“দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় না নেওয়া এবং একে অন্যের ওপর দায় চাপানো অত্যন্ত উদ্বেগজনক,” বলেন বিচারক।
Published : 10 Jul 2024, 11:31 PM
নির্মাণ কাজে ‘নূন্যতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার’ কারণেই প্রায় এক যুগ আগে চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভার ধসে ১৩ জণের প্রাণহানি ঘটেছিল বলে আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
বুধবার চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভুঁঞা এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি কোম্পানির আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যেককে ৭ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন তিনি।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, এত বৃহৎ কর্মযজ্ঞে গার্ডার ধসে ১৩ জনের নিহত হওয়া ও বহু হতাহত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে একটি ‘কালো অধ্যায়’।
“দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় না নেওয়া এবং একে অন্যের ওপর দায় চাপানো অত্যন্ত নেতিবাচক ও উদ্বেগজনক।”
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অধীনে নির্মাণাধীন বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়লে তাতে চাপা পড়ে ১৩ জনের প্রাণ যায়, আহত হন অনেকে।
পরে ওই বছরের ২৬ নভেম্বর নগরীর চান্দগাঁও থানার ওই সময়ের এসআই আবুল কালাম আজাদ ২৫ জনকে আসামি করে এ মামলা দায়ের করেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “এত বড় দুর্ঘটনাসৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের দায় পুরোটাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আখতার-পারিসার যৌথ কোম্পানির। কিন্তু প্রতিষ্ঠান একটি বিমূর্ত ধারণা, তাই প্রতিষ্ঠানকে সাজা প্রদান করে সাজা কার্যকর করা যায় না।”
“বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত এ দুর্ঘটনার দায় ঠিকাদার কোম্পানির কর্মরত মালিকপক্ষ থেকে শুরু করে কর্মরত সকল কর্মচারীর, তারা যে পদেই থাকুক না কেন।”
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “এ দায় প্রাতিষ্ঠানিক দায়। আসামিরা ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকাটা আবশ্যিক নয় মর্মে আদালত মনে করে। প্রতিষ্ঠানের দায়ের সাজা উক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মরত কর্মচারীদের সাজা ভোগের মাধ্যমে কার্যকর হবে।
“তা না হলে ভবিষ্যতে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা হুমকির মুখে পড়বে। একই সাথে দুর্ঘটনার শিকার মানুষগুলোর পরিবারের অভিশাপ থেকে দেশ জাতি রক্ষা পাবে না।”
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহিতার অভাব, নির্মাণকারী ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয় না থাকা, ফ্লাইওভার নির্মাণের মত একটা বিশাল কর্মযজ্ঞে নূন্যতম নিরাপত্তা পদক্ষেপ গ্রহণ না করা ও পারস্পরিক দোষারোপ অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
“যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরির পাশাপাশি অন্যা যে কোনো দুর্ঘটনায় ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে বলে আদালত মনে করে।”
পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি, নিম্নবিত্ত শ্রেণির। এমন মৃত্যু কাম্য নয়। দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায় খুঁজে পেয়েছে। এক ভিকটিমের সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয়েছে দুর্ঘটনার পর সিডিএ কর্তৃপক্ষ ভিকটিমদের ৫০ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছে, যা অপ্রতুল।
“কোনোভাবে এ ক্ষতি অর্থ দ্বারা পূরণ হবার নয়। কারণ হতাহতরা ও পরিবার দীর্ঘদিন এক মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া ভিকটিমদের অনেকেই শারীরিকভাবে অসমর্থ্য হয়ে পড়ায় জীবিকা অর্জনে অক্ষম। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আসামিদের প্রত্যেককেই ৩ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।”
রায় ঘোষণার আগে বিচারক বলেন, আসামিপক্ষের দাখিল করা সংশ্লিষ্ট পত্রিকার কপিতে দেখা যায়, তখন সিডিএ চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারকে ২ লাখ টাকা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা মোট ৪ লাখ টাকা, পঙ্গুদের ১ লাখ টাকা ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আর্থিক অনুদানপ্রাপ্ত কোনো সাক্ষীকে ডিফেন্স আসামিপক্ষের সাক্ষী হিসেবে হাজির করতে পারেনি।
“দীর্ঘ ১২ বছরের পুরাতন এ মামলা। আসামিরা, ভিকটিম ও ভিকটিমের পরিবার ন্যায়বিচারের আশায় কোর্টে আসা যাওয়া করছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত না হওয়া রাষ্ট্র এবং বিচারকাজে জড়িত সকলের ব্যর্থতা।”
রায় ঘোষণার আগে মামলার বিস্তারিত তুলে ধরে বিচারক শরীফুল আলম ভুঁঞা বলেন, এ ঘটনায় ২৫ জনের বিরুদ্ধে এজাহার হয়েছিল। যার মধ্যে ৩ জন সিডিএ কর্মকর্তা। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএআরএম লিমিটেডের ১২ জন ও মীর আখতার-পারিসা জেভির ১০ জনকে আসামি করা হয়। পেনাল কোডের ৩০৪, ৩৩৭, ৩৩৮ এবং ৩৪ ধারায় মামলাটি করা হয়।
তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক রেজাউল করিম ও পরিদর্শক এস এম শহীদুল ইসলাম মামলার তদন্ত শেষে এজাহারে বাকি আসামিদের বাদ দিয়ে ৭ জন এবং নতুন করে আসামি রফিকুল ইসলামকে অন্তর্ভুক্ত করে অভিযোগপত্র জমা দেন।
২০১৪ সালের ১৮ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০৪ এর দ্বিতীয় অংশে, ৩৩৮ এবং ৩৪ ধারায় চার্জ গঠন হয়। মামলায় সর্বমোট ২২ জন সাক্ষী ও ৫ জন সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
আসামিদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হল- ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলার সময় সেখানে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এমন কোনো সাইনবোর্ড না দিয়ে কাজ করা এবং জানা থাকা স্বত্ত্বেও ফ্লাইওভারের গার্ডার স্থাপনে যথেষ্ট নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা। ওই ঘটনায় তিনটি গার্ডার স্থানচ্যুত হয়।
ওই ঘটনাকে ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজে বিপর্যয় সংক্রান্ত একটি চাঞ্চল্যকর মামলা’ হিসেবে বর্ণনা করে রায় ঘোষণার আগে বিচারক মামলার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে বলেন, “দুর্ঘটনা কত ভয়াবহ ও ব্যাপক ছিল তা দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ফুটে ওঠে।”
দায় কার?
দুর্ঘটনার পরপরই সিডিএ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল প্রধান প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন মাহমুদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে।
ওই কমিটি দুর্ঘটনার যেসব কারণ নির্ধারণ করে, সেগুলো হল- ঘটনাস্থলে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকা, কারিগরি বিপর্যয়, ব্যবহৃত জ্যাক ত্রুটিপূর্ণ থাকা এবং সহকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজে সম্পৃক্ত না থাকা।
ওই প্রতিবেদন বলা হয়, দুঘর্টনার জন্য ঠিকাদারি কোম্পনির মাঠ পর্যায়ের লোকজন দায়ী।
আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল জেলা প্রশাসকের আদেশে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) খালেদ মাহমুদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে।
ওই কমিটি দুর্ঘটনার যে কারণসমূহ চিহ্নিত করেছে তা হল- নির্মাণ স্থলে ‘সেইফটি ও সিকিউরিটি মেজার’ আদৌ অনুসরণ করা হয়নি; কারিগরী অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রকৌশলীর অনুপস্থিতিতে অপর্যাপ্ত আলোতে রাতের বেলা গার্ডারের কাজ করা হচ্ছিল; যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া হাইড্রোলিক জ্যাক দিয়ে গার্ডারের শিফটিং ও লিফটিং করা হচ্ছিল; টেকনিক্যাল ডেভিয়েশনন; অরক্ষিত অবস্থায় গার্ডার তোলা; জনসাধারণের জন্য কোনো সতর্কবার্তার সাইনবোর্ড না দেওয়া; কাজের জায়গায় নিরাপত্তা ফেন্সিং না করা; শনিবার বন্ধের দিন ছিল এবং কোন ওয়ার্ক শিডিউল ছিল না এবং পর্যাপ্ত লাইটিং এর ব্যবস্থা করা হয়নি।
মীর আখতার ও পারিসার যৌথভাবে এ কাজে চুক্তিবদ্ধ হলেও মীর আকতার অভ্যন্তরীণ সমঝোতায় পারিসাকে ‘সাবকন্ট্রাক্টে’ কাজটির দায়িত্ব দেয় বলে জেলা প্রশাসনের সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে।
ঠিকাদার কোম্পানির গাফিলতির কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জেলা প্রশাসনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়।
বিচারক বলেন, “এ দুটি তদন্ত কমিটি এবং পুলিশের তদন্তসহ তিনটি প্রতিবেদনে প্রমাণিত যে আসামিরা দায়িত্বে ছিল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে আসামিরা এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। তাদের মারাত্মক অবহেলা ছিল।
“সাক্ষ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দুর্ঘটনায় ভিকটিমদের মৃত্যু ঘটতে পারে এমন ধারণা আসামিদের ছিল না কিংবা মৃত্যু ঘটানোর উদ্দেশ্যও তাদের ছিল না। এটি ৩০৪ ধারার অপরাধ, অর্থাৎ নরহত্যা ইচ্ছায় নয়, তবে এমন কাজের দ্বারা মৃত্যু ঘটবে এরূপ অপরাধ সুষ্পষ্ট প্রমাণিত। এতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টান্তমূলক অবহেলা ছিল।”
বিচারক বলেন, “একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যে দেখা যায়, একজন ভিকটিম ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। ফলে মূল প্রতিষ্ঠান সিডিএ ঘটনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায় স্বীকার করে নিয়েছে।
“ফৌজদারি অপরাধের মত এটি প্রমাণিত হওয়ার আবশ্যকতা নেই। এই ঘটনা বা দুর্ঘটনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রমাণিত বলে আদালত মনে করে।”
এজাহারে থাকা সিডিএ কর্মকর্তা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয় বলে আসামিপক্ষ আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে অভিযোগ করে।
কিন্তু এ বিষয়ে ভিকটিমদের পক্ষে কেউ কোনো নারাজি দেয়নি, তাই মামলাটি পুনঃতদন্তে পাঠানো হলে বিচার বিলম্বিত হবে বলেও মন্তব্য করেন বিচারক।
পরে আদালত আসামিদের প্রত্যেককে ৩০৪ ধারায় ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও তিন লাখ টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো ছয় মাসের সাজা এবং ৩৪ ধারায় প্রত্যেককে দুই বছর করে কারাদণ্ডের আদেশ দেন।
দণ্ডিত আটজন হলেন- প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. গিয়াস উদ্দিন, মো. মনজুরুল ইসলাম, প্রকৌশলী আবদুল জলিল, আমিনুর রহমান, আবদুল হাই, মোশাররফ হোসেন, মান নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলী শাহজাহান আলী ও রফিকুল ইসলাম। তারা সবাই ঠিকাদার কোম্পানি মীর আখতার-পারিসার (জেভি) ওই সময়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী।
পুরনো খবর:
চট্টগ্রামে ফ্লাইওভারের গার্ডার ধস: ৮ আসামির সাজা
ফ্লাইওভার ধসের ঘটনায় ৮ জন অভিযুক্ত
'তদারকিতে অবহেলার কারণে ফ্লাইওভার ধস'
চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার ধস: সাক্ষী ২ পুলিশ বিরুদ্ধে পরোয়ানা
চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার ধস মামলার রায় ১০ জুলাই
'অবহেলা ও অনভিজ্ঞতার কারণে ফ্লাইওভার ধস'