মোটাদাগে বলা যায় আন্তর্জাতিক দুনিয়ার খবরের রাজ্যে মোড়লগিরি করা মূলধারার পশ্চিমা গণমাধ্যমসহ দুনিয়াব্যাপী অনেক বাঘা বাঘা মিডিয়ামুঘল বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই।
Published : 23 Jun 2024, 08:09 AM
দিন কয়েক আগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়টার্স ইনস্টিটিউট গণমাধ্যমের বাজার এবং পাঠক প্রবণতার উপর একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। সমীক্ষার মোদ্দা কথা হচ্ছে দুনিয়াব্যাপী মানুষ সংবাদ থেকে অর্থাৎ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এর বিপরীতে সামাজিক মাধ্যমে বিশেষ করে ফেইসবুক, ইউটিউব এবং টিকটকে মনোনিবেশ করছে। এর মধ্যে টিকটকের রমরমা সব থেকে উর্ধ্বমুখি।
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়টার্স ইনস্টিটিউট সাংবাদিকতা বিষয়ে শিক্ষা, বিতর্ক ও গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ অন্বেষণ নিয়ে কাজ করে থাকে।
দুনিয়ার সকল প্রান্ত থেকে বেছে নিয়ে ৪৭টি দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের উপর পরিচালিত এই সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি ১০ জনের চারজনই সংবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ৪৭টি দেশের এই তালিকায় এশিয়া প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের ১১টি দেশের মধ্যে স্থান পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, হংকং, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও থাইল্যান্ড।
পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায় বাংলাদেশ এই তালিকার বাইরে থাকলেও, এখানকার মানুষের সংবাদবিমুখ প্রবণতা সমীক্ষায় দেখানো ফলাফল থেকে ব্যতিক্রম হবার কোনো কারণ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ সংবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কেন?
অতীতের বছরগুলোর তুলনায় এই মুহূর্তে সংবাদবিমুখ হবার বড় কারণ হিসেবে ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং গাজার গণহত্যাকে উল্লেখ করা হয়েছে। সমীক্ষায় স্থান পাওয়া উপরোক্ত মন্তব্যের বিপরীতে বলা যায় যুদ্ধের কারণে কিংবা নির্বাচনের কারণে সংবাদের দিকে মানুষের মনোযোগ বাড়ার কথা। কিন্তু এর বিপরীত প্রবণতার কারণ কি?
এ প্রসঙ্গে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সমীক্ষায় যুৎসই তেমন কিছু চোখে পড়েনি। তবে মোটাদাগে বলা যায় আন্তর্জাতিক দুনিয়ার খবরের রাজ্যে মোড়লগিরি করা মূলধারার পশ্চিমা গণমাধ্যমসহ দুনিয়াব্যাপী অনেক বাঘা বাঘা মিডিয়ামুঘল বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। উল্লেখ করা যায় এই শতকের শুরুর দিকে ইরাকের উপর চাপিয়ে দেয়া মার্কিন-ব্রিটিশ যুদ্ধের সময় অভিযোগ রয়েছে পশ্চিমা অনেক গণমাধ্যম ছিল মার্কিনঘেঁষা। একপেশে প্রতিবেদন পরিবেশন করেছে এসব সংবাদ মাধ্যম।একই সঙ্গে পশ্চিমা গণমাধ্যম যুগযুগ ধরে পশ্চিমের বাইরের সঙ্গে খবরের নামে বর্ণবাদী প্রবণতা থেকে একদিকে যেমন পুরোপুরি মুক্ত থাকতে পারেনি, অন্যদিকে নানান দেশে সরকার পরিবর্তনে এবং রাজনৈতিক খবরদারির সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা খায়েশের অংশ হিসেবেও ভূমিকা রেখেছে।
এই পর্যায়ে প্রাক-গণমাধ্যম যুগে মানুষ কিভাবে খবরাখবর আদানপ্রদান করত সেই বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যায়। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পূর্বে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে খবরাখবর চলত বণিক বা সওদাগর মারফত। এক গঞ্জ বা বন্দরের বণিকরা আরেক অঞ্চলে সওদা বা পণ্যের সঙ্গে খবরও বইয়ে নিয়ে যেত। এর সঙ্গে বা পরে উপাসনালয়কেন্দ্রিক খবরাখবর আদানপ্রদানের ব্যবস্থাও চালু ছিল। উপাসনালয়ে এসে মানুষ প্রয়োজনীয় খবরটি দিয়ে যেত, লিখে যেত।
হরফ আবিষ্কারের পূর্বেও মানুষ যেমন ছিল, তাদের তেমন জীবনও ছিল। ঠিক ঠিক তাদের জীবন ও সমাজে খবরও ছিল। যা চলত মুখে মুখে। এই মৌখিক খবর প্রবণতা আমাদের দেশ কয়েক দশক আগেও চালু ছিল; আমাদের শৈশবে আমরা দেখেছি। গঞ্জ বা মফস্বল শহর থেকে কেউ এলে লোকজনকে আমরা জিজ্ঞেস করতে দেখেছি, কি খবর গো দেশের? হরতালের খবর কিছু পেলে? সাদ্দাম কি যুদ্ধে হারবে? তালেবানরা কি আমেরিকার সঙ্গে জিতে যাবে? রাশিয়া আর আমেরিকা কি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জড়াবে? এরশাদ কি পদত্যাগ করবে? খালেদা জিয়া কী ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে? শেখ হাসিনা কী ক্ষমতায় আসতে পারবে? এই প্রশ্নগুলো আমরা অনেকেই আমাদের নিজ নিজ গ্রামীণ জনপদে শুনে থাকতে পারি। এমন কি এক এলাকার ফকির মিসকিনরাও আরেক এলাকায় খবর বয়ে নিয়ে যেত। এই দৃশ্য আধুনিক গণমাধ্য়মের বিকাশের জমানাতেও ছিল, আমরা অনেকেই দেখে থাকতে পারি। তবে খবর বণিক বা সওদাগর, ফকির বা মিসকিন কিংবা পত্রিকা, বেতার বা দূরদর্শন কিংবা অনলাইন অফলাইন যে মাধ্যমেই আসুক তার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা চাই। মিথ্যা খবর বাপে দিলেও সন্তান বিশ্বাস করবে না। সেখানে গণমাধ্যমের অপেশাদারী অবিশ্বাসযোগ্য সংবাদে মানুষ কেন আস্থা রাখবে?
তবে হাল আমলের ডিজিটাল জৌলুসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক মাত্রায় 'অসামাজিক’ কটুআক্রান্ত হলেও তথ্য বা খবর বা 'অখবর' প্রচারে সংবাদমাধ্যমকে ছাপিয়ে গেছে। গণমাধ্যমের উপর বড় ধাক্কাটা এসেছিলো করোনোকালে ঘরবন্দি সময়ে। সেই ধাক্কা থেকে গণমাধ্যম এখনো বের হতে পারেনি। সেটা যে কেবল প্রযুক্তি বাস্তবতা তা কিন্তু নয়। মোটা দাগে মানুষ রুটিরুজির চাপে এতটা নাস্তানাবুদ সেখানে রাজনীতি, সমাজনীতি বা গণমাধ্যমের প্রতি তাদের মনোযোগ বৃদ্ধির কোনো হেতু খুব বেশি অবশিষ্ট নেই মানুষের সামনে ।
একটা প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই, আদতে গণমাধ্যম বলতে আমরা কি বুঝি? গণমাধ্যমের মোক্ষম উদ্দেশ্যই বা কি?
যে মাধ্যম মানুষের বা 'গণের' খবর লইয়া হাজির হয় তাই তো গণমাধ্যম হবার কথা। এরপরে খুব মামুলি প্রশ্ন, 'খবর' কি? যে বিত্তান্ত সত্য তুলে ধরে এবং মিথ্যা উন্মোচন করে তা খবর। কোনো তথ্য বা বিত্তান্ত যদি এর উল্টোটা করে অর্থাৎ সত্য প্রকাশের পরিবর্তে সত্য লুকিয়ে রাখে কিংবা মিথ্যা উম্মোচনের পরিবর্তে ধামাচাপা দিয়ে থাকে, তা তো আর খবর থাকে না। তা হয়ে যায় সামাজিক ব্যাধি বা রাষ্ট্রীয় ভণ্ডামি। এই কর্পোরেট রমরমা যুগে দেশে দেশে বেনিয়া নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম কী সত্য গোপন এবং মিথ্যা ধামাচাপার ভূমিকা পালন করছে না? এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে গণমাধ্যমে খবরের প্রতি মানুষ দিন দিন বিমুখ হচ্ছে কেন।
ইউরোপের কথাই ধরি। ইউক্রেইন এবং গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনেক সাংবাদিক নিগ্রহের শিকার হয়েছে। দুটো যুদ্ধের খবরেই ইউরোপ এবং এরপর বাইরের গণমাধ্যমের পরিবেশনায় বেমালা ফারাক। দেখা গেছে গণমাধ্যমের সমান্তরালে নানা প্ল্যাটফর্ম থেকে যুদ্ধ সংক্রান্ত খবর সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মূলধারায় প্রচারিত খবরগুলো কাঙ্ক্ষিত মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকারান্তরে তারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে ক্ষেত্রবিশেষে। সম্পর্কে বিশ্বাস খোয়া গেলে প্রেম আর প্রেম থাকে না। খবর পরিবেশনের বিষয়েও এই সত্য বিদ্যমান। খবর পরিবেশনকারীরা যদি বিশ্বাসযোগ্যতা ঠিক খুইয়ে থাকেন তাহলে মানুষ সেই খবর বিশ্বাস করবে কেন? মানুষ খবরমুখি হবে কেন?
ষোড়শ শতকে গণমাধ্যমের গোড়াপত্তন হলেও এর আগে এবং পরে খবরের প্রথম এবং শেষ শর্ত খবরকে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। একই সঙ্গে তা মানুষের প্রয়োজন ও কল্যাণে আসতে হবে। খবর পরিবেশন যদি যুদ্ধের কোনো পক্ষের স্বার্থ হাসিল করে, কারো ব্যবসার পালে হওয়া দিতে থাকে, কারো রাজনৈতিক ফন্দি হাসিলে কাজে দিতে থাকে, কারো চামচায়ে উজির নাজির হতে মুসাবিদা করে, কারো কর্পোরেট বাটপারি ধামাচাপা দিতে কাজে আসে, সেই খবরের প্রতি মানুষের মনোযোগ থাকবে কেন?
এখানে আরেকটি প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসতে চাই। গণমাধ্যমের মূল কাজ কী খবর পরিবেশন করা নাকি খবরকে বিনোদনের মসলা হিসেবে তুলে ধরা? 'বিনোদন বিষয়ক খবর' আর খোদ 'খবরকেই' বিনোদন হিসেবে পরিবেশন করার মধ্যে পার্থ্যক নিশ্চই আছে । আমাদের দেশের গণমাধ্যমের মুঘলরা বা সম্পাদকরা যদি এই ফারাক স্বীকার না করেন তাহলে কিছু বলার নাই।
একটা উদাহরণ দিতে চাই। একবার পদ্মাসেতু উদ্বোধনের আগে কোনো এক ছুটির দিনের সকালে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ছোটবোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে নির্মীয়মাণ পদ্মাসেতুতে পথ হেঁটেছেন। খবরটি গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে দেশের প্রায় সব কাগজেই। বেশ।
এর ঠিক অব্যবহিত পরে কোনো এক মধ্যরাতে ঢাকার চলচ্চিত্র অঙ্গনের উঠতি এক নায়িকা ইলিশ ভাজি আর খিচুড়ি খেয়েছেন পদ্মার পারে নির্মিতব্য সেতুর কাছে গিয়ে। সেই খবরটিও জাতীয় খবর হিসেবে প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে দেশের প্রধান একটি কাগজে। কাগজটির খবরের যে সমীকরণ তা কী কোন বিবেচনায় পেশাদারি সমীকরণ? আমি বুঝে পাই না।
স্বর্ণ চোরাচালানির সঙ্গে নাম জড়ানো কলকাতায় হত্যাকাণ্ডের শিকার সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের অপকর্ম নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র বরাবর। এরকম প্রশ্নের জবাবে মান্যবর মন্ত্রী সাংবাদিককে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, আপনারা এতদিন কোথায় ছিলেন? কি করেছেন? আপনাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এসব বিষয় এর আগে কেন বেরিয়ে এলো না? মোদ্দা কথা।
একইভাবে ২০০৭-২০০৮ সালে আলোচিত আধা-সামরিক জামানায় দেশের কোনো গণমাধ্যমই বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশন করতে পারেনি। অধিকন্তু সরবরাহ করা খবর যাছাইবাছাই ছাড়া হুবহু ছেপেছে। অথচ ঠিক সেই বিতর্কিত আমলের পরে একই শাসনামল সম্পর্কে দেশের গণমাধ্যম বিপরীত খবর ছাপা শুরু করল। এর কাছাকাছি বাস্তবতা বহুল কথিত 'হাওয়া ভবন' সংক্রান্ত খবর নিয়েও। ২০০৬ সালে জাতীয়তাবাদী-জামায়াত শাসনামলের পরে 'হাওয়া ভবন' নিয়ে অনেক খবর বেরিয়ে এল। কিন্তু এই গণমাধ্যমে ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত করলটা কি?
এই যে আনোয়ারুল আজিম, বেনজীর আহমেদ, আজিজ আহমেদ– তাদের বিষয়ে বিস্তর ইতিবাচক বাহারি খবর ছাপা হয়েছে, তারা যখন নিজেদের চেয়ারে বসে একের পর এক শনৈ শনৈ সাফল্যের চূড়ায় ছিলেন। তখনকার খবরগুলো আর এখনকার খবরগুলো পাশাপাশি রেখে পড়লেই বোধগম্য হবে মানুষ কেন খবর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। দোষ তো খবরের নয়, দোষ হল 'অখবরকে' খবর হিসেবে পরিবেশনায়। আমাদের গণমাধ্যম অসময়ের দশ ফোঁড় দিতে পটু। কিন্তু সময়ের এক ফোঁড় দিতে অপারগ অনেক ক্ষেত্রেই।
একই প্রশ্ন তুলতে চাই বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে। আজকের মন্ত্রী কালকে যদি ভাগ্য বিড়ম্বনায় পদ ও ক্ষমতার জৌলুস থেকে বিচ্যুত হন, তাকে ঘিরে খবরের মাজেজা কী উল্টেপাল্টে যাবে? নাকি একই রকম থাকবে? এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে রহস্যটা নিহিত আছে। এই রহস্যের ভেতরে মানুষ কেন খবর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তার হেতু কিছুটা খুঁজে পাওয়া যাবে।
খবরের কাগজ কেবল খবরের বাহক নয়। তা সাধারণ সাহিত্যের অবশ্যম্ভাবী অংশও। সেখানে সংবাদ পরিবেশনে, আর প্রকাশিত লেখাজোকায় যদি বুদ্ধিবৃত্তিক মুনশিয়ানা না থাকে তাহলে পাঠককে তা টানবে কেন? সংবাদ পরিবেশন কোনো রোবটিও বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্ট বা 'কৃত্রিম চুরিচামারি' বা 'কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তি'র বিষয় না। একসময় খবরের পরিবেশনার পাশাপাশি প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন ধ্রুপদী লেখকদের অনেকে। দেশে বিদেশে কালে কালে এরকম নামগুলো থেকে উল্লেখ করা যায় হেনরিক ইবসেন, আলবেয়ার কামু, অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শামসুর রাহমান, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সার, আহমদ ছফা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো লেখকদের।
দুনিয়াজুড়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর টাকা বাঁচানোর কৌশল হিসেবে প্রশাসনিক এবং সম্পাদকীয় ধারাকে গুলিয়ে ফেলেছে। এখন অনেক ক্ষেত্রে মালিক বা মালিকের প্রতিনিধি একই সঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সম্পাদক। এর মাধ্যমে পেশাদারি সংবাদ প্রকাশ ও পরিবেশন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে শুধু আমাদের দেশে নয়, দুনিয়ার অন্য প্রান্তেও গণমাধ্যমের কোনো কোনো অংশ বাজার সিন্ডিকেট বা রাজনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিলের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে। এতে করে পাঠকের মাঝে বিভ্রম তৈরি হয়। তারা সংবাদমাধ্যমের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এর মধ্যে ইরাকের বিরুদ্ধে পশ্চিমা গণমাধ্যমের সাম্রাজ্যবাদী দখলদারি গোষ্ঠীর পক্ষে উপর্যুপুরপুরী সাফাই গাওয়ার উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। সাদ্দামের হাতে কোনো বিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। এ সংক্রান্ত মিথ্যাচারের অভিযোগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে পরবর্তীসময়ে জবাবদিহির মুখে পড়তে হয়েছে।
দেশে দেশে অবৈধ টাকার মালিক কিংবা কর্পোরেট দুর্বৃত্তরা অনেক সংবাদমাধ্যমের মালিক। এসব সংবাদমাধ্যমকে তারা তাদের নিজেদের অপকর্মের পক্ষে ব্যবহার করে থাকেন। এরকম অভিযোগ এনে আমাদের এক সম্পাদক দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকা থেকে ইস্তফাও দিয়েছিলেন। অন্যদিকে কিছু কিছু সম্পাদক এবং মালিক দেশি বিদেশী নানা সংস্থার পক্ষে তথ্য সরবরাহ এবং জনমত প্রভাবের পক্ষে ভূমিকা রেখে থাকেন। অনেক সময় তারা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশও হয়ে যান।
তাড়াহুড়ো করে সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে গণমাধ্যমে সত্যতা যাচাইয়ে ঘাটতি প্রায়ই চোখে পড়ে। মিডিয়া ট্রায়াল বা 'গণমাধ্যমের বিচার' একটি ভয়ঙ্কর ব্যাধি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। সত্যতা যাচাই বাছাই ছাড়া এবং আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হবার আগেই গণমাধ্যম হরহামেশাই একজন ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে ছবি ছাপায়, পরিবারের বৃত্তান্তসহ সবকিছু উন্মুক্ত করে তুলে ধরে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত নানা সংস্থা নিজেদের খবরদারি আর বীরত্ব জাহির করার খায়েশে অভিযুক্ত নানা ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে থাকে। সংবাদমাধ্যম এসব আয়োজন দেদারসে গিলে গিলে খাচ্ছে এবং সংবাদমাধ্যমে পরিবেশন করছে।
সংবাদ পরিবেশনায় ভাষার শুদ্ধাশুদ্ধি এবং উৎকর্ষের বিষয়গুলো বেমালুম উপেক্ষা করা হচ্ছে। ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা সময়ে নিয়মের বালাই থাকছে না। কোনটা সংবাদ কোনটা সংবাদ নয় এই বোধ বিবেচনা সংবাদমাধ্যমগুলো অনেক সময় খুইয়ে বসে থাকে।
এরকম একটি বাস্তবতায় সংবাদের প্রতি মানুষের আস্থা না কমে বাড়ার কী কোনো কারণ আছে?