শ্বশুরের সন্দেহের জবাব দিলেন বাবুল আক্তার

নানা গুঞ্জনে নীরব থাকা বাবুল আক্তার সহকর্মী হত্যার অভিযোগ নিয়েও ছিলেন নিরুত্তর; এরপর শ্বশুর যখন সন্দেহের কথা জানালেন, তখন নীরবতা ভাঙলেন সাবেক এই পুলিশ সুপার।

লিটন হায়দারও উত্তম সেন গুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2017, 02:42 PM
Updated : 27 Feb 2017, 02:54 PM

সোমবার বিকালে ফেইসবুকে এক স্ট্যাটাসে বাবুল আক্তার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার কারণ জানিয়েছেন; বিয়েসহ নানা চাপ দেওয়ার অভিযোগ করেছেন শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে।

এর একদিন আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় এসব বিষয়ে কথা বলতে অনীহা জানিয়েছিলেন স্ত্রী খুনের পর আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “অনেকেই তো অনেক কিছু বলছে। আমি কিছু বলছি না। আমার সন্তান নিয়ে আছি। তারাই আমার জীবন। তাদের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু ভুলে যেতে চাই।”

নানা প্রশ্ন ওঠার প্রেক্ষাপটে সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে বাবুল বলেছিলেন, “বোঝেনই তো এখন এক জায়গায় চাকরি করি। মিডিয়ার সামনে কথা বললে তারা কী মনে করবে। তবে সময় হলে ডাকব।”

তার এক দিনের মাথায় ‘সবাই বিচারক, আর আমি তথ্য প্রমাণ ছাড়াই খুনি’ শিরোনামে প্রায় দুই হাজারের বেশি শব্দের একটি স্ট্যাটাস লিখলেন বাবুল।

গত বছরের ৫ জুন চট্টগ্রামে স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু প্রকাশ্যে সড়কে খুন হওয়ার পর থেকে আলোচনায় বাবুল। তিনি চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।

এরপর চট্টগ্রামে গিয়ে মামলা করে দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় বনশ্রীতে শ্বশুর বাড়িতে উঠেছিলেন তিনি। সেখান থেকে তাকে ডিবি হঠাৎ একদিন তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তা নিয়ে নানা গুঞ্জন ডালপালা ছড়ায়।

তখন পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার পক্ষেই ছিল। এরই মধ্যে পুলিশের চাকরি ছাড়ার পর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছাড়েন তিনি।

এরপর মাসখানেক আগে ঝিনাইদহের এক এসআই নিহতের ঘটনায় তার পরিবার বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তুললে শুরু হয় নতুন আলোচনা।

নিহত এসআই আকরাম হোসেনের পরিবারের অভিযোগ, তার স্ত্রীর সঙ্গে বাবুলের সম্পর্ক ছিল। তার জের ধরে বাবুলের পরিকল্পনায় ২০১৫ সালে এই হত‌্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ঘটনাটি সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে সাজানো হয়েছিল।

এরপর বাবুলের শ্বশুর পুলিশের সাবেক পরিদর্শক মোশাররফ হোসেনও মেয়ে হত্যাকাণ্ড নিয়ে জামাতাকে সন্দেহের কথা বলেন।   

এতদিন চেপে রাখলেও রোববারই মোশাররফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাবুল আক্তারের পরকীয়া, মিতুর সঙ্গে ঝগড়া, মিতুর আত্মহত্যার চেষ্টা করা, ঢাকায় বাবা মায়ের কাছে চলে আসতে চেয়েও না পারার কথাগুলো তদন্ত কর্মকর্তাকে বিশদভাবে জানানো হয়েছে।”

তার একদিন বাদেই বাবুল ফেইসবুকে লিখেছেন, “অনেকের অনেক জানতে চাওয়া আমার কাছে। আমি কথা বলার জন্য মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত তা নিয়ে কারও বিকার নেই। তবে আমার নিরুত্তর থাকার সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে মনের মতো কাহিনী ফাঁদতে ফাঁদতে পরকীয়া থেকে খুন পর্যন্ত গল্প লেখা শেষ করে ফেলেছেন অনেকে।”

“‘আমার কোনো মাথাব্যথা নেই এসব নিয়ে, আমি আমার মাহারা সন্তান দুটোকে নিয়েই ব্যস্ত এখন। তাছাড়া প্রমাণের দায়িত্ব যারা অভিযোগ করেন তাদের। তবে আমার পরিবার পরিজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা ভেবে কিছু কথা না বললেই নয়,” লেখার পক্ষে যুক্তি দেখান তিনি।

বাবুল অভিযোগ করেছেন, তার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি তার নিহত স্ত্রী মিতুর স্কুলপড়ুয়া এক খালাত বোনের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

নানার বাড়ির জন্য সন্তানদের আবেগের কারণে ‘অস্বস্তি’ নিয়ে সেখানে থাকলেও শ্বশুড়বাড়ির পরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন বাবুল।

শ্বশুরবাড়ির ঘিঞ্জি পরিবেশ, স্টার জলসার সিরিয়াল দেখা, চারপাশে বস্তিবাসীর চেঁচামেচি ও অশ্লীল কথোপকথন নিয়ে অস্বস্তি বোধ করতেন বলে লিখেছেন তিনি।  

“ঘর ঘিঞ্জি হওয়ার সমাধান স্বরূপ বললেন যেন আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন কেউই আমার কাছে না আসে। আমার শ্বশুর বললেন, হয় আমাকে আমার বাবা-মা ছাড়তে হবে, না হয় শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ছাড়তে হবে।”

সন্তানদের নিয়ে আলাদা বাসায় যেতে চাইলে শ্বশুর মোশাররফ তার ভবনের উপর ঘর তৈরি করে সেখানে থাকার প্রস্তাব দিয়ে ১০ লাখ টাকা চেয়েছিলেন বলেও দাবি বাবুলের।

“তাদের একটাই কথা, শ্বশুরের বাড়িতেই নতুন ঘর বাঁধতে হবে এবং সেখানেই থাকতে হবে।”

“আমার শ্বশুর পক্ষকে জানিয়েই বাসা নিয়েছি এবং এতে তারা ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণও হয়েছিলেন। বলেছিলেন, এর পরিণাম হবে খারাপ এবং আমাকে পচিয়ে ছাড়বেন তারা।”

আগে ‘ফেরেশতা’ বলার পর এখন সন্দেহ করা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাবুল লিখেছেন, “আমি বুঝলাম না কোন মা-বাবা তাদের মেয়ের স্বামীর পরকীয়ার সম্পর্ক আছে জেনেও কীভাবে মেয়েকে ঐ স্বামীর সংসারে রেখে দেয়!!!

“খুন হওয়ার পর আট মাসেও তার মা-বাবার একটিবারের জন্যও মনে হল না যে স্বামীই তার হত্যাকারী? বরং ছয়মাস সেই জামাতাকে নিজের ঘরে রেখে তাদেরই আরেক মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাইলেন?”

মিতু মারা যাওয়ার পর চট্টগ্রামে তার বাড়ির আলমারি ভেঙে কাপড়চোপড়, গয়নাগাটি আর জমানো টাকাও শ্বশরবাড়ির লোকজন নিয়ে এসেছিল বলে বাবুলের অভিযোগ।

মাহমুদা আক্তার মিতু

এসআই আকরামের বোনদের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়েও নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন বাবুল।

তিনি বলেন, “এটা ঠিক যে মৃত আকরামের স্ত্রী মাগুরায় আমাদের একই এলাকায় থাকতেন এবং তার স্বামী মারা যাওয়ার পর আকরামের রেখে যাওয়া সম্পদ নিয়ে পারিবারিক বিরোধের কারণে সে আমার ছোট ভাইয়ের (পেশায় আইনজীবী এবং মাগুরায় থাকেন) কাছ থেকে আইনি সহায়তা নিয়েছিল, যে ঘটনায় আমার কোনো সংশ্লিষ্টতাই ছিল না।

“একই এলাকায় থাকলে কিংবা বাবা-ভাইয়ের সাথে পরিচয় থাকলেই যদি পরকীয়া হয়ে যায়, তবে আমার পরকীয়া প্রেমিকাদের নাম লেখা শুরু করলে তা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ গোলার্ধে পৌঁছালেও শেষ হবে না।”

“আকরামের বোন অভিযোগ করেছেন যে ছেলের শোকে তার মা মারা গিয়েছেন। এখন আকরামের মায়ের মৃত্যুর দায়ও যদি আমার উপর চাপানো হয় আশ্চর্য হব না!!!”

সোমবার নিজের বড় ছেলের জন্মদিনেই এই স্ট্যাটাস লিখেন বাবুল।

আজ আমার ছেলের জন্মদিন, মাকে ছাড়া প্রথম জন্মদিন তার। কী ভাবছে সে মনে মনে? কতটা কষ্ট পাচ্ছে সে? এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায় কার?”

হত্যামামলার তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রাম ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. কামরুজ্জামান নিহত মিতুর বাবা, মা, বোনদের পাশাপাশি মামলার বাদী সাবেক সহকর্মী বাবুলের সঙ্গেও কথা বলেছেন।

বাবুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে তার সরাসরি কথা হয়নি। মিতু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ ইতোমধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে। দুজন পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতও হয়েছেন।

হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসার নাম বলছেন পুলিশ কর্মকর্তারা,যিনি চট্টগ্রামে বাবুলেরই সোর্স ছিলেন।

তদন্তের বিষয়ে দক্ষ হিসেবে পরিচিত সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা লিখেছেন, “বাস্তব জীবনটা কোন চলচ্চিত্র না। আমি সুপারকপের মত উঠে গিয়ে স্ত্রীর খুনী বের করে ফেলব?”