
“নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে ভূমি অধিগ্রহণে। মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পে আগে থেকেই জমি অধিগ্রহণ করা আছে। তাই এ সময়টা বাঁচবে।”
২০২৫ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “ইকোলজিক্যাল ফ্লো স্টাডি না করে কোনো নদী থেকে কত পানি তোলা যাবে, তা বলা বিপজ্জনক। হালদা এমন কোনো নদী না, যার প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা আবার চাঙা করা যাবে।
“শিল্প নগর অনেক বড় প্রকল্প। বিকল্প পানির উৎসগুলো কার্যকর করাই উপযোগী। ওয়াসার প্রকল্পের বড় বাজেট তাদের আগ্রহের অন্যতম কারণ। হালদাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে।”
হাটহাজারীর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্য নদী থেকে প্রজনন মৌসুমে মা মাছ যে পথে হালদায় আসে সেখান থেকেই প্রকল্পের জন্য পানি তোলা হবে। এতে মা মাছ আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। অন্য বিকল্প ভাবাই উত্তম।”
তবে নদী গবেষক ইদ্রিস আলী বলেন, “মা মাছ মূলত (নদীর) গড়দুয়ারা থেকে সাত্তারঘাট অংশে ডিম ছাড়ে। শুধু লবণাক্ততার উপর ডিম ছাড়া নির্ভর করে না। বজ্রপাত, পাহাড়ি ঢল ও পানির গুণগত মানের মতো অন্য বিষয়গুলোও সেখানে প্রভাব রাখে।”
“প্রকল্পের সার্বিক বিবেচনায় কতটুকু প্রভাব এবং তার পাশাপাশি শিল্পাঞ্চল ও জাতীয় অর্থনীতির গুরুত্ব বিবেচনায় নিতে হবে,” বলেন তিনি।