নিউ জিল্যান্ড দলের সংবাদ সম্মেলন দুপুর দেড়টায়। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলন কক্ষ জনাকীর্ণ হয়ে উঠল মিনিট দশেক আগেই। ভারত, বাংলাদেশের মতো দলগুলির সংবাদ সম্মেলন নির্ধারিত সময়ে না হওয়াটাই যেন নিয়ম। সবাই স্বাভাবিক ধরে নেয় এটাকে। নিউ জিল্যান্ড দল এখানে বরাবরই দারুণ পেশাদার। ঘড়ির কাটা ধরেই চলে তারা। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট পেরিয়ে গেলেও তাদের দেখা নেই!
সংবাদ সম্মেলন কক্ষে ফিসফাস শুরু হলো। নিউ জিল্যান্ডও তাহলে দেরি করে! বাবর আজমের গল্প শোনালেন একজন সংবাদকর্মী। কয়েকদিন আগে একটি সংবাদ সম্মেলনে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে মিনিট দশেক দেরি হবে বলে পাকিস্তান অধিনায়ক ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিলেন। এরপর ঠিক ১০ মিনিট পরই হাজির হয়ে যান। আরেকজন মজা করে বললেন, “সবকিছু ঠিকঠাক করেও তো নিউ জিল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হতে পারছে না, এজন্যই এবার হয়তো তারা নিয়মে গড়বড় করে দেখছে, যদি কিছু হয়!”
সেই হাসির রোলের মধ্যেই কক্ষে ঢুকলেন কেন উইলিয়ামসন। তাকে দেখলেই এক ধরনের মানসিক প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় মন। ২২ গজে ব্যাট হাতে বা মাঠের ভেতরে যেমন, তেমনি মাঠের বাইরেও তিনি একইরকম। সৌম্যদর্শন, স্থির। স্মিত করে হাসেন, মোলায়েম সুরে কথা বলেন… ক্রিকেটারের চেয়ে তাকে বেশি মনে হয় যেন দার্শনিক। তার কথা শুনলে সেটি আরও বেশি মনে হয়। ক্রিকেটীয় আলোচনায়ও অনেক সময় মিশে থাকে গভীর জীবনবোধ।
সেরকমই একটি সংবাদ সম্মেলনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন সবাই। কিন্তু এখানেও দেখা গেল একটু ব্যতিক্রম। অবশ্যই তা আনন্দদায়ী ব্যতিক্রম। উইলিয়ামসনের অন্য রূপও দেখা গেল। যে উইলিয়ামসন খুবই রসিক, যার কথায় বারবার হাসির ফোয়ারা ছুটল গোটা কক্ষে।
অবশ্যই তা স্বস্তা কিছু নয়, তার রসিকতাও যেন উইলিয়ামসনময়।
শুরুতেই একজনের প্রশ্ন, “আমরা একটু ইতিহাসে ফিরে তাকাই… ৭০ বছর আগে…”, প্রশ্ন এই পর্যন্ত হতেই উইলিয়ামসন খুব গম্ভীর মুখে বললেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই… আমার তো খুব মনে আছে!”
তার কথা শুনে ও বলার ভঙ্গি দেখে গোটা কক্ষ ফেটে পড়ল হাসিতে।
প্রশ্নকর্তা শেষ করলেন তার প্রশ্ন, “৭০ বছর আগে নিউ জিল্যান্ডের পর্বতারোহী এডমুন্ড হিলারি প্রথম মানব সন্তান হিসেবে পা রেখেছিলেন এভারেস্ট চূড়ায়। নিউ জিল্যান্ড কখনও বিশ্বকাপ জেতেনি। আপনি কি হিলারির মতো এখানে প্রথম হতে পারবেন?”
উইলিয়ামসনকে দেখে বোঝা গেল, প্রশ্নটায় তিনি বেশ চমৎকৃত হয়েছেন বা মজা পেয়েছেন। উত্তর দিতে যাবেন, তখনই সাউন্ড সিস্টেমে গড়বড়। উইলিয়ামসনের চরিত্রের রসিক দিকটি ফুটে উঠল আবার। একবার বলে উঠলেন, “মাইক চেক মাইক চেক মাইক চেক…।” মুখে নানারকম ভঙ্গি করতে থাকলেন। সংবাদ সম্মেলন কক্ষেও হাসির রোল বয়ে যেতে থাকল।
সাউন্ড সিস্টেমের সমস্যা তবু ঠিক হয় না। আইসিসির কর্মকর্তা ও টেকনিশিয়ানদের ছুটোছুটি চলতে থাকল। সময় গড়িয়ে গেল আরও কিছু। সেই প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে উইলিয়ামসন বললেন, “আপনি তো খুবই ভাগ্যবান, বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালের আগে সংবাদ সম্মেলনে আপনিই একমাত্র প্রশ্নকর্তা… আর কেউ সুযোগ পাবেন বলে মনে হয় না!”
নিউ জিল্যান্ডের মিডিয়া ম্যানেজার উইলি নিকোলস (ক্রিকেটার হেনরি নিকোলসের বড় ভাই) খানিকটা অস্থির হয়ে উঠলেন। অনুশীলন শুরুর সময় এগিয়ে আসছে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, উইলিয়ামসন বিরক্ত হয়ে ওঠেন কি না! বারবার আড়চোখে দেখছিলেন অধিনায়কের দিকে।
কিন্তু তিনি তো উইলিয়ামসন… তিনি আর দশজনের মতো হবেন কেন! বিরক্ত নিশ্চয়ই তিনিও হন, রেগে যান… মানুষ তো। তবে সেসবের কোনো প্রকাশ তার কথায় বা আচরণে কখনও ফুটে ওঠে না। এবারও যেমন মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে তিনি অপেক্ষা করে গেলেন এবং মজা করতে থাকলেন।
অবশেষে বেশ কিছুক্ষণ পর সাউন্ডের সমস্যা ঠিক হলো। উইলিয়ামসন ততক্ষণে গোটা কক্ষের আবহ বদলে ফেলেছেন। সাউন্ডের সমস্যা ঠিক হতেই কক্ষের সবাই তুমুল করতালি দিল, উইলিয়ামসনও মজা পেলেন বেশ।
এডমুন্ড হিলারির সেই প্রশ্নটা থেকেই আবার শুরু হলো। উইলিয়ামসন শুরু করলেন, “গ্রেট কোয়েশ্চেন…।” আরেক দফা হেসে উঠল সবাই। উইলিয়ামসন অবশ্য এরপর উত্তর দিলেন তার মতো করেই।
তার চোটের প্রসঙ্গ এলো। এই বিশ্বকাপ তো তার খেলারই কথা ছিল না। গত ৩১ মার্চ আইপিএলের নতুন আসরে প্রথম ম্যাচে ফিল্ডিংয়ের সময় ভয়ঙ্কর চোট পেয়ে মাঠের বাইরে ছিটকে গিয়েছিলেন লম্বা সময়ের জন্য। তাকে ছাড়া বিশ্বকাপ খেলার মানসিক প্রস্তুতি ও যাবতীয় পরিকল্পনা সেরে ফেলেছিল নিউ জিল্যান্ড। কিন্তু প্রত্যাশার চেয়ে একটু দ্রুত তিনি সেরে উঠতে থাকেন। দলও আশাবাদী হয়ে দারুণভাবে সামলাতে থাকে তার পুনবার্সন প্রক্রিয়া।
বিশ্বকাপের ঠিক আগের মাসে ইংল্যান্ড সফরেও দলের সঙ্গে রাখা হয় তাকে। তখনও তিনি ম্যাচ খেলার মতো ফিট নন। তবু তাকে সফরে পাঠানো হয় দলীয় আবহে থাকা, পরিকল্পনাসহ সবকিছুতে সম্পৃক্ত থাকার জন্য যেন বিশ্বকাপে গিয়ে সমস্যা না হয়।
পুরোপুরি ফিট হয়ে উঠতে না পারলেও বিশ্বকাপ দলে তাকে রাখা হয়। অবশেষে বিশ্বকাপের তৃতীয় ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ পান তিনি। সাড়ে ৮ মাস পর প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে নেমেই বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ৭৮ রানের ইনিংস উপহার দেন। মাঠে ও উইকেটে এমন স্বতস্ফূর্ত বিচরণ ছিল যেন, তিনি এক ম্যাচও বাইরে ছিলেন না!
কিন্তু সেই ম্যাচেই বাংলাদেশের ফিল্ডারের থ্রো তার আঙুলে লাগে। ব্যাটিং চালিয়ে যেতে পারেননি। ৭৮ রানে মাঠ ছাড়েন। পরে জানা যায়, বলের ছোবলে চিড় ধরেছে তার আঙুলে। আবার মাঠের বাইরে! তিন সপ্তাহ পর ফেরেন বেঙ্গালুরুতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। এবারও ফিরেই খেলেন ৭৯ বলে ৯৫ রানের ইনিংস। বিস্ময়কর, কিন্তু তিনি বলেই যেন খুব স্বাভাবিক!
চোটের সঙ্গে এই লড়াই নিয়েও মজার সুরে বললেন, “বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল আমার এই পথচলা... একটা পর্যায়ে বিশ্বকাপের ধারেকাছে আসারও সুযোগ ছিল না আমার, সেটিই পরে বাস্তব হয়ে ওঠে, একটা লক্ষ্য ঠিক করার সুযোগ পাই এবং সেটি করতে পেরে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। এরপর মাঠে নেমেই বুড়ো আঙুল ভেঙে ফেললাম…।”
আঘাত পাওয়ার কথাও এমনভাবে কথাটি বললেন, আবার হেসে উঠলেন সবাই। পরমমুহূর্তে তিনিই আবার যোগ করলেন, “আসলে এটা মজার কিছু নয়। বরং হতাশারই ছিল… পাশাপাশি এটা ভেবেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম যে, গোটা টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়িনি। সেদিক থেকে আবার নিজেকে ভাগ্যবানও মনে হচ্ছিল। এখন ভালো লাগছে যে কালকের থেকে আজকে একটু বেশি ফিট আছি এবং এখানে বসে কথা বলছি!”
এই হলেন উইলিয়ামসন। নিজের চোট নিয়েও মজা করছেন, হতাশার সময়েও ইতিবাচকতার ছবি দেখছেন। আরও কতবার যে হাসালেন তিনি, মজা করলেন। কিন্তু ঠিকই তার চেনা ক্রিকেটবোধ আর পরিমিতিবোধের ছাপ থাকল সবকিছুতে। পরদিন ভারতের বিপক্ষে সেমি-ফাইনাল, তাদের প্রতি সবটুকু সম্মান ও সমীহ দিয়েই বললেন নিজেদের চাওয়ার কথা।
তাকে নিয়ে এমনিতেই লোকের মুগ্ধতার শেষ নেই। এই সংবাদ সম্মেলনে সেই মুগ্ধতার পরশেই তিনি সবাইকে মাখামাখি করলেন আবার।
ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি কোন উচ্চতায়, সেটি নিয়ে তো চর্চা হয়ই কত। ২৮টি টেস্ট সেঞ্চুরির পাশে ১৩টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি, দুই সংস্করণেই দারুণ ব্যাটিং গড়, অসাধারণ সব ইনিংস… অনেকের মতে তিনিই নিউ জিল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। বিশ্ব ক্রিকেটে তার সময়ের সেরাদের একজন তো বটেই, ক্রিকেট ইতিহাসেরও সেরাদের একজন। গত বিশ্বকাপের ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট, এবারও সীমিত সুযোগে নিজেকে মেলে ধরেছেন বিশ্বমঞ্চে।
নেতৃত্বেও তিনি দারুণ, ব্যক্তিত্বে মোহনীয়।
এখানেই তিনি অনন্য। তার বিনয়, তার সম্মানবোধ, তার জীবনাচরণ, তার দর্শন আর জীবনবোধ, সব কিছু মিলিয়ে তিনি স্রেফ একজন ক্রিকেটার বা গ্রেট ব্যাটসম্যান কিংবা দারুণ অধিনায়কই নন, তিনি অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। কখনও কখনও ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়েও।
নিজ দেশ, নিজ দলের সাফল্য সবারই কামনায় থাকে। তবে এরকম কোনো জরিপ যদি হয় যে ‘অন্য কোন দলের সাফল্য চান বা কার হাতে ট্রফি দেখতে চান’, সেখানে নিউ জিল্যান্ড আর কেন উইলিয়ামসনের বিপুল ব্যবধানে জয়ী হওয়ার কথা। সেটার কারণ কি শুধু ক্রিকেটীয়? মোটেও তা নয়!
উইলিয়ামসনের সংবাদ সম্মেলন শেষে এক ভারতীয় সংবাদকর্মী বললেন, “আমরা কেন তার মতো হতে পারি না? সবাই কি তার মতো হতে পারে না!”
তিনি কেমন? তিনি খুব সাধারণ। তারপরও আমরা তার মতো হতে পারি না। কারণ, সাধারণ থাকতে পারার মতো অসাধারণ কিছু যে আর নেই!