হত্যাকাণ্ডের দিনই মুছার সঙ্গে বাবুলের কথোপকথনের বিষয়টি শুনি: জেরায় মিতুর বাবা

বাবুল আক্তারের আইনজীবী বলছেন, “মিতুর বাবা যা বলছেন, তা আগে কখনও কোথাও বলেননি। ফলে এই বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য।”

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 May 2023, 06:27 AM
Updated : 9 May 2023, 06:27 AM

সাত বছর আগে চট্টগ্রামের মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকাণ্ডের দিনই তার স্বামী বাবুল আক্তার ও আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছার কথোপকথনের বিষয়টি মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন জেনেছিলেন বলে আদালতে দাবি করেছেন।

আলোচিত এ মামলায় সোমবার চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে জেরার জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

তবে আসামি বাবুল আক্তারের আইনজীবীর ভাষ্য, “মোশাররফ হোসেন আদালতে যা বলছেন, তা আগে কখনও কোথাও বলেননি। ফলে তার এসব বক্তব্য আইনের বিবেচনায় ‘গ্রহণযোগ্য নয়’।”

মিতু হত্যা মামলার বিচারের প্রথম সাক্ষী তার বাবা মোশাররফ হোসেন। সোমবার আদালতে বেলা ১টায় তার জেরা শুরু করেন বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী। মাঝখানে সোয়া এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে জেরা চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। পরে আদালত বুধবার শুনানির পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেন।

আইনজীবী কফিল উদ্দিন সাক্ষী মোশাররফ হোসেনের কাছে জানতে চান, “আপনি আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে বলেছেন, মিতুকে হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করে আসামি মুছা মূল পরিকল্পনাকারী বাবুল আক্তারকে ফোন করে। তখন বাবুল বলেন, ‘কোপাইলি কেন?

“তবে আপনি যে মামলা করেছিলেন, তার এজাহারে এই কথা উল্লেখ করেননি। ‘কোপাইলি কেন’- এই রেকর্ড আপনি শুনেছেন? এ কথা আপনাকে কে বলেছে? আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার আগে কোথাও লিখিতভাবে এটা জানিয়েছেন?”

জবাবে মোশাররফ আদালতকে বলেন, মুছা ও বাবুলের কথোপকথনের বিষয়টি তিনি নিজের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেননি। কথোপকথনের রেকর্ডও তিনি শোনেননি।

তিনি বলেন, “কথোপকথনের এ কথা পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে জানি। কে বলেছে তা স্মরণে নেই। ঘটনার দিনই শুনেছি। তবে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার আগে কোথাও লিখিতভাবে এ বিষয়ে জানাইনি।”

সোমবার জেরা শেষে জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “মুছার কনভারসেশনটা (বাবুলের সঙ্গে) সবাই জেনেছে। এভাবে প্রকাশ হয়েছে। পুলিশ-মিডিয়া সবাই জানছে। কিন্তু এটা রেকর্ডে (মামলার) নাই। আমি আমার এজাহারে উল্লেখ করি নাই।

“এটা তো অনেক পত্রিকায় আসছে, ‘তুই কোপাইলি কেন? বলছিলাম গুলি করতে’। ওরা (আইনজীবীরা জেরায়) এভাবে জিজ্ঞেস করেননি। বলেছে, আমি এজাহারে বলেছি কিনা, প্লাস আমি কার কাছে শুনছি? মুসার কনভারসেশন তো আমার শোনার কথা না। এটা ‍মুসা এবং বাবুল আক্তার বলতে পারবে। আংশিক পার্ট মুসার স্ত্রী বলতে পারবে যে, মুসার সঙ্গে বাবুল আক্তারের কী কথা হয়েছে।”

জানতে চাইলে বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুসা-বাবুলের কাল্পনিক কথোপকথনের কথা মোশাররফ হোসেন কোনোদিন কোথাও বলেননি। প্রশ্ন করেছি, তিনি নিজে শুনেছেন কিনা? সেটাও শোনেননি। কার থেকে শুনেছেন, সেটাও মনে নেই। এসব বক্তব্য হাওয়া থেকে পাওয়া।”

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় সড়কে খুন হন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু। এরপর ঢাকা থেকে গিয়ে পরদিন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন তিনি।

হত্যাকাণ্ডের পর জামাতা বাবুলের পক্ষেই ছিলেন তার শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ। বাবুলও তার ছোট দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে উঠেছিলেন ঢাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে।

এরমধ্যে ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশ বাবুলকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং বাবুলের পুলিশের চাকরি ছাড়ার পরও তার পক্ষেই ছিলেন মোশাররফ।

পরের বছর বাবুল ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাসায় যাওয়ার পর জামাতাকে নিয়ে সন্দেহের কথা বলেন মোশাররফ। এরপর সরাসরি অভিযোগি করেন।

তখন তিনি বলেছিলেন, বাবুলের এক নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। তার পরিণতিতে মিতু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নানা নাটকীয়তা শেষে পিবিআইয়ের তদন্তে এখন বাবুল আক্তারই এ মামলার আসামি।

২০২১ সালের মে মাসে পিবিআই জানায়, মিতুকে হত্যা করা হয়েছিল বাবুল আক্তারের ‘পরিকল্পনায়’। আর এজন্য খুনিদের লোক মারফত তিন লাখ ‘টাকাও দিয়েছিলেন’ বাবুল।

পিবিআই বাবুলের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর মিতুর বাবা আরেকটি মামলা করেন। তবে আদালতের নির্দেশে সেই মামলার সমাপ্তি ঘটে এবং বাবুলের মামলাটিই পুনরুজ্জীবিত হয়।

এ বছরের ৯ এপ্রিল প্রথম সাক্ষী মিতুর বাবা মোশাররফের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাবুলসহ সাত আসামির বিচার শুরু হয়।

মামলার বাকি আসামিরা হলেন- মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, এহতেশামুল হক ভোলা, শাহজাহান মিয়া, কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছা ও খায়রুল ইসলাম।

দীর্ঘ জেরা

সোমবার দিনের কার্যক্রমের শুরুতে বাবুলের আইনজীবী কফিল উদ্দিন উচ্চ আদালতের একটি মামলার রায় ও ডিএলআর (ঢাকা ল রিপোর্টস) উল্লেখ করে মিতু হত্যার ঘটনায় মোশাররফ হোসেনের করা দ্বিতীয় মামলা, সেটি নিয়ে কিছুদিন তদন্ত হওয়া এবং সেই তদন্তে প্রাপ্ত বিষয়াবলী প্রথম মামলায় সংযুক্ত করা বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে একটি আবেদন জমা দেন।

এসময় বিচারক বলেন, “প্রথম এফআইআর এর উপর মামলা চলছে।” 

মোশাররফ হোসেনের আইনজীবী আহসানুল হক হেনা বলেন, “দেয়ার ক্যান বি টু এফআইআর ইন আ কেইস। আমরা শুনানি করব। সময় চাই।” রাষ্ট্রপক্ষও এ বিষয়ে পরে শুনানির সময় চাইলে আদালত সময় দেন।

এরপর জেরার জবাবে মোশাররফ হোসেন জানান, ২০২১ সালের ১২ মে পুলিশকে জমা দেওয়ার আগ পর্যন্ত ‘তালিবান’ ও ‘বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট’ নামের বই দুটি ২০১৫ সাল থেকে তার কাছে ছিল।

তিনি জানান, ২০২১ সালের ১১ মে দুপুর ১২টার দিকে তিনি পিবিআই অফিসে যান। সেদিন সন্ধ্যার পর সেখান থেকে বেরিয়ে যান। পরদিন ১২ মে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করতে যান এজাহার নিয়ে।

এরপর বাবুলের আইনজীবী কফিল প্রশ্ন করেন, ওই এজাহারটি মোশাররফ হোসেন কোথায় কাকে দিয়ে টাইপ করিয়েছেন, এজাহারে উল্লিখিত তারিখ তিনি দেখেছিলেন কিনা, মামলা করার সময় বই ও হাতের লেখাসহ বিভিন্ন আলামত তিনি পুলিশকে জমা দিয়েছিলেন কিনা?

জবাবে মোশাররফ বলেন, “এজাহারের সব তথ্য তার বলা মতে টাইপ করা হয়। তবে কে করেছে, তা নিরাপত্তার স্বার্থে বলা যাবে না। বই ও কাগজপত্র জমা দিলেও সেসব দেখে ওসি ফেরত দিয়ে দেন।”

ওই দুটি বইয়ের বিষয়বস্তু, মামলা করার পরে সে রাতে অবস্থান এবং পরের কয়েকদিন চট্টগ্রামে অবস্থান বিষয়েও জেরা করা হয় মোশাররফকে।

আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “মামলা করতে আপনার চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া এবং থাকা-খাওয়া সব পিবিআই কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে হয় বলে আপনি এসব বিষয়ে ‘স্মরণে নেই’ বলছেন।”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “এটা সত্য নয়।”

‘২৫ তথ্য আইও-কে দিয়েছিলাম’

মিতু হত্যাকাণ্ড তদন্তে ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মোশাররফ হোসেনের ঢাকার মেরাদিয়ার বাড়িতে যান মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) পুলিশ কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান।

মোশাররফ জানান, সেদিন প্রায় ৪ ঘণ্টা তাদের বাড়িতে ছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। কথা বলেন মোশাররফের স্ত্রী এবং অন্য মেয়ের সঙ্গেও। সেদিনই তদন্ত কর্মকর্তাকে ‘তার জানা’ ২৫/২৬টি পয়েন্ট কাগজে লিখে দিয়েছিলেন। সেদিন সাংবাদিকদেরও এই তথ্যগুলো জানিয়েছিলেন বলে জেরায় বলেন মোশাররফ।

এরপর আইনজীবী কফিল প্রশ্ন করেন, “সেদিন বলেছিলেন, এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ার কারণে বাবুল আপনার মেয়েকে হত্যা করে। ওই নারীর স্বামী পুলিশের এসআইকে খুলনায় এক্সিডেন্টের নামে বাবুল হত্যা করায়। মিতু হত্যার সঙ্গে ওই হত্যার ঘটনা ‘একসূত্রে গাঁথা’?”

উত্তরে মোশাররফ বলেন, “অনেক আগে এক নারীর সঙ্গে বাবুলের পরকীয়া ছিল সেটা বলেছি। দুই ঘটনা একসূত্রে গাঁথা সেটা বলিনি।”

বাবুলের আরেক আইনজীবী কামরুল ইসলাম সাজ্জাদ জেরায় প্রশ্ন করেন, “আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে বলেছেন, ঘটনার দিনই চট্টগ্রামের উদ্দেশে আসার সময় পথে সেসময়ের সিএমপি কমিশনারসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের আপনি বলেছিলেন, ‘বাবুলের ইন্ধনে মিতুকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ পরে আইও বা মিডিয়াকে একথা কখনও বলেননি। সাত বছর পর আপনি পিবিআই’র শেখানো বক্তব্য দিচ্ছেন’।”

জবাবে মোশাররফ বলেন, “এটা সঠিক নয়।”

সাক্ষীর বক্তব্য ‘গ্রহণযোগ্য নয়’

আইনজীবী কফিল উদ্দিন শুনানির পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মোশাররফ হোসেন সাক্ষ্যে যা বলেছেন, সেগুলো ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোথাও বলেননি।

“২০১৭ সালে তিনি এক নারীর সঙ্গে বাবুলের পরকীয়ার কথা বলেন। পরে আবার আরেক নারীর কথা বলেন। এখন এসে বলছেন, বিদেশি নাগরিক এনজিও কর্মকর্তা এক নারীর কথা। একেক সময় একেক রকম কথা বলছেন। আইনের ভাষায় এগুলো ভিত্তিহীন। এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।”

কফিল বলেন, “তিনি (মোশাররফ) একটি মামলা করেছেন। কিন্তু কোথায়, কে সেই অভিযোগটি টাইপ করেছেন তা উনি জানেন না। তাহলে আমরা কি বলতে পারি না, তিনি অন্যের লেখা অভিযোগে ‍শুধু স্বাক্ষর করেছেন।

“তিনি যদি অভিযোগ টাইপ করে থাকেন, তাহলে এজাহারে থাকা দুটি তারিখও টাইপ করার কথা। সে দুটো তারিখ হাতে লেখা। তাই সন্দেহের অবকাশ আছে।”

এই আইনজীবী বলেন, “তিনি শুরু থেকে তার মেয়ে জামাই বাবুলের পক্ষে বলেছিলেন। বরং শুরুতে সাংবাদিকরা বাবুলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনিই প্রতিবাদ করেছিলেন। তার অবস্থান পরস্পরবিরোধী।”

রাষ্ট্রপক্ষের পিপি আব্দুর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মিতুর বাবা নিজে যা জানতেন, তার ভিত্তিতেই মামলা করেছিলেন। সেকথাই তিনি জেরাতে বলেছেন। জেরা চলমান আছে।”

মিতুর বাবার করা মামলায় পরবর্তীতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। মিতু হত্যার পর বাবুল আক্তার বাদী হয়ে যে মামলা করেছিলেন, সে মামলাতেই পিবিআই তাকেসহ অন্যদের আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়।

পুরনো খবর

Also Read: বাবার সাক্ষ্যে মিতু হত্যা মামলার বিচার শুরু

Also Read: মামলায় যে অভিযোগ দিলেন বাবুল আক্তারের শ্বশুর

Also Read: মিতু হত্যা: স্বামী বাবুল আক্তার আবার আলোচনায়

Also Read: পিবিআই প্রধানের মামলায় বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র

Also Read: বাবুলকেই সন্দেহ শ্বশুরের, দুই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি

Also Read: শ্বশুরের সন্দেহের জবাব দিলেন বাবুল আক্তার

Also Read: মিতু হত্যা: বাদী বাবুল আক্তার যেভাবে আসামি

Also Read: ‘পরকীয়ায় জড়িয়ে বাবুল খুন করান’ মিতুকে, মামলায় অভিযোগ বাবার