প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে এক অভিযানে দুই শৃঙ্গ জয়ের অনন্য রেকর্ড গড়লেন চট্টগ্রামের এই পর্বতারোহী।
Published : 21 May 2024, 10:54 AM
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয়ের দুদিনের মাথায় চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ লোৎসের চূড়ায় পৌঁছেছেন বাবর আলী।
আর এর মধ্য দিয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এক অভিযানে হিমালয়ের দুই শৃঙ্গ জয়ের অনন্য রেকর্ড গড়লেন চট্টগ্রামের এই পর্বতারোহী।
পর্বতারোহনের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘ডাবল হেডার’। সফল অভিযান শেষে এবার দেশে ফেরার অপেক্ষায় চিকিৎসক বাবরের।
বাবর আলীর এভারেস্ট যাত্রার প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মঙ্গলবার ভোরে নেপালের স্থানীয় সময় ভোর ৫ টা ৫০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ৬টা ৫ মিনিট) বাবর আলী লোৎসে চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন।
এর আগে রোববার সকালে ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছান বাবর। এর মধ্য দিয়ে ১১ বছর পর বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আবার কোনো বাংলাদেশির পা পড়ে।
তার আগে ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করেন। তারা হলেন- মুসা ইব্রাহিম, এম এ মুহিত (দুবার), নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া নাজরীন ও মো. খালেদ হোসাইন।
এভারেস্ট থেকে নেমে এসে রোববার রাতে ক্যাম্প-৪ এ বিশ্রাম নেন বাবর আলী। তারপর সোমবার রাতে লোৎসের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
ফরহান জামান বলেন, “বাবর গত ১৯ মে ভোরে সামিট করেছেন মাউন্ট এভারেস্ট। বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। কারণ কোনো বাংলাদেশির এক অভিযানে দুটি ৮০০০ মিটারের বেশি উচ্চতার পর্বত সামিটের সাফল্য এটাই প্রথম।”
বাবর আলীর নিজের সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর ফেইসবুক পেইজে মঙ্গলবার সকালে এক পোস্টে লেখা হয়েছে, “আজ তিন দিন ধরে রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার হল অবসান। আমরাও পারি! আমাদের দিয়েও সম্ভব!
“এটিই এই বাংলাদেশের কোনো সন্তানের প্রথম লোৎসে সামিট এবং প্রথম একই অভিযানে দুটি আটহাজারি শৃঙ্গ সামিট। এই জাতি অন্তত একটা দিন আনন্দে মাতুক। তবে ভুললে চলবে না, বাবর এখন নেমে আসা শুরু করেছে। এবং বেজক্যাম্পে পৌঁছালেই হবে মূল উৎসব।”
বাবর আলীকে অভিনন্দন জানিয়ে এভারেস্ট জয়ী আরেক বাংলাদেশি নিশাত মজুমদার ফেইসবুকে লিখেছেন, “ভাই বাবর আলী, একসাথে দুই দুটি আট হাজার মিটারের চূড়ায় আরোহন। তুমি আমাদের জন্য নতুন একটি বেঞ্চমার্ক তৈরি করে দিলে।“
এ অভিযান পরিচালনা করছে ট্রেকিং ও পর্বতাভিযান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান স্নোয়ি হরাইজন। তাদের তত্ত্বাবধানে এভারেস্ট ও লোৎসে অভিযানে যান বাবর। এভারেস্টের মত লোৎসে অভিযানেও বাবরের সঙ্গে ছিলেন তার শেরপা বীর বাহাদুর তামাং।
ফরহান জামান বলেন, “লোৎসে সামিটের পর বাবর রেডিওতে সামিটের সংবাদ পাঠান বেজক্যাম্পে। বেজক্যাম্পের দায়িত্বশীলরা ওই খুশির খবর পৌঁছে দেন আমাদের কাছে।”
ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বাবর আলি জোড়া এই আট হাজারী পর্বত (এভারেস্ট এবং লোৎসে) শীর্ষ স্পর্শ করে বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছেন।”
যেভাবে হল লোৎসে জয়
রোববার সকালে এভারেস্ট জয়ের পর শীর্ষ চূড়া থেকে নেমে এসে ওই রাতেই লোৎসের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা ছিল বাবর আলীর।
সেই পরিকল্পনা ক্যাম্প-৪ এ ফিরে আসেন তিনি। এতে সময় লাগে প্রায় ১৪ ঘণ্টা।
স্বাভাবিকভাবেই বাবর ছিলেন ক্লান্ত। অভিযানের ধকল কিছুটা সয়ে নিতে তাই সিদ্ধান্ত বদল করেন। রোববার রাতে যাত্রা শুরু না করে ক্যাম্পে থেকে যান।
ফরহান জামান বলেন, “ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ বিভ্রাটের কারণে এই বিলম্ব যাত্রা নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। বিশ্রাম এবং পর্যাপ্ত ঘুমের পর সোমবার রাতে বাবর শুরু করেন তার চূড়ান্ত লক্ষ্য মাউন্ট লোৎসের উদ্দেশ্যে যাত্রা। অবশেষে ভোরে বাবর আলি স্পর্শ করেন কাঙ্ক্ষিত লোৎসে পর্বত শিখর।”
ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিহাব উদ্দিন বলেন, “একজন পর্বতারোহী একই অভিযানে দুটি শীর্ষ আট হাজারি পর্বত চূড়া আরোহণের এই সংবাদ বাংলাদেশেকে আন্তর্জাতিক পর্বতারোহণ অঙ্গনে অনেক বেশি সম্মানিত করবে। এই সম্মান ও গৌরব সারা বাংলাদেশের।”
বাবর ২৩ মের মধ্যে নিরাপদে বেজক্যাম্পে নেমে আসবেন এবং আগামী ৩ জুন দেশে ফিরবেন বলে আশা করছেন ফরহান জামান। বাবরের এই অভিযানে সহায়তাকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন তিনি।
গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলনে অভিযানের বিষয়ে জানান বাবর আলী। পরদিন ১ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে বাবর আলী নেপালের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে পৌঁছান লুকলাতে। সেখান থেকে পথচলা শুরু করে ১০ এপ্রিল বাবর পৌঁছে যান এভারেস্ট বেজক্যাম্পে।
এরপর ১৬ এপ্রিল সামিট করেন ২০০৭৫ ফুট উচ্চতার লবুচে ইস্ট পর্বত। তারপর নানা ধাপ পেরিয়ে বাবর আলী ১৪ মে মাঝরাতে বেজক্যাম্প থেকে শুরু হয় বাবরের যাত্রা।
প্রথম দিনেই সরাসরি উঠে যান ক্যাম্প-২ তে, যার উচ্চতা ২১ হাজার ৩০০ ফুট। পরিকল্পনা অনুসারে সেখানে দুই রাত কাটিয়ে বাবর ১৭ মে ওঠেন ২৪ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতার ক্যাম্প-৩ এবং ১৮ মে ওঠেন ক্যাম্প-৪ এ।
২৬ হাজার ফুট উচ্চতার ওই ক্যাম্পের উপরের অংশকে বলা হয় ডেথ জোন। অবশেষে ১৮ মে মাঝরাতে আবারো শুরু হয় যাত্রা, এবং ভোরের প্রথম কিরণে ২৯০৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্ট শীর্ষে উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের পতাকা।
২০১৪ সালে পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্লাব সতীর্থদের নিয়ে নেপাল এবং ভারতের বহু পর্বতে অভিযান করেছেন বাবর। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি সামিট করেছেন নেপালের আমা দাবলাম পর্বত।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বুড়িশ্চর এলাকার লেয়াকত আলী এবং লুৎফুন্নাহার বেগম এর দ্বিতীয় সন্তান বাবর ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১ তম ব্যাচের ছাত্র।
কিছুদিন জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করলেও আগের অভিযানের সময় ছুটি না মেলায় চাকরি ছেড়ে দেন।
এবারের অভিযানে মোট খরচ হচ্ছে ৪৫ লাখ টাকা। অভিযানের মূল পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছে ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার লিমিটেড।
এছাড়া সাতটি সহ-পৃষ্ঠপোষক সংস্থা, গণতহবিল এবং অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর সহযোগিতা নিয়ে এভারেস্ট ও লোৎসে জয়ের এ অভিযানের অর্থসংস্থান রয়েছেন বাবর।
পুরনো খবর
এভারেস্টচূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন বাবর আলী