মিন্টু চৌধুরী
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম, নভেম্বর ২৫ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- একবার দুর্ঘটনার পরও কর্তৃপক্ষ সচেতন না হওয়ায় চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার দ্বিতীয়বার ভেঙে প্রাণহানি হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এজন্য নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তদারকিতে গাফিলতির জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যানসহ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবিও উঠেছে।
দুর্ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরও সিডিএ বা দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার এন্টারপ্রাইজ ও পারিশা এন্টারপ্রাইজের কোনো প্রতিনিধি দুর্ঘটনাস্থলে না যাওয়ায় অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন অনেকে।
শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়কের বহদ্দার বাড়ি অংশে ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের মধ্যবর্তী তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে অন্তত ১২ জন নিহত হয়।
গত ২৯ জুন এই ফ্লাইওভারের আরেকটি গার্ডার ভেঙে পড়েছিল। তখন গঠিত তদন্ত কমিটি বলেছিল, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই নির্মাণ কাজ করায় দুর্ঘটনা ঘটেছে।
তখন নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি এবং নির্মাণ কাজের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ার কোনো নজিরও দেখা যায়নি।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জঘন্য অসতর্কতার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নিচে বাজার বসে কীভাবে? বেষ্টনী ছাড়া, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছাড়া কোনো ধরনের নির্মাণ কাজ হতে পারে না।”
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শনিবার রাতে গার্ডার ভেঙে পড়ার সময় এর নিচে বসেছিল সবজি বিক্রেতারা, ছিল রিকশা, পথচারী। বহদ্দার পুকুরের সীমানা প্রাচীরে স্থানীয় তরুণদের আড্ডাও ছিল।
পুরো এলাকা ঘুরে নির্মাণাধীন ১ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভারের দুই পাশে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী দেখা যায়নি।
স্থানীয় শাহ আমানত ডেকোরেটর্সের মালিক মোহাম্মদ বখতেয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্মাণ কাজ শুরুর পর থেকে কখনোই নিরাপত্তা বেষ্টনী আমরা দেখিনি।
স্থানীয় লোকজন এই ঝুঁকির কথা বললেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিংবা সিডিএ তাতে কান দেয়নি বলে তার অভিযোগ।
প্রকৌশলী দেলোয়ার বলেন, “যে কোনো নির্মাণ কাজের পূর্বে নিরাপত্তাই প্রধান। বহদ্দারহাটের ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে তা কোনোভাবেই মানা হয়নি। পুরো এলাকায় অরক্ষিত রেখেই কাজ করা হচ্ছিল। সিডিএ এবং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের চরম গাফিলতির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
তিনি বলেন, বাইরে কোথাও গার্ডার নির্মাণ করে ফ্লাইওভারের ওপর প্রতিস্থাপনের প্রযুক্তি বাংলাদেশে নেই। তাই গার্ডারগুলো ফ্লাইওভারের পিলারের ওপরই খাড়া অবস্থায় নির্মাণ করতে হয়।
“শিফটিংয়ের সময় গার্ডারের ওপর-নিচে চাপ সমান থাকতে হয়। তা না হলে কাত হয়ে যায়। এর জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যা ছিল না।”
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ১১ ও ১২ নম্বর পিলারের মাঝে আরো চারটি নির্মাণাধীন গার্ডার আছে। এর মধ্যে একটি গার্ডার ওপরের দিকে সামান্য বাঁকানো। গার্ডারগুলোর মধ্যে কোনো ক্রস গার্ডার (পরস্পর সংযোগ স্থাপনকারী অংশ) নেই।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, সন্ধ্যায় দুর্ঘটনার সময় গার্ডার শিফটিং (স্থানান্তর) চলছিল। ওই সময় একটি গার্ডার বেঁকে গিয়ে ওপর থেকে নিচের সড়কে পড়ে। পড়ার সময় আরো দুটি গার্ডারে ধাক্কা লাগলে সেগুলোও নিচে পড়ে যায়।
বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের প্রতিটি গার্ডার প্রায় ১৩০ ফুট দীর্ঘ এবং ৭ ফুট প্রস্থের। নির্মাণের পর গার্ডারগুলো যথাস্থানে বসানোই ‘শিফটিং’।
প্রকৌশলী দেলোয়ার বলেন, “রাতের বলে অপর্যাপ্ত আলোয়, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও বিশেষজ্ঞের অনুপস্থিতিতে সাধারণ শ্রমিকদের দিয়ে শিফটিংয়ের কাজ করায় এত বড় দুর্ঘটনা হল।”
এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রশাসন পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে।
দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রামের মেয়র এম মনজুর আলম, সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীন, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদসহ রাজনৈতিক নেতারা ঘটনাস্থলে যান।
কিন্তু সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম কিংবা কোনো কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি। শনিবার রাতেই দুর্ঘটনার জন্য সিডিএ চেয়ারম্যানকে দায়ী করে তার পদত্যাগ দাবিতে মিছিল করে জনতা।
শনিবার রাতে ঘটনাস্থলে এসে আবদুচ ছালামকে গ্রেপ্তারের দাবিও জানান নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী।
রোববার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও নির্মাণ কাজে অবহেলা এবং পূর্বের ঘটনা থেকে শিক্ষা না নেয়াকে দায়ী করেন।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুল ইসলাম রোববার সকালে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সিডিএ’র কারো সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাইনি।”
দ্বিতীয়বার দুর্ঘটনার পর সিডিএ নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এমসি/এমআই/২১০২ ঘ.