একটি সমাজে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়েও শিক্ষার্থীরা দেহবিভ্রম এবং যৌনঅবদমন থেকে বের হতে পারেনি। অন্য সমাজটিতে সাধারণ মানুষেরা এটি থেকে বেরিয়ে মানবিক হয়ে উঠেছে শুধুমাত্র শিক্ষানীতিতে যৌন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার ভেতর দিয়ে।
Published : 22 Jun 2024, 06:55 PM
১.
স্টকহোম। পড়ন্ত বিকেল। কাজ শেষে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছি। ট্রেনের কামরাগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো। খোলামেলা। প্রতিটি কামরায় চারটি বসার স্থান, দুটি করে মুখোমুখি। বসে থাকা যাত্রীরা বেশ দূর পর্যন্ত পরস্পরকে দেখতে পায়। পাশের কামরাটিতে তিনজন পুরুষ বসে আছেন, একটি জায়গা খালি পড়ে আছে। এইমাত্র থেমে যাওয়া স্টেশনটি থেকে একজন মা তার ছোট শিশুটিকে নিয়ে ওঠেন এবং তিনজনের পাশের খালি জায়গাটিতে গিয়ে বসেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুটি মায়ের দুধ পানের আগ্রহ দেখায় এবং মা তৎক্ষণাৎ স্তন বের করে তার সন্তানকে দুধ পান করানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আশপাশের সবাই স্বাভাবিক।
এ দৃশ্যে আমার ভেতরের চাপা পড়া ঘা, জেগে ওঠা চরের মতো জাগতে থাকে।
২.
ঢাকায় থাকি। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাস। আমাদের বাচ্চার বয়স ৫৭ দিন। অনন্যা ওর নাম। কিছুক্ষণ পর পর ক্ষুধা লাগা আর কান্না করে জানান দেওয়াই ওর একমাত্র কাজ। কান্না করে ওঠার সাথে সাথেই বুকের দুধ পান করাই। ওকে নিয়ে কোনো জরুরি কাজে বাইরে গেলে বুকের দুধ পাম্প করে সঙ্গে নিয়ে যাই। একটু বেশি সময় ধরে বাইরে থাকতে হলেই পাম্প করে নিয়ে যাওয়া দুধ শেষ হয়ে আসে। তখন অস্থির হয়ে ভাবতে থাকি কোথায় বসে বুকের দুধ পান করাই ওকে? এক কোণায় জায়গা পেয়ে গেলেও কোনো পুরুষ দেখে ফেলল কিনা, সে কোন চোখে তাকাল, কী কথা ছুঁড়ে মারল— এসব নিয়ে লজ্জার শেষ থাকে না।
এভাবে চলতে থাকে আমাদের দিন। একরাতে হঠাৎ অনন্যার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ওই রাতেই ওকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই এবং বেশ কয়েকদিন পর ছাড়া পাই। এ ঘটনার পর থেকে প্রায় প্রায়ই ওর বুকে কফ জমে যায়। একবার ঠান্ডা লেগে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে আমাদের ছোট শিশুটি। ওকে নিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে যাই। আমার সাথে অনন্যার বাবাও আছে। চিকিৎসকের দরজার বাইরে কয়েক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছি আমরা। পাম্প করে আনা দুধ শেষ। অনন্যা কান্না করছে, ক্ষুধা লেগে গেছে আবার। চিন্তায় পড়ে যাই। কী করি এখন? কোথায় বসে বুকের দুধ পান করাই? অনন্যার বাবা এই কলেজেরই ছাত্র ছিল। আশপাশটা ওর পরিচিত। আমাকে একটি ঘর দেখিয়ে বলে, এখানে ছাত্ররা ক্লাস শেষে তাদের বই রাখে ও কাপড়চোপড় পরিবর্তন করে। তুমি এখানে বসে পান করাও, আমি আছি দরজার বাইরে। স্বস্তি পেলাম। কয়েক মিনিট পার হতেই হুড়মুড় করে একদল ছাত্র-ছাত্রী ঢুকতে থাকে ঘরটিতে। মনে হয়, কেবলই কোনো এক শিক্ষকের বক্তৃতায় অংশ নিয়ে এসেছে ওরা। আমাকে দেখে ছাত্রগুলো অন্যপাশটিতে জমা হতে থাকে। ভিড় করা ছাত্রদের উদ্দেশে এক ছাত্র বলে, তোরা পাশে যা এদিকে কেন? দু-একটি কণ্ঠস্বর উত্তর দিয়ে উঠে, ও পাশে হাতি দুধ খাওয়ায়। পাশ থেকে কয়েকজন হাসি-ঠাট্টা করে ওঠে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারি না। লজ্জায় সংকুচিত হই, চোখ ভিজে আসে, ভাবি ওরা কি চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ুয়া ছাত্র? দুগ্ধ পানরত বাচ্চাটিকে পান করানো গুটিয়ে ওখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসি এবং অনন্যার বাবাকে ঘটনাটি বলি। ও বলে, ‘আমিও শুনতে পেয়েছি।’ ডাক্তার দেখানো শেষ হলে বার বার করে বলতে থাকি, আমি প্রতিবাদ করতে চাই! ও বলে, আমাদের সন্তানের শরীর এত খারাপ, মন ভালো নেই, বাদ দাও! অনন্যার বাবা পরে আমাকে জানায়, ওই ছাত্রগুলো তখন শিশু বিশেষজ্ঞের বক্তৃতা শুনেই বের হয়েছে। আমি চুপ হয়ে যাই। ভেতরে তোলপাড়। এ ধরনের মনোভাব কোন মানুষের বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ুয়া ছাত্রদের থাকতে পারে? ধিক্কার!
৩.
বিষয়টি মাথায় জেঁকে বসে। একটি সমাজে মেডিকেল পড়ুয়া ছাত্ররা যারা কিছুদিন পরই চিকিৎসক হয়ে বের হবে তারা কেন দেহ, সেক্স ও নারী বিষয়গুলোকে পার্থক্য করতে পারছে না? অথচ অন্য সমাজটিতে সাধারণ মানুষেরাই এর পার্থক্য দেখতে পারছে এবং ওই অনুযায়ী আচরণ করছে, তাদের দেহবিভ্রম হচ্ছে না। একই বিষয় অথচ দুই সমাজে দুই দৃষ্টিভঙ্গি। দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্যের কারণ কি তাহলে ভিন্ন সমাজ? সমাজ কথাটি আসতেই এর সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে আরও দুটি শব্দ, পরিবার ও রাষ্ট্র। সমাজে থাকে হাজার হাজার পরিবার আর রাষ্ট্র পরিচিত হয়ে ওঠে পরিবার তথা সমাজের কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে।
ইউরোপের দেশগুলোতে পরিবারের একটি বাচ্চা দেখতে পায় তার মা, চাচি, খালা প্রয়োজনে জনসম্মুখে তাদের ছোট শিশুটিকে বুকের দুধ পান করাচ্ছেন আর মা, চাচি, খালাদের জীবনসঙ্গী তার বাবা, চাচা, খালু মায়েদের সহযোগিতা করছেন বা পাশে বসে সঙ্গ দিচ্ছেন। অন্য আট-দশটি স্বাভাবিক ঘটনার মতো এটিও জীবনের একটি অংশ বলেই জানছে বেড়ে ওঠা এ বাচ্চাগুলো। তাহলে কি পরিবার দিচ্ছে এ শিক্ষা? পরিবারগুলোই বা প্রথম কখন, কীভাবে পেল এই শিক্ষাটি? কে দিল, কোন পদ্ধতিতে এগিয়ে গেল তারা? রাষ্ট্র কি তবে ঘরে ঘরে যৌন শিক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের পাঠিয়ে এর সম্পর্কে সঠিক ধারণাটি দিয়েছে? ঘরে ঘরে লোক পাঠিয়ে বা কোনো মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের এ সম্পর্কে সুশিক্ষিত করে তোলা অতটা সহজ এবং কার্যকর হবার নয়। তবে প্রতিটি রাষ্ট্রে একটি মাধ্যম রয়েছে যার ভেতর সেই রাষ্ট্রের প্রায় সকল নাগরিক জন্মের কয়েকবছরের মধ্যেই ঢুকে পড়ে। এই মাধ্যমটিতে নাগরিকদের যৌনতা বিষয়ে জানানো হলেই সবাই পেতে পারে বিষয়টিতে সঠিক ধারণা। আর সেই মাধ্যমটি হলো শিক্ষা ব্যবস্থা।
সুইডেনে এ বিপ্লব সম্ভব হয়েছে তাদের শিক্ষানীতিতে সেক্স এডুকেশন তথা যৌন শিক্ষা যুক্ত করেছে বলে। শিক্ষা ব্যবস্থায় এটা যুক্ত করার অর্থই হলো একটি জাতির ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হওয়া। তাই এখানে একজন মা যখন উন্মুক্তস্থানে তার শিশুকে দুধ পান করিয়ে থাকেন কোনো পুরুষের সেক্সুয়াল ডিজায়ার ট্রিগার হয় না কারণ ওই পুরুষ ইতিমধ্যেই তার শিক্ষার ভেতর দিয়ে জেনে গেছে একজন মায়ের প্রজননে শরীরে কি ঘটে। একটি শিশুর ঠিক সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাতৃদুগ্ধ পাওয়া কতটা জরুরি এবং প্রকৃতি রক্ষার্থে এ চক্র কীভাবে ভূমিকা রাখে তা সাধারণ নাগরিকদের জানা হয়ে যায় তাদের শিক্ষার বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে।
৪.
কী রয়েছে এ শিক্ষানীতিতে যা সমাজের মানবিকতাকে উঁচুস্তরে নিয়ে গেছে? এদের শিক্ষানীতি এবং এখানকার শিক্ষকতার জগতে ঢুকে গেলেই এই বিপ্লবের পেছনের রূপরেখাটি দেখতে পাওয়া যায়। একটি শিশু যখন ডে কেয়ার সেন্টারে যায় তখন তার বয়স এক থেকে ছয় বছরের ভেতরে হয়ে থাকে। শিশুটিকে তার তিন বছর বয়স থেকেই ডে কেয়ার শিক্ষকরা বলে থাকেন শিশুটির শরীর তার নিজের অন্য কারোর নয়। তার বাবা-মা ছাড়া অন্য কেউ তার শরীর ধরার অধিকার রাখে না। শিক্ষকরা মনগড়া কথা বলেন না, সকল নিয়ম-কানুন শিক্ষানীতিতে দেয়া আছে যা তারা অনুসরণ করে থাকেন। সাত বছর বয়স থেকে শিশুরা স্কুল শুরু করে। প্রতিটি স্কুলে দিনের পুরোটা সময় জুড়ে বা দিনের কোনো অংশবিশেষে একজন নার্স এবং একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ থাকেন যারা শিক্ষার্থীদের প্রতি ছয় মাসে একবার সাক্ষাৎ করে থাকেন। তারা শিক্ষার্থীদের একজন একজন করে আলাদাভাবে ডেকে তাদের শরীর ও মনের ভালো-মন্দ লাগা নিয়ে কথা বলেন। শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হলে সুস্থতার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন নিয়মিত। ওই সময় থেকেই একটি বাচ্চা তার শরীর সম্পর্কে ধারণা পেতে থাকে। শিক্ষার্থীরা যখন ১৩ বছরে পৌঁছে যায়, তখন তারা সাধারণত সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। এ পর্যায়ে বিজ্ঞান পাঠে যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা হয় তা হলো— ছেলে-মেয়ে উভয়ের শরীরে এ বয়সে নতুন নতুন হরমোন তৈরি হয়, তাই শরীরে যেমন বাহ্যিক পরিবর্তন আসে তেমনি অনুভূতিতেও পরিবর্তন আসে। ছেলেদের দাড়ি গোঁফ জন্মায়, কণ্ঠের আওয়াজে পরিবর্তন আসে, শুক্রাণু তৈরি হয়। মেয়েদের মেনস্ট্রুয়েশন হয়। এটি কেন হয়, মেনস্ট্রুয়েশন হওয়াটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই এসব বিষয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, এসব ঘটতে থাকা জীবন চক্রেরই একেকটি অংশ, যা একেবারেই স্বাভাবিক।
স্কুল শেষ করে শিক্ষার্থীরা যখন কলেজে ঢোকে তখন তারা ১৬ তে পা রাখে। ষোলো থেকে আঠারো এ বয়সটিতে চলে তাদের কলেজ জীবন। এ সময়ে সাধারণত ওরা শিক্ষার তিনটি দিকের যেকোনো একটি বেছে নেয় ও লেখাপড়া এগিয়ে নিয়ে যায়। দিকগুলোর একটি হলো পিওর সায়েন্স, যেখানে যৌনাঙ্গসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গের নাম ও তাদের কাজ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। অন্য দুটো দিক হলো, অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞান। এ দুটো দিকেই ছাত্রদের জন্য সাধারণ বিজ্ঞান পাঠ বাধ্যতামূলক। বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও কেন এ বিষয় তাদের জন্য বাধ্যতামূলক? কী পড়ানো হয় এ বিজ্ঞানে যা এত গুরুত্বপূর্ণ?
এ বিষয়টিতে অন্য সব অধ্যায়ের সাথে থাকে যৌন শিক্ষা নামক কয়েকটি অধ্যায়। এ বিষয়ে তারা পড়ে মানুষ ও পৃথিবী, কোষ ও জেনেটিক্স, স্বাস্থ্য ও ভালো থাকা। স্বাস্থ্য ও ভালো থাকার ভেতরে আছে স্বাস্থ্য, আসক্তি ও মাদক এবং যৌনতা ও সহবাস। যৌনতা ও সহবাসে পড়ানো হয় যৌনাঙ্গের বিভিন্ন অংশের নাম, তাদের কাজ, যৌন আবেদন, হরমোনের কাজ, সেক্স, ভালোবাসা ও সম্মান, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, যৌনরোগ (কী কারণে এ রোগ হয়, তার প্রতিরোধ, প্রতিকার, অসুস্থ হলে একজন যুবক-যুবতী স্বাস্থ্য সেবা কোথায় নিতে পারে) ইত্যাদি। ছাত্ররা এ বিষয়টিতে পাস না করলে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয় না।
বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পিওর সায়েন্স পড়ছে না এমন একটি বৃহৎ ছাত্রগোষ্ঠীর জন্য এ সাধারণ বিজ্ঞানটি নেই যার কারণে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী নিজের শরীর সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে থাকে। ফলে তারা দেহ, সেক্স ও নারী বিষয়ে পার্থক্য করতে পারে না এবং প্রায় শতভাগ সময়ে এই তিনটি বিষয়কেই একটি জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়, তা হলো সেক্স। যেহেতু সুইডেনে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যৌন শিক্ষা জানছে জীববিজ্ঞান পড়তে গিয়ে তাই অন্যদেরকে অর্থাৎ জীববিজ্ঞান পড়ছে না এমন ছাত্রদের যৌন শিক্ষা জানার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে এই সাধারণ বিজ্ঞানটির ভেতর দিয়ে। যার ফলে প্রতিটি শিক্ষার্থীই যে যেই দিক থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পাস করে বের হোক না কেন, তারা প্রত্যেকেই এ শিক্ষাটি নিয়ে বের হচ্ছে তাদের আঠারো পূর্ণ হওয়ার আগেই। এভাবেই দেশটিতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি যৌন শিক্ষা নিয়ে পর্যায়ক্রমে বের হয়ে আসছে শুধুমাত্র শিক্ষানীতিতে এ শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে। এই সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়টি যুক্ত না করলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনারত বাকি দুই দিকের ছাত্ররা (অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞান) অর্থাৎ একটি বিশাল জনগোষ্ঠী নিজের শরীরের বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে পারত না। এ না জানা মানেই বিজ্ঞানমনস্ক হতে না পারা এবং মগজে কুসংস্কারকে গেঁড়ে রাখা।
৫.
যৌন শিক্ষা বিষয়টিকে খুবই বোল্ডলি পড়িয়ে থাকেন সুইডেনের শিক্ষকরা যার কারণে এটি ছাত্রদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে আসে। আমার এক সহকর্মী উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের যৌনতা বিষয়ে পড়াচ্ছেন। তার অনুমতি নিয়ে তার বক্তৃতা দেখতে শিক্ষার্থীদের পাশে ক্লাসরুমে বসি। অন্য একজন শিক্ষক কীভাবে ক্লাস নিচ্ছেন এ অংশগ্রহণ থেকে ভালো দিকটা শেখা যায় এবং নিজের মন্দটাও ধরা পড়ে। তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি বর্ণনা করছেন, মেয়েদের যোনিস্থানে সতী পর্দা বলতে কিছু নেই, যদি তোমার সাথে মিলনে তোমার নারী সঙ্গীর যোনিস্থানে রক্তপাত হয় তোমাকে বুঝতে হবে, তুমি তাকে আঘাত করেছ, যোনিস্থানের ত্বকের কোষগুলো ফেটে যাচ্ছে, রক্তনালিগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে তাই রক্তপাত হচ্ছে। ওখানেই আন্তঃভ্রমণ বন্ধ করে তাকে আলিঙ্গনে জড়াও। এভাবেই প্রকৃতিকে বুঝতে এবং পরস্পরকে সম্মান করতে শেখানোর রেখা টেনে দেয়া আছে এ সমাজের অর্থাৎ ইউরোপীয় দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থায়। এ ধরনের বিষয়গুলোতে একজন শিক্ষকের শিক্ষকতা করার আগে তিনি এ বিষয়টিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, যেমন পাঠের মাধ্যমে এ বিষয়ে জানানোর উদ্দেশ্য কী, কীভাবে পড়াবেন, কী কথা বলবেন, কতটুকু বলবেন, ব্যক্তিগত কোনো কথা টেনে আনা যাবে না, টানলেও কতটুকু বলবেন ইত্যাদি। যেহেতু শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রতিটি মানুষকে এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ধারণা দেয়া হয় তাই এটি জীবনেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে পুরো জাতি জানে।
৬.
একটি সমাজে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়েও শিক্ষার্থীরা দেহবিভ্রম এবং যৌনঅবদমন থেকে বের হতে পারেনি। অন্য সমাজটিতে সাধারণ মানুষেরা এটি থেকে বেরিয়ে মানবিক হয়ে উঠেছে শুধুমাত্র শিক্ষানীতিতে যৌন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার ভেতর দিয়ে। সুতরাং একটি জাতিকে মানবিক হতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক। এর বিকল্প নেই।
শিক্ষানীতিতে যৌন শিক্ষা বাধ্যতামূলক না হলে যুগের পর যুগ মায়েরা বয়ে চলবে চিকিৎসকদের দেহবিভ্রমের যন্ত্রণা, নারীরা মানসিক রোগী হয়ে ঘুরে বেড়াবে তার পুরুষ চিকিৎসকদের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে। সন্তান ক্ষুধায় কাতরালেও দুগ্ধ পানরত শিশুটির মুখ থেকে তার একমাত্র খাবার মায়ের বুকের দুধ কেড়ে নিতে হবে শুধুমাত্র জাতির যৌন শিক্ষার অজ্ঞতার কারণে।