ভঙ্গুর, একরৈখিক এবং অসহনশীল সমাজের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য শিশুদের মন লিটমাস কাগজ হয়ে উঠছে। শিশুরা আসল অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। পারিবারিক বা সামাজিক পরিসর থেকে শিশুরা যা শিখছে তাই প্রকাশ করছে।
Published : 21 Jun 2024, 08:50 PM
শ্রেণিকক্ষে নিজের নাম নিয়ে সংকটে পড়েছে সূর্যিতা হাসান। সূর্যিতা হাসান ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক নামকরা স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী (শিশুটির সুরক্ষার বিষয় বিবেচনা করে স্কুলের নাম প্রকাশ করা হলো না)। সূর্যিতা হাসানের বয়স আট বছর। নামের কারণে সহপাঠীরা তাকে বুলিং করছে। সূর্যিতা হাসানের শ্রেণিপাঠ কঠিন হয়ে উঠেছে। অথচ নামটি সে নিজে রাখেনি। কিংবা বাবা-মা সূর্যিতা হাসান নাম রেখে কোনো অপরাধ করেননি। তবে কেনো সূর্যিতা হাসানকে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে?
সূর্যিতার গল্প কেবল একটি গল্প নয়। নাম নিয়ে অনেকেই জটিল পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। পড়ছেন বুলিংয়ের মুখে। মূল বিষয় নামের ধর্মীয় পরিচয়।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির অফিসে কর্মরত মানবাধিকারকর্মী জাহিদ হোসেন সম্প্রতি তার কন্যার নাম নিয়ে ফেইসবুকে বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন। কন্যার নাম প্রাপ্তি আনন্দিতা।
শিশুরা কেন নামের ভেতর ভিন্ন ধর্ম খুঁজছে? ধর্ম চিহ্নিতকরণ শিশুদের কাছে এত জরুরি হয়ে উঠল কেন? কেন তারা আলাদা করতে চাচ্ছে? কোথা থেকে শিশুরা সমধর্মী, সমভাষা, সমশ্রেণি, সমরং নিয়ে বেড়ে ওঠার প্রেরণা পাচ্ছে? এর উত্তর আমাদের একেবারে অজানা নয়। ভঙ্গুর, একরৈখিক এবং অসহনশীল সমাজের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য শিশুদের মন লিটমাস কাগজ হয়ে উঠছে। শিশুরা আসল অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। পারিবারিক বা সামাজিক পরিসর থেকে শিশুরা যা শিখছে তাই প্রকাশ করছে।
শিশুরা স্কুলে যায় মূলত পাঠ্যবই পড়তে। কিন্তু স্কুলে শিশুরা যা শিখছে তাকে শাসাচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা। বিদ্যায়তনিক শিক্ষার হার বাড়লেও সামাজিক ক্ষয় ও ক্ষরণরোধে তা নিয়ামক হয়ে উঠছে না। দিন শেষে পারিবারিক বা সামাজিক শিক্ষার নির্যাস শিশুর মনোজগৎ গঠন করছে।
অপরিণত বয়সে শিশুরা ধর্ম চিহ্নিতকরণের যে প্রণোদনা পাচ্ছে তা এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যে বয়সে শিশুদের সংযুক্তিমূলক মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠার কথা সেখানে তারা শিখছে বিভক্তির ভাষা। অথচ শিশুরাই আগামীর অগ্রনায়ক। অন্তর্ভুক্তিমূলক মন নিয়ে তাদের বেড়ে ওঠাটা খুব জরুরি।
মনোবিজ্ঞানী আলবার্ট বান্দুরা তার সামাজিক শিখন তত্ত্বে বলেন, মানুষ মূলত পর্যবেক্ষণ ও রোল মডেল অনুসরণের মাধ্যমে শিখে থাকে। শিশুদের জন্য প্রাথমিক রোল মডেল তাদের পিতা-মাতা ও শিক্ষক। রোল মডেল হিসেবে পিতা-মাতা ও শিক্ষক সবসময় যে যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন– এমনটি নিশ্চিত করে বলা যাবে না। অভিভাবক ও শিক্ষকেরা তাদের পছন্দগুলো শিশুদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। যা শিশুদের মনোজগৎকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
আমেরিকান বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার গড ডিলিওশন গ্রন্থে প্রশ্নটি তুলেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, সন্তানদের ওপর পিতা-মাতা যে কর্তৃত্ব ফলান তার বৈধতা প্রশ্নের বাইরে নয়। এখন বিষয় হলো শিশুদের মনে যে ক্লেদ জমছে, অভিভাবক বা শিক্ষক তার দায় কী এড়াতে পারবেন? শিশুদের কী শেখানো হচ্ছে, কী চর্চা করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে তা কি খতিয়ে দেখা হচ্ছে?
সূর্যিতা হাসানের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। সূর্যিতাকে সহপাঠীরা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তুমি ‘হিন্দু’। কারণ, তোমার নাম সূর্যিতা। সূর্যিতা প্রতিউত্তরে বলেছে, আমার নামের শেষে তো হাসান রয়েছে। সূর্যিতা শব্দটি কীভাবে হিন্দু হলো তা তো আমি বুঝতে পারছি না। সূর্যিতা হাসান সহপাঠীদের নিশ্চিত করেছে সে মুসলিম পরিবারের সন্তান। তারপরও সহপাঠীরা তাকে হিন্দুধর্মের মনে করছে কেন? সহপাঠীদের সহজ উত্তর, ওই যে তোমার নাম সূর্যিতা।
এত অল্পবয়সের শিশুরা সূর্যিতা শব্দের ওপর অর্থারোপ করতে শিখল, তাকে হিন্দু ধর্মের স্মারক করে তুলল! এ শিক্ষা তারা কোথা থেকে পেল? কারও শব্দ পক্ষপাত থাকতে পারে। অন্যরা কী শব্দ পছন্দ করবেন, ব্যবহার করবেন, নামাঙ্কিত করবেন তা ব্যক্তির নিজস্ব এখতিয়ার ও পছন্দের বিষয়। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা কোনো রুচিশীল বা সংস্কৃতিবানের পরিচয় হতে পারে না। কিন্তু ওই ধরনের উপদেশ সামাজের নানা পর্যায় থেকে শুনতে হচ্ছে। কারণ, পরামর্শনির্ভর এক সমাজের ভেতর আমরা ঢুকে পড়েছি। নিজে সঠিক, অন্যরা সবাই ভুল এমন বিশ্বাস প্রবল হচ্ছে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে অন্যকে সংশোধনের দায়িত্ব কাঁধে নিতে অনেকেই আনন্দবোধ করছেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠেছে রুটিন, ধারবাহিকতা ও বেতন-টিউশন এবং আয়-রোজগারের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। তাদের শ্রেণিকক্ষের গভীর ক্ষতগুলো উঁকি দিয়ে দেখার ইচ্ছে ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা যায়। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈচিত্র্যময় শিক্ষাদর্শনের মর্মবাণী শিশুদের কতটা স্পর্শ করছে তা জানাটাও জরুরি। শিক্ষাক্রমের সূচনাপর্ব থেকে শিশুদের মধ্যে যেভাবে বিভক্তি ও সংখ্যাধিক্যের মতবাদগুলোকে প্রধান করে তোলা হচ্ছে তা উদ্বেগজনক।
বুলিংয়ের শিকার সূর্যিতা হাসানের মনোদৈহিক কিছু পরিবর্তন এসেছে। শ্রেণিকক্ষে অভিযোজন বাড়াতে নিজেকে ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটগুলোর ওপর সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিওগুলো দেখা বাড়িয়ে দিয়েছে। ইসরায়েলি পণ্য বর্জন করছে।
কেবল তাই নয় খাতাপত্রে ফিলিস্তিনি পতাকা, আহত-নিহত শিশুদের ছবি আঁকা শুরু করেছে। এগুলো সূর্যিতা সহপাঠীদের সঙ্গে শেয়ার করছে। মুসলিম হিসেবে নিজের পরিচয় শক্তভাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। এতে শ্রেণিকক্ষে সূর্যিতার অভিযোজন যে বেড়েছে তা নয়।
সূর্যিতা হাসান শ্রেণিকক্ষে বুলিং পরিস্থিতি বাবা-মাকে জানিয়েছে অনেক পরে। প্রথমে সে নিজে পরিস্থিতিটি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে, সহপাঠীদের সবাই সূর্যিতাকে বুলিং করছে না। কোনো কোনো সহপাঠী সূর্যিতার প্রতি সহানুভূতিশীল। সূর্যিতাকে যারা বুলিং করছে ওইসব শিশুদের সংখ্যা খুব বেশি নয়— পাঁচ কী ছয় জন। কিন্তু এসব শিশুরা বেশ সংঘবদ্ধ।
একটি কৌশল সূর্যিতা অনুসরণ করেছে, তা হলো উপহার হিসেবে পাওয়া হিজাব গোপনে স্কুল ব্যাগে নিয়ে যায় এবং ভ্যান গাড়িতে চড়ার পর তা পরে নেয়। বাসাতে ফেরার সময় আবার তা ব্যাগে পুরে নেয়। মুসলিম পরিচয় দৃঢ়করণের সর্বান্তকরণে চেষ্টা করছে। যাতে সংকটটি কাটিয়ে উঠতে পারে, সহপাঠীদের মধ্যে একটু ঠাঁই পায়।
সূর্যিতা হাসানের বাবা-মা জানান, বুলিংয়ের কারণে সূর্যিতা নিজের প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করে। বাসায় এসে বেশিরভাগ সময় সে মূঢ় থাকত। স্কুলে যাওয়ার সময় হলে তার ভেতর অস্থিরতা কাজ করত। সূর্যিতা হাসানের বাবা শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছেন। সূর্যিতার জন্য অনুকূল শিক্ষাপরিবেশের জন্য সহযোগিতা চেয়েছেন। বাবা-মার কাউন্সিলিংয়ের ফলে সূর্যিতা ট্রমা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।
সূর্যিতার বাবা-মা জানান, সূর্যিতা শুরুর দিকে আত্মরক্ষামূলক কৌশল নিলেও এখন সে প্রতিরক্ষামূলক কৌশল অনুসরণ করছে। সে শ্রেণিকক্ষে কথা বলছে, স্বাভাবিক ড্রেসকোডে ফিরে এসেছে, সহপাঠীদের সঙ্গে আস্থার সঙ্গে কথা বলছে। সূর্যিতা ফিরে আসার চেষ্টা করছে।
শিক্ষক ও স্কুল কর্তৃপক্ষের নজরে হয়তো বুলিংয়ের ব্যাপারটি পড়েনি। স্কুল কর্তৃপক্ষকে যেতে হবে পাঠ্যক্রমের বাইরে। শ্রেণিকক্ষে সহপাঠীদের মধ্যে কী ধরনের মিথস্ক্রিয়া হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। প্রতিটি শিশুর জন্য নির্মল, আনন্দদায়ক ও মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।