“তরুণরা পর্বতারোহনে আসুক, এখানে ব্যক্তিগত দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ আছে। অদূর ভবিষ্যতে দেশের হয়ে দারুণ সব অর্জন সম্ভব হবে।”
Published : 24 May 2024, 09:10 AM
বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয়ের দুদিনের মধ্যে একই পবর্তমালায় চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ লোৎসে জয় করা বাবর আলী এখানেই থামতে চান না, আট হাজার মিটার উচ্চতার আরও শৃঙ্গ জয়ের লক্ষ্য এই অভিযাত্রীর।
২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয় পর্বতমালার নেপাল অংশে ছয় হাজার মিটার উচ্চতার ‘আমা দাবলাম’ শৃঙ্গে দেশের পতাকা ওড়ান চট্টলার এই দুঃসাহসী সন্তান।
লোৎসে জয়ের পর বুধবার বিকালে বেজ ক্যাম্পে পৌঁছান বাবর আলী, এখন সেখানেই আছেন। সেখান থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
হিমাদ্রি শিখর জয়ের অনুভূতি, স্বপ্ন ও তা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বেশ কিছু সময় কথা হয়েছে তার সঙ্গে।
আট হাজার মিটার উচ্চতার পবর্তশৃঙ্খগুলো সংক্ষেপে ‘আট হাজারি শৃঙ্গ’ হিসেবে পর্বতারোহীদের মধ্যে পরিচিত।
বাবর আলীর সঙ্গে আলাপ শুরু হয় ‘এভারেস্ট ও লোৎসে’ জয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে। কোনটি জয়ে আনন্দ বেশি, কী কী চ্যালেঞ্জ ছিল- কথা হচ্ছিল এসব নিয়ে।
মোবাইল ফোনের ওপার থেকে তিনি বলেন, “আমরা যারা পর্বতারোহণ করি, সবার স্বপ্ন থাকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ থেকে নিচের পৃথিবীকে দেখা। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তাতেই খুব খুশি।”
এ সময় বাবর আলীর কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা। তিনি বলছিলেন, “বেশি খুশি হয়েছি লোৎসে জয় করে। এটি টেকনিক্যালি খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। আর চ্যালেঞ্জিং নতুন কিছু করতে সব সময় পছন্দ করি। তাই বলতে হয়, লোৎসেই আমাকে বেশি আনন্দ দিয়েছে।”
হিমালয় পর্বতমালার তিব্বত ও নেপালের মধ্যবর্তী এলাকায় লোৎসে পর্বতশৃঙ্গ।
বাবর আলীর আগে পাঁচ বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করেছেন। তবে এভারেস্ট জয়ের সঙ্গে একই অভিযানে লোৎসে জয় করা প্রথম বাংলাদেশি বাবর আলী। এ পরিকল্পনা তার বেশ আগের।
তিনি বলেন, “২০২২ সালে যখন আমা দাবলাম সামিট (শৃঙ্গ) করি, তারপর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করত, এভারেস্টে কখন যাচ্ছি। তখন থেকেই এভারেস্ট সামিটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। নিজেকে যাতে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা যায়, নতুন কিছু করা যায়, তা চিন্তা করছিলাম।
“২০২৩ সালেই এভারেস্ট সামিট ছোয়ার লক্ষ্য ছিল। তবে সে সময় পড়ালেখার জন্য কিছু সময় দিতে হয়। তাই ২০২৩ সালে মিস করি। তখনই মাথায় আসে দুটো একসাথে করব। আগে বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন এভারেস্ট জয় করেছেন। তবে কেউ একই মিশনে লোৎসে জয় করেননি। তাই ভাবি, আমি সেটাই করব।”
২০১০ সাল থেকে পাহাড়ে চড়া শুরু চট্টগ্রামের হাটহাজারীর সন্তান বাবর আলীর। তার ১৪ বছরের মাথায় এভারেস্টে পা রেখেছেন। সবাই এখন তার প্রশংসা করছেন, ‘দেশের গর্ব’ বলছেন।
তবে পাহাড়ে চড়ার প্রথম দিকে বাবা-মায়ের কাছ থেকে কেমন সাড়া পেতেন, বাধা দিতেন কিনা; তা নিয়েও কথা হয় এ অভিযাত্রীর সঙ্গে।
বিষয়টি উঠতেই বললেন, বেজ ক্যাম্পে নেমে বুধবারই ফোনে মা-বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে। তার ভাষায়- সবাই খুব খুশি হলেও তারা যে কিছুটা চিন্তায় থাকেন, তা তিনি টের পান।
পর্বতারোহণে তো মৃত্যুঝুঁকিও আছে। তাই আনন্দের মাঝেও অপেক্ষায় থাকেন মা, কখন তার ছেলে ঘরে ফিরছে; কখন তিনি বুকে জড়িয়ে নেবেন, সেই অপেক্ষা, অধীর অপেক্ষা এখন।
শুরুটা কীভাবে? বাবর আলী বলেন, “দেশের অন্য সবার মত আমারও শুরু বান্দরবানে পাহাড়ে চড়ার মধ্য দিয়ে। ২০১২-১৪ সাল পর্যন্ত সেখানে প্রচুর ট্রেকিং করি। যেহেতু আমাদের এই স্পোর্টসে ঝুঁকি আছে, তাই যখন শুরু করি তখন পরিবার থেকে একটু বাধা পেতাম। পরে যখন দেখেছে, ভালো কাজ করছি; তখন আর সেভাবে বাধা আসেনি।”
এ পর্যায়ে বাবর আলীর কণ্ঠে ‘বিজয়ী হাসি’ শোনা যায়, কণ্ঠে ছিল দারুণ দৃঢ়তা।
কথা ওঠে ঝুঁকি নিয়ে। এভারেস্ট ও লোৎসের পথে কোনো বিপদ এসেছিল? জানালেন, এসেছিল; আড়াই ঘণ্টার তুষার ঝড় সহ্য করতে হয়েছিল।
বাবর আলী বলেন, “এভারেস্ট থেকে নামার সময় তুষার ঝড়ে পড়ি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা আটকে ছিলাম। তবে আমার প্রস্তুতি বেশ ভালো ছিল। তাই বড় ঝুঁকির মুখে পড়িনি। আর বেশ ঠান্ডা তো ছিলই, সেখানে এটাই প্রত্যাশিত।”
একটু বিলম্ব হলেও দমে যাননি চট্টলার এই সন্তান। তিনি বললেন, ১৯ মে এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছার পর ২০ মে লোৎসে যাওয়ার কথা ছিল। ওই তুষার ঝড়ের কারণে সময় নষ্ট হয়।
“বিকালে আবহাওয়া আরও খারাপ হয়। সেখানে বিকালের দিকে আবহাওয়া খারাপই থাকে। এ কারণে আর সেদিন রওনা হইনি। পরদিন লোৎসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।”
বাবর আলীর এভারেস্ট জয়ের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসার পাশাপাশি অন্য আলোচনাও কম হয়নি। দেশ থেকে একাধিক পর্বতারোহীর এভারেস্ট যাত্রা, সেখানকার পরিবেশ দূষণ ও খরচ-খরচা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
এ নিয়ে এখনই ভাবতে চান না নতুন লক্ষ্য পূরণের আশায় থাকা বাবর আলী। বুধবারই তিনি বেজ ক্যাম্পে নেমেছেন, সেটিও সমতল থেকে ১৭ হাজার ফুট ওপরে। পরিবার ও কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে তার। বৃহস্পতিবার বেজ ক্যাম্প থেকে নিচে নামা শুরু করার কথা।
“এখন ফেইসবুক বা অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ কম। আজ (বুধবার) সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি পোস্ট করেছি শুধু। আলোচনার বিষয়ে শুনেছি, দেখার সুযোগ হয়নি।”
আলোচনা-সমালোচনা যা-ই হোক, বাবর আলী চান তরুণরা পর্বতারোহণে আসুক। তার কথায়, “ফুটবল-ক্রিকেটের মত দলগত খেলার পাশাপাশি ব্যক্তিগত স্পোর্টসেও আমরা এখন খুব ভালো করছি। ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে যদি মাত্র ৪০-৫০ জন সিরিয়াসলি মাউন্টেনিয়ারিং করে, তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে কমই বলতে হবে।
“তরুণরা পর্বতারোহনে আসুক, এখানে ব্যক্তিগত দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ আছে। অদূর ভবিষ্যতে দেশের হয়ে দারুণ সব অর্জন সম্ভব হবে।”
বাংলাদেশ নামের যে ব-দ্বীপ, তা এক অর্থে হিমালয়েরই দান। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রসঙ্গটেনে বাবর আলী বলেন, “আমরা তো হিমালয়ের ছায়ায় বসবাস করি আসলে। হিমালয়ের দানই বলতে পারি আমাদের দেশকে। আমাদের যে বড় নদীগুলো- পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রসহ অনেক নদী হিমালয়ের নানা হিমবাহ থেকে আসা। এসব নদী হয়ে আসা পলি জমেই তো আমাদের ব-দ্বীপটির সৃষ্টি।
“সে হিসাবে আমাদের দেশ থেকে হিমালয় পর্যন্ত যাওয়া, একে খুব একটা বড় অভিযান বলা যায় না। তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে প্রভাব দেখতে হলে সবচেয়ে ভালে জায়গা হিমালয়। কীভাবে হিমবাহ সরে যাচ্ছে, গলে যাচ্ছে, লেক সৃষ্টি হচ্ছে; আমার মতে এসব পরিস্থিতি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে ভালো জায়গা হিমালয় পবর্তমালা।”
বেজ ক্যাম্প থেকে নামার পর আগামী ৭-৮ দিনের মধ্যে দেশে পৌঁছাতে পারেন বাবর আলী। আরও আট হাজারি পর্বতচূড়ায় ওঠার স্বপ্ন নিয়েই নিজের পেশায় সময় দিতে চান এবার। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বুড়িশ্চর এলাকার লেয়াকত আলী এবং লুৎফুন্নাহার বেগমের দ্বিতীয় সন্তান বাবর আলী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের ছাত্র। কিছুদিন জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করলেও আগের অভিযানের সময় ছুটি না পাওয়ায় চাকরি নিয়ে অনাগ্রহ জন্মেছে তার।
দেশে কিছুদিন বিরতি নিয়ে পেশায় ফেরার বার্তা দিয়ে তিনি বলেন, “আগে চাকরিই করতাম। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও এবং জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থার হয়ে কাজ করেছি। এবার বাবা-মায়ের চাওয়া অনুযায়ী নিজ এলাকায় প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করব।”
আর পর্বতারোহণ? আত্মপ্রত্যয়ী বাবর আলী বললেন, “শুনুন, পৃথিবীতে আট হাজারি পর্বত আছে ১৪টি। সব কয়টিতে হয়ত সম্ভব না, তবে আরও কয়েকটিতে চড়তে চাই। আগামী বছরই আরেকটিতে উঠতে চাই।”
সেই শৃঙ্গ কোনটি, তা অবশ্য বলেননি বাবর আলী। কিছুটা কৌতূহল জিইয়ে রাখাই যেন পছন্দ এ অভিযাত্রীর।
আরও পড়ুন:
এভারেস্টচূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন বাবর আলী
এভারেস্টজয়ী বাবর আলী এবার লোৎসে জয়ের অপেক্ষায়
এভারেস্টের পর লোৎসে জয়,অনন্য উচ্চতায় বাবর আলী