জ্যেষ্ঠ দুই নেতার মাঝখানে বসে শুরু করেন মত বিনিময় অনুষ্ঠান। আর পিতা মহিউদ্দিনের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নাছিরের সঙ্গে হাসিমুখে আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন বার বার।
Published : 19 Dec 2023, 07:42 PM
দলের নগর কমিটির সব শীর্ষ নেতাদের পাশে বসে সরকারি সেবার বিকেন্দ্রিকরণ, সিটি গভর্নমেন্ট বাস্তবায়ন, চট্টগ্রামে হাই কোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন, শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ ও অবাধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কথা বললেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
প্রয়াত পিতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর রাজনীতি নিয়েও নিজের বিশ্লেষণ জানালেন প্রশ্নের জবাবে। বহু বছর পর চট্টগ্রাম নিয়ে পরিকল্পনায় মহিউদ্দিনের সুরই যেন শোনা গেল পুত্র নওফেলের কণ্ঠে।
অনুষ্ঠান ছিল চট্টগ্রাম-৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে সাংবাদিকদের মতবিনিময়ের। তাতে নওফেল হাজির হন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরকে সঙ্গে নিয়ে।
জ্যেষ্ঠ দুই নেতার মাঝখানে বসে শুরু করেন মত বিনিময় অনুষ্ঠান। আর পিতা মহিউদ্দিনের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নাছিরের সঙ্গে হাসিমুখে আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন বার বার।
শুরুতেই নওফেল বলেন, “আপনাদের দোয়ায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়ন কমিটিতে আমি অন্তর্ভুক্ত। চট্টগ্রামের শ্রদ্ধেয় ড. অনুপস সেন এবং ওয়াসিকা আয়শা খানও আছেন ইশতেহার প্রণয়ন কমিটিতে। দলীয় ইশতেহার ২৭ ডিসেম্বর প্রকাশ করা হবে।
“ইতিমধ্যে কিছু সুপারিশ আমরা দিয়েছে। তবে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সকল সুপারিশ দেয়ার সুযোগ থাকবে। আপনাদের কোনো পরামর্শ থাকলে সেটা শুনতে চাই। চট্টগ্রামের আরো কোনো বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকলে সেই চেষ্টা করব।”
ইশতেহারে যেসব বিষয় প্রস্তাব করেছেন তার উল্লেখ করে নওফেল বলেন, “বিকেন্দ্রিকরণের বিষয়টি যেন গুরুত্ব পায়। রাজধানীর বাইরে সেবা খাত যাতে বৃদ্ধি পায়। এরমধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ হলো- চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ আদালতের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন। সেটা হলে ন্যায় বিচার পাওয়া সহজ হবে৷
“এখন মৌলিক অধিকার কারো ক্ষুন্ন হলে ঢাকায় গিয়ে রিট করতে হয়। সকলের জন্য ন্যায় বিচার সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে একটা প্রতিকার পেতে অনেক খরচ হয়। ভার্চুয়াল কোর্ট এখন হয়েছে। অনেক বিষয় করা সম্ভব। আমি শুধু মৌলিক অধিকারের বিষয়টা বললাম, এডমিরালটি কোর্টসহ অনেক বিষয় আছে।”
সেবা খাত ও বাণিজ্য বিষয়ক দপ্তর বিকেন্দ্রিকরণ হলে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর ঢাকায়। কারণ তাদের সাথে সম্পর্কিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় সেখানে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারই আছে প্রতিষ্ঠানগুলোর বোর্ড মিটিং ঢাকায় করতে হবে। এটা অন্যায্য৷ বিকেন্দ্রিকরণ প্রয়োজন।”
শিক্ষায় কি ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হবে জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, “নিম্ন ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মাত্র ৭০০ সরকারি বিদ্যালয়। প্রায় ৩০ হাজার বেসরকারি। সেটা জাতির পিতার যে কমিটমেন্ট, সবার জন্য শিক্ষা তার সাথে সাংঘর্ষিক।
“আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ এনরোলমেন্ট হচ্ছে। কিন্তু মাত্র ১১ বছরে তা শেষ হয়, এতে তাদের পূর্ণ বিকাশ হয় না। মৌলিক শিক্ষা যাতে ১৪ বছর পর্যন্ত দেয়া যায় এবং সেটা করতে অভিভাবকরা যাতে আর্থিকভাবে চাপে না পড়েন এ নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।”
বন্দর নগরীর উন্নয়নসহ সারাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সমন্বয়ের বিষয়ে জোর দিয়ে নওফেল বলেন, “সেন্ট্রাল ব্যুরোক্রেসির কারণে আমরা অনেক সময় ঢাকার বাইরের বিষয়গুলো ভুলে যাই। সিটি করপোরেশন আইনে সিটি গভর্নমেন্টের লিগ্যাল স্ট্রাকচার আছে। কিন্তু সমন্বয়টা সেভাবে করা যায় না। এতে করে নির্বাচিত মেয়ররা সমালোচনার শিকার হন। কিন্তু তাদের লিমিটেশনটা বিবেচনা করা হয় না। এটা নিয়ে লিগ্যাল স্ট্রাকচারের সীমাবদ্ধতা নিরসনসহ আরো কাজ করার আছে।”
বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর ঢাকায় নিয়ে যাওয়া, বিকেন্দ্রিকরণ, সিটি গর্ভমেন্ট ও চট্টগ্রামের মানুষর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি নিয়ে জীবদ্দশায় সোচ্চার ছিলেন মহিউদ্দিন। বিভিন্ন সময় নিজস্ব আঙ্গিকে এসব দাবি তিনিও জানাতেন।
‘উন্নয়ন হয়েছে দৃশ্যমান, এবার হবে কর্মসংস্থান’ এরকম একটি স্লোগানও ইশতেহারে প্রস্তাব করা হয়েছে জানিয়ে মঙ্গলবার নওফেল বলেন, “লোকাল জব ক্রিয়েশন কিভাবে করা যায় সেটা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান যাতে করা যায় গ্রেজুয়েটডের জন্য।”
চট্টগ্রামে মিনি সেক্রেটারিয়েট স্থাপনের প্রস্তাব বিষয়ে এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, “মিনি সেক্রেটারিয়টের একটা প্রস্তাবনা আগের জেলা প্রশাসক দিতে চেয়েছিলেন। এমনিতে আমরা লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে পর্যদুস্ত। তার চেয়ে দপ্তরগুলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া দরকার। ই-নথি বিবেচনায় নেয়া দরকার।
“আরেকটা সেক্রেটারিয়েট হলে মানুষের আরো বেশি সময় লাগতে পারে। তাই সেটা না করতে বলেছি।”
পিতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর অবর্তমানে তার ছায়া অনুভব করছেন কিনা বা তার অনুপস্থিতি টের পাচ্ছেন কিনা প্রশ্ন ছিল এক সাংবাদিকের।
জবাবে নওফেল বলেন, “আমার বাবা কখনো জনপ্রিয়তা নিয়ে ভাবতেন না। কখনো কখনো আমি বলেছি, আপনার এই সিদ্ধান্ত অজনপ্রিয় হবে। তিনি বলতেন, ‘আমি তো সিনেমার নায়ক না, যে আমাকে সবসময় জনপ্রিয় থাকতে হবে। আমার দায়িত্ব কাজ করে যাওয়া। আমার মরার পরে চট্টগ্রামের মানুষ মূল্যায়ন করবে, আমি তাদের জন্য কাজ করেছি কিনা’।
“উনার অনেক কাজের সমালোচনা ছিল। মৃত্যুর পর অনেকে উনার সাহসিকতা ও বীরত্বের কথা বলেন। সমালোচনার ভয় আমিও করি না। একজন রাজনীতিবিদ সমালোচনার ভয় করতে পারে না। তাই যা সঠিক মনে করি সেটা বলি ও করি। এতে সমালোচনা হতে পারে।”
তিনি বলেন, “উন্নয়নের পাশাপাশি আমার লক্ষ্য চট্টগ্রামে সম্প্রীতি যেন নষ্ট না হয়। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা যেন প্রসার না পায়। আমাদের সাংস্কৃতিক একটা স্থবিরতা নেমে এসেছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়মিত না হওয়ায়। এখন আমাদের লালদীঘির মাঠ আছে। ডিসি হিল আছে। সেখানে এত সুন্দর অবকাঠামো। সেখানে উচ্চস্বরে কিছু না করেও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম তো হতে পারে।
“সরকার তো কোনো ব্যক্তি না যে সে তার সম্পত্তির মালিকানা চর্চা করবে। জনগণের মালিকানাই হচ্ছে সরকারের মালিকানা। সেক্ষেত্রে একটা পাহাড় ধীরে ধীরে সেটা সরকারি পাহাড় বানিয়ে দিব, দিসজ ইজ নট একেসপ্টেবল। সাধারণ মানুষের যাওয়ার জায়গার জন্যই সেখানে স্থাপনাটা করা হয়েছে। অনেক যুদ্ধ করে সার্কিট হাউজের সামনে উন্মুক্ত করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজে গিয়েছি। আমি কথা বলেছি। অবশেষে মামলা হামলা অনেক কিছু করার পরিকল্পনা ছিল। সেটা এখন ভেঙে দিয়ে ক্লিয়ার করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “ডিসি হিলে কেন কোনো ধরণের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম করতে দেয়া হবে না? এটা এক ধরণের কারফিউ। এটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য না। কেন সেটা বন্ধ থাকবে? কেন সেখানে গান বাজনা কোনো কিছু হবে না? আমি দায়বদ্ধ, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিব।”
তিনি বলেন, “সরকারে আছি সেহেতু সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত সরাসরি বিরোধিতা করাটা আমার জন্য সঠিক হবে না। কিন্তু জনগণের যেটা কথা সেটা সরকারকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দেয়া, বলা, সেটা আমার মূল কাজ। বিরাগভাজন হলে হতে পারি।”
সভায় উপস্থিত ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক আদনান ও চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, চন্দন ধর, মশিউর রহমান ও হাসান মাহমুদ শমসের।