গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ম্যাচ মানেই যেন বাড়তি উত্তেজনা। তবে এবার বিশ্বকাপে ধুঁকতে থাকা দুই দলের তলানির লড়াই এতটা ঝাঁজ ছড়াবে, কে ভাবতে পেরেছিল! অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের ‘টাইমড আউট’ ঘিরে যে উত্তাপ ছড়াল ম্যাচের প্রথম ভাগে, সেটির রেশ রইল ম্যাচজুড়েই। সেই চাপকে হারিয়ে দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশকে জয়ের পথে এগিয়ে নিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত ও সাকিব আল হাসান। টিকে রইল বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার আশা।
দিল্লিতে প্রবল স্নায়ুর চাপের ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ৩ উইকেটে হারাল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে চারবারের লড়াইয়ে এই প্রথম লঙ্কানদের হারাতে পারল বাংলাদেশ।
৫৩ বল বাকি রেখেই পাওয়া এই জয়ে রান রেটে লঙ্কানদের পাশাপাশি নেদারল্যান্ডসকেও পেছনে ফেলে আপাতত সাতে উঠে এলো সাকিবের দল। তবে সবচেয়ে জরুরি, টিকে রইল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার আশা।
আরুন জেটলি স্টেডিয়ামের ব্যাটিং স্বর্গে সোমবার শ্রীলঙ্কা অলআউট হয় ২৭৯ রানে। দুর্দান্ত ব্যাট করে সেঞ্চুরি উপহার দেন চারিথ আসালাঙ্কা। তবে তার সতীর্থরা উইকেট বিলিয়ে দেওয়ার মিছিলে যোগ দেওয়ায় বড় হয়নি দলের স্কোর।
রাতের শিশিরে বোলারদের কাজ কঠিন হবে ভেবেই টস জিতে পরে ব্যাটিংয়ের পথ বেছে নিয়েছিলেন সাকিব। ব্যাট হাতেও তিনি তা প্রমাণ করে দেন। যোগ্য সঙ্গী পান শান্তকে। দুজনের ১৪৯ বলে ১৬৯ রানের জুটি বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয় জয়ের কাছে।
জয়ের ব্যবধান দেখে মনে হতে পারে, বেশ লড়াই হয়েছে ম্যাচে। আদতে শেষ দিকে দ্রুত কিছু উইকেট হারিয়ে নিজেদের কাজ একটু কঠিন করে তোলে বাংলাদেশই। তবে কখনোই মনে হয়নি, তারা হারতে পারে।
২ উইকেটের সঙ্গে ৬৫ বলে ৮২ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচের সেরা সাকিব আল হাসান। এই বিশ্বকাপে আগের ৬ ইনিংস মিলিয়ে ১০৪ রান করা বাংলাদেশ অধিনায়ক অবশেষে জ্বলে উঠতে পারলেন ব্যাট হাতে।
টানা ৬ ইনিংসে দুই অঙ্ক ছুঁতে না পারার চক্র ভেঙে শান্ত উপহার দেন ১০১ বলে ৯০ রানের ইনিংস।
এই দুজনের সৌজন্যেই একটু আড়াল হয় ম্যাথিউসের ‘টাইমড আউট’-এর ঘটনা। এছাড়া ম্যাচের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাই এটি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ১৪৬ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম এভাবে আউট হলেন কেউ। এই বিতর্কের রেশ নিশ্চিতভাবেই চলবে আরও অনেকটা সময়।
বাংলাদেশের রান তাড়ার শুরুটা খুব একটা ভালো ছিল না। ব্যর্থতার ধারাবাহিকতায় ওপেনার তানজিদ হাসান বিদায় নেন ৯ রানে। বিশ্বকাপের ৮ ইনিংস মিলিয়ে তার রান হলো ১০৯।
লিটন কুমার দাস ৬ রানে বেঁচে যান ক্যাচ দিয়ে। পরে কাসুন রাজিথাকে চোখধাঁধানো দুটি ছক্কা মারেন পরপর দুই বলে। কিন্তু ইনিংস বড় করতে ব্যর্থ হন আরও একবার। ২৩ রানে তাকে থামায় দিলশান মাদুশাঙ্কার নিখুঁত ইয়র্কার।
বাংলাদেশের বিপদ বাড়তে পারত আরও, যদি ম্যাথিউসের বলে শর্ট কাভারে সাকিবের ক্যাচ নিতে পারতেন আসালাঙ্কা।
লড়াইটা তখন ছিল মনস্তাত্ত্বিক। ‘টাইমড আউট’-এর প্রভাব নিশ্চিতভাবেই পড়ে সাকিবের মনস্তত্বে। ম্যাথিউসের প্রথম বলেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে মারতে গিয়ে ব্যর্থ হন তিনি। পরের বলে আবার একই চেষ্টা করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন। ম্যাথিউসকে সেখানে জিততে দেননি তার সতীর্থ।
৭ রানে জীবন পেয়ে অবশ্য দুর্দান্ত খেলতে থাকেন সাকিব। শুরুটা একটু সাবধানে করার পর নিজেকে খুঁজে পান শান্তও। জমে ওঠে জুটি।
সাকিবের সঙ্গে আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক খেলাও চালায় শ্রীলঙ্কা। লড়াইটা ছিল স্কিলেরও। শর্ট বলের লড়াই। আগের ৬ ইনিংসে ৫ বারই শর্ট বলে আউট হয়েছেন তিনি। এই ম্যাচেও তাকে শর্ট বলে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন লঙ্কানরা। তবে এবার সাকিবের জবাবটাও হয় দুর্দান্ত।
শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে গতিময় বোলার চামিরার শর্ট বলে পুল করে চার মারার একটু পর তাকেই ছক্কা মারেন হুক করে। যে শর্ট বল নাগালে পাননি, সেটি ছেড়ে দেন ঠাণ্ডা মাথায়। ছোট্ট সেই লড়াইয়ে জয় তাকে পথ তৈরি করে দেয় বড় জয়ের পথে এগোনোর।
ম্যাথিউস আর শ্রীলঙ্কার অন্য ফিল্ডাররা যে স্লেজিং তোপও দাগাচ্ছিলেন একের পর এক, তা বোঝা যাচ্ছিল নানা অঙ্গভঙ্গি দেখেই। সাকিব-শান্ত উতরে যান সেই চ্যালেঞ্জও।
ফিফটিতে আগে পৌঁছে যান শান্ত, ৫৮ বল খেলে। সাকিবের ফিফটিতে সময় লাগে ৪৭ বল। ফিফটির পরও স্ট্রোকের ফোয়ারা ছুটিয়ে এগিয়ে যান তারা। দুজনের সামনেই হাতছানি ছিল সেঞ্চুরির। দুজনকেই হতাশ করেন ম্যাথিউস।
নতুন স্পেলে ফিরে প্রথম ওভারেই তিনি ফেরান সাকিবকে। অফ কাটারে আগেই ফ্লিক করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। ফিল্ডার সেই আসালাঙ্কা, ক্যাচ নেন শর্ট কাভারেই। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি!
ম্যাথিউসের পরের ওভারেই বাইরের বল স্টাম্পে টেনে আনেন শান্ত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবার আউট হন তিনি নব্বইয়ে।
এরপর মুশফিকুর রহিম পারেননি দলকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিতে। দারুণ কিছু শট খেলে মাহমুদউল্লাহ বিদায় নেন ২২ রান করে। ছক্কার চেষ্টায় উইকেট হারান মেহেদী হাসান মিরাজও। তাতে সামান্য নাটকীয়তা ছড়ায় বটে। তবে দুই ছক্কায় তাওহিদ হৃদয়ের ৭ বলে অপরাজিত ১৫ রানের ইনিংসে লক্ষ্যে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ।
ম্যাচের শুরুটাও ছিল নাটকীয়। একাদশে ফেরা কুসাল পেরেরা ম্যাচের তৃতীয় বলে শরিফুল ইসলামকে বাউন্ডারি মারেন দারুণ শটে। ওই ওভারেই শেষ বলে মুশফিকুর রহিমের অসাধারণ ক্যাচে বিদায় নেন বিপজ্জনক এই ব্যাটসম্যান। বাঁদিকে ফুল ডাইভ দিয়ে দুর্দান্ত রিফ্লেক্সে বল গ্লাভসে জমান অভিজ্ঞ কিপার।
আরেক ওপেনার পাথুম নিসানকা শুরুটা করেন দারুণ। শরিফুলের দ্বিতীয় ওভারেই তিনটি বাউন্ডারি মারেন তিনি। নান্দনিক সব ক্রিকেটীয় শট খেলে প্রথম সাত ওভারেই বাউন্ডারি মারেন সাতটি।
তিনে নেমে কুসাল মেন্ডিস ছিলেন উল্টো চেহারায়। একদমই জড়সড় ছিলেন তিনি। পরে তানজিম হাসানের এক ওভারে চার-ছক্কায় ছন্দে ফেরার আভাস দেন বটে। কিন্তু ইনিংস বড় করতে পারেননি লঙ্কানদের ভারপ্রাপ্ত দলপতি। সাকিবের প্রথম ওভারে ছক্কার চেষ্টায় উইকেট হারান তিনি। পরের ওভারেই তানজিমকে প্রথম বিশ্বকাপ উইকেট উপহার দিয়ে ফেরেন নিসানকা (৩৬ বলে ৪১)।
আসালাঙ্কা উইকেট যাওয়ার পর থেকেই ছিলেন সাবলিল। ক্রিজে যাওয়ার পরপরই ছক্কা মারেন তিনি সাকিবকে। তাকে দারুণ সঙ্গ দেন সাদিরা সামারাউইক্রমা। গড়ে ওঠে কার্যকর জুটি। দুজনই যখন দারুণ খেলছেন, তখনই সাকিবের বলে উইকেট বিলিয়ে বিদায় দেন সামরাউইক্রমা (৪২ বলে ৪১)। থেমে যায় ৬৩ রানের জুটি।
ম্যাচের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা এরপরই। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস উইকেটে গিয়ে গার্ড নেন। এরপর হেলমেট আঁটসাঁট করতে গিয়ে ছিঁড়ে যায় স্ট্র্যাপ। নতুন হেলমেট নেওয়ার জন্য ইশারা করেন ড্রেসিং রুমের দিকে। এই পরিক্রমায় পেরিয়ে যায় অনেকটা সময়। নিয়ম অনুযায়ী, এক ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছাড়ার পর নতুন ব্যাটসম্যানকে পরবর্তী বল খেলতে প্রস্তুত থাকতে হয় ২ মিনিটের মধ্যে। সাকিব আবেদন করেন আউটের। এরপর আউট না দিয়ে উপায় ছিল না আম্পায়ারের। কোনো বল না খেলেই আউট হয়ে ম্যাথিউস ফিরে যান ক্ষুব্ধ হয়ে।
১৩৫ রানে ৫ উইকেট হারানো শ্রীলঙ্কাকে চেপে ধরার বড় সুযোগ তখন বাংলাদেশের সামনে। কিন্তু আসালাঙ্কা ও ধানাঞ্জায়া ডি সিলভার দারুণ ব্যাটিংয়ে আলগা হয় ফাঁস। বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান আসে এই জুটিতে।
বাইরে কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান আর বাকি ছিল না। এই জুটিকেই তাই টানতে হতো অনেকটা সময়। সেই দাবি মেটাতে ব্যর্থ হন ধানাঞ্জায়া। ৩৪ রান করে মেহেদী হাসান মিরাজকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলার চেষ্টায় উইকেট ছুঁড়ে দেন তিনি। শ্রীলঙ্কার তিনশ ছোঁয়ার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় সেখানেই।
এরপর লোয়ার অর্ডারদের নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান আসালাঙ্কা। ৪৫ রানের জুটি গড়েন তিনি মাহিশ থিকসানার সঙ্গে, দুশমান্থা চামিরার সঙ্গে ২০ রানের। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় শতরান স্পর্শ করেন তিনি ১০১ বলে।
সেঞ্চুরির পর বিশাল এক ছক্কা মারেন তিনি তানজিমকে। এরপরই আউট হয়ে যান ১০৫ বলে ১০৮ করে। শ্রীলঙ্কা খেলতে পারেনি পুরো ৫০ ওভারও।
বিশ্বকাপ অভিষেকে শেষ সময়ে দুটি উইকেটসহ তিন উইকেট নিতে পারেন তানজিম, তবে রান খরচ করেন ৮০!
শ্রীলঙ্কার লক্ষ্য দাঁড় করায় ২৮০। এই উইকেটে যা যথেষ্ট নয় মোটেও। সাকিব-শান্তরা সেটিই প্রমাণ করে ছাড়েন পরে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
শ্রীলঙ্কা: ৪৯.৩ ওভারে ২৭৯ (নিসানকা ৪১, পেরেরা ৪, মেন্ডিস ১৯, সামারাউইক্রামা ৪১, আসালাঙ্কা ১০৮, ম্যাথিউস ০, ডি সিলভা ৩৪, থিকশানা ২১, চামিরা ৪, রাজিথা ০, মাদুশাঙ্কা ০*; শরিফুল ৯.৩-০-৫১-২, তাসকিন ১০-১-৩৯-০, তানজিম ১০-০-৮০-৩, সাকিব ১০-০-৫৭-২, মিরাজ ১০-০-৪৯-১)
বাংলাদেশ: ৪১.১ ওভারে ২৮২/৭ (তানজিদ ৯, লিট্ম ২৩, শান্ত ৯০, সাকিব ৮২, মাহমুদউল্লাহ ২২, মুশফিক ১০, হৃদয় ১৫*, মিরাজ ৩, তানজিম ৫*; মাদুশাঙ্কা ১০-১-৬৯-৩, থিকশানা ৯-০-৪৪-২, রাজিথা ৪-০-৪৭-০, চামিরা ৮-০-৫৪-০, ম্যাথিউস ৭.১-১-৩৫-২, ধানাঞ্জয়া ৩-০-২০-০)
ফল: বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: সাকিব আল হাসান