গল্প
হাতি যাচ্ছে বড় রাস্তা দিয়ে। তার পেছনে শয়ে শয়ে হাসি আনন্দে কোলাহলমুখর মানুষ।
Published : 26 Jun 2024, 10:31 AM
দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটায় ঠিক সকাল নয়টা বাজে। ছোটন স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। শার্ট-প্যান্ট পরা হয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর চুলে চিরুনি বোলাচ্ছে।
ঠিক তখন সে বাইরে থেকে বিরাট মিছিলের শব্দ শুনলো। স্লোগান আসছে, ‘হাতি এসেছে! হাতি এসেছে!’ পুরো ঘটনা বুঝতে ছোটনের বিশ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগলো না। বোঝার সাথে সাথে চিরুনি ছুড়ে ফেলে, স্কুলের জন্য গুছিয়ে রাখা বই হাতে ধরে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো।
হাতি যাচ্ছে বড় রাস্তা দিয়ে। তার পেছনে শয়ে শয়ে হাসি আনন্দে কোলাহলমুখর মানুষ। দৌড়ে বড় রাস্তায় পৌঁছে সে দেখতে পেল হাতি চলেছে রাজকীয় চালে। তার পিঠে একজন ছোটখাটো মানুষ বসে আছে ঠিক রাজার মতো পোশাক পরে। যদিও পোশাক বড় মলিন। ইনিই তাহলে হাতির মাহুত!
এটাই ছোটনের জীবনে প্রথম হাতি দেখা। ছোট বাচ্চারা চিৎকার করছে। বড়রা প্রশ্রয়ের হাসি হাসছে এবং কে কবে কোথায় কোথায় হাতি দেখেছে তার আলোচনা চলছে। হাতির সাথে হাঁটতে হাঁটতে বাজারের উপরে চলে আসলো ছোটন। হাতিটা বাজারে ঢুকেই কাসেম চাচার দোকানের সামনে দাঁড়ালো শুঁড় উঁচিয়ে।
চাচা হাসি মুখে বিশ টাকা হাতির সামনে ধরলেন। হাতিটা খুব সুন্দর কায়দা করে টাকাটা মাহুতের হাতে দিয়ে শুঁড় তুলে কাসেম চাচাকে সালাম দিলো। উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে। তালি যেন আর থামতেই চায় না। কাসেম চাচা হাতির সালাম পেয়ে অদ্ভুতভাবে হাসেন। সবার মধ্যে থেকে কাসেম চাচা এখন আলাদা হয়ে গেছেন। হাতি যে এই প্রথম উনাকেই সালাম দিয়েছে। হাতি এগিয়ে পাশের দোকানে যায়। ছোটনও মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে যায়। এই মুহূর্তে স্কুলের কথা বেমালুম ভুলে গেছে সে।
হঠাৎ তার দেখা হয় রিন্টু ও পল্টুর সাথে। তারাও বাজারে দাঁড়িয়ে হাতি দেখছে। তাদের হাতেও বই। তিনজনই এবার হোগলবাড়িয়া হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। বন্ধুদের একে অপরের সাথে দেখা হতেই মনে হলো, স্কুলে যেতে যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে!
কপালে দুঃখ আছে আজকে। গেমস্যার প্রচণ্ড রাগী মানুষ। অ্যাসেম্বলিতে কেউ এক মিনিট দেরি করে উপস্থিত হলেও কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। তিনজন একসাথে ‘এই চল, চল! অনেক দেরি হয়ে গেল রে। এমন সময় কেন যে এলো হাতিটা! ভালো করে দেখতেও পারলাম না’ বলতে বলতে হাতি ছেড়ে জোর পায়ে স্কুলের পথ ধরে। যদিও মনটা পড়ে থাকে হাতির কাছে।
বাজার থেকে স্কুল পুরো এক মাইল। তারা প্রতিদিন হেঁটে স্কুলে যায়। রাস্তায় আরো অনেকে মিলে বেশ বড় একটা দল হয়ে যায়। সবাই মিলে গল্প করতে করতে কখন যে তারা স্কুলে পৌঁছে যায়, টেরই পায় না। ছোটন বেশিরভাগ সময়ই মনোযোগ দিয়ে সবার গল্প শোনে, নিজে কথা বলে কম। কথা কম বলা বুদ্ধিমান শান্তশিষ্ট ছেলে ছোটন। যা ঠিক এই দশ-এগারো বয়সী বালকের মধ্যে বিরল চরিত্র।
কিন্তু আজ হাতি দেখে তার এতো ভালো লাগছে যে, বন্ধুদের সাথে অনবরত কথা বলেই যাচ্ছে। তার কথার বিষয় হলো হাতি এবং তাদের গ্রাম থেকে ছয়-সাত মাইল দূরের গ্রাম খলিশাকুন্ডি কলেজ মাঠে বসা সার্কাস দল। আশপাশের আট-দশটি গ্রামেও এখন মানুষের একমাত্র আলোচনার বিষয় সার্কাস। তাদের স্কুলের অনেকেই দেখেছে। অসাধারণ নাকি সব খেলা দেখায়। ত্রিশ টাকা করে টিকেট। এই সার্কাস না দেখলে জীবনই বৃথা, এমন মতামত দেখে আসা অনেকেই জানিয়েছে।
ছোটন একদিন তার আব্বাকে বলেছে, “আব্বা আমি সে সার্কাস দেখতে যেতে চাই।” তার আব্বা অবশ্য বলেছেন, “যেতে যখন ইচ্ছা হয়েছে, তখন তোমাকে নিয়ে যাবো বাজান। একটু ধৈর্য ধরো।”
কিন্তু আসলেই পারবেন কিনা সে বিষয়ে ছোটনের সন্দেহ আছে। এতদূর সে তো একা যেতে পারবে না, সাথে অবশ্যই আব্বাকে যেতে হবে। ছোট ভাই লাবুকেও বাদ দেওয়া যায় না। ছোট মানুষ, ওর ও তো সার্কাস দেখতে মন চায়। তাহলে বাকি থাকে শুধু মা। তাকে ফেলে কি যাওয়া যায়!
ছোটন হিসাব করে দেখেছে, চারজনের মোট লাগবে ১২০ টাকা। যাতায়াত খরচ না হলেও হয়। এতটুকু পথ হেঁটেই যাওয়া যাবে। তারপরও এতগুলো টাকা শখের পেছনে খরচ করা, তার গরিব চা দোকানি বাবার জন্য অনেক কষ্টের। তবে একটাই ভরসা আব্বা কথা দিলে কথা রাখেন।
বন্ধুদের হাসিমুখে ছোটন বলে, “জানিস আব্বা বলেছেন, সার্কাস দেখাতে নিয়ে যাবেন। সবে তো এলো। এখনও নাকি ১৫ দিন থাকবে।” রিন্টু বলে, “কালকে মামা এসেছিলেন। বিশ টাকা দিয়ে গেছেন। আর দশটা টাকা জোগাড় করতে পারলেই আমি একাই চলে যাবো সার্কাস দেখতে। তোদের মতো ভীতু না আমি। হু... ।”
কথা সত্য। রিন্টু ভীতু নয়। সহজে কাঁদে না। কোনো কাজে হাল ছাড়ে না। একমাত্র পড়াশোনার হাল সে কোন সময় ধরে না। তবুও কী করে কী করে যেন সব বিষয়ে পাশ করে উপরের ক্লাসে উঠে যায়!
এদের মধ্যে পল্টুদের অবস্থা সব থেকে খারাপ। সে নিজে ভালো করেই জানে ত্রিশ টাকা জোগাড় করে তার পক্ষে সার্কাস দেখা সম্ভব নয়। তার বাবা নেই। এই স্কুল ড্রেসটা মা যে কী করে সংগ্রহ করেছে তা পল্টু কি আর জানে না! জিদ করে অকারণে মার খাওয়ার কোনো মানে হয় না। মনটা একটু খারাপ হয় তার। পল্টুর দুঃখে বাকি দুজনেরও কষ্ট হয়।
তিন বন্ধু কথা বলতে বলতে পৌঁছে যায় স্কুলের গেটে। খুব বড় গেট। বড় বড় করে গেটের উপর লেখা ‘হোগলবাড়িয়া মোহাম্মদপুর হাজী ভরষউদ্দীন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। স্থাপিত ১৯৪৭ ইং।’
স্কুলের গেটে পা দিলেই কেন জানি ছোটনের মনটা ভালো হয়ে যায়। কত বড় আর কত সুন্দর স্কুল! আব্বার কাছে শুনেছে ষাট বিঘা জমির উপর এই স্কুল। তা হবে। খেলার মাঠই যে বড়! আর স্কুলের সামনের ফুলবাগান, পদ্মপুকুর, সারি সারি নারিকেল গাছ; সব মিলিয়ে খুব সুন্দর।
কিন্তু আজ ফুল বাগানের কাছে যেতেই ছোটনদের ভয়ে কলিজা উড়ে যাবার উপক্রম। অ্যাসেম্বলি শুরু হয়ে গেছে। পতাকা উত্তোলনও শেষ। দ্রুত পায়ে তারা গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির ছেলেদের লাইনের শেষ মাথায় দাঁড়ালো। গেমস্যার ঠিকই মাথা তুলে তাদের দেখে নিলেন। আল্লাহই জানে আজকে কী আছে কপালে!
চলবে...