প্রথম কথায় একটু ইঙ্গিত দিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। ভিন্ন কিছুর আলামত তাতে ফুটে উঠল। এরপর যখন আরেকটি প্রশ্ন করা হলো সরাসরি, তখন রাখঢাক অনেকটাই সরিয়ে ফেললেন তিনি। বিশ্বকাপজুড়ে দল থেকে বারবার অস্বীকার বা এড়িয়ে যাওয়ার পর অবশেষে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক স্বীকার করলেন, বিশ্বকাপে ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে নাড়াচড়া ‘অনেক বেশি’ করা হয়েছে।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনেই ব্যাটিং অর্ডারের প্রশ্ন ছিল একরকম অবধারিত। কখনোই তা খুব অপ্রাসঙ্গিক বা অযৌক্তিক ছিল না। ব্যাটিং অর্ডার যে একদমই স্থির ছিল না!
প্রথম ম্যাচ থেকে চোখে লেগেছে ব্যাটিং অর্ডারের ওলটপালট। ক্রমে সময় যত গড়িয়েছে, সেটির মাত্রা বেড়েছে ক্রমে। স্রেফ উদ্বোধনী জুটি ছাড়া অন্য কোনো পজিশন ঠিক ছিল না কারও। উদ্বোধনী জুটি টানা ব্যর্থ হলেও বদল আনা হয়নি। অন্যান্য পজিশনে পরিবর্তন ছিল নিয়মিত। যে পজিশনে যে অভ্যস্ত, যেখানে খেলে সাফল্য এসেছে, সেসব পজিশনে কাউকে স্থির রাখা হয়নি।
মূলত মেহেদী হাসান মিরাজকে ওপরে নানা পজিশনে খেলাতে গিয়েই ব্যাটিং অর্ডারের এই পরিবর্তন হতে থাকে। দলের এই কৌশল প্রশ্নবিদ্ধও হয় প্রচুর। অস্থিরতার প্রভাব ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্সে পড়েছে বলেই মনে করা হয়েছে একদম শুরু থেকে। কেবল মাহমুদউল্লাহ ছাড়া আর কোনো ব্যাটসম্যান বিশ্বকাপে ধারাবাহিক হতে পারেননি বা প্রত্যাশার ধারেকাছে পারফর্ম করতে পারেননি।
৭ ইনিংসে ৫৪.৬৬ গড় ও ৯১.৬২ স্ট্রাইকরেটে ৩২৮ রান করা মাহমুদউল্লাহ এই বিশ্বকাপে দলের সফলতম ব্যাটসম্যান। এছাড়া আর কোনো ব্যাটসম্যান ৩০০ রানও করতে পারেননি। ব্যাটিং গড় ৩৫ নেই আর কোনো ব্যাটসম্যানের। অথচ আফগানিস্তানের চার ব্যাটসম্যান রান করেছেন তিনশর বেশি।
এই ব্যর্থতার পেছনে স্কিল ও মানসিকতার ঘাটতি তো ছিলই। তবে ব্যাটিং অর্ডারের ক্রমাগত রদবদল বড় প্রভাব রেখেছে বলে মনে করছেন অনেকেই। একটি-দুটি পজিশন এদিক-সেদিক হওয়া মানেও আসলে ভূমিকার বড় বদল। সেই চ্যালেঞ্জ নিতে পারেননি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।
বিশ্বকাপের আগেই অবশ্য অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, যে কাউকে যে কোনো পজিশনে ব্যাটিং করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। বিশ্বকাপের সময়ও ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে প্রশ্ন খুব একটা পাত্তা দেননি তিনি। কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহেও এটিকে গুরুত্ব দেননি বা দিতে চাননি। দলের অন্য সদস্যরা যারা সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন, তাদের তো আসলে প্রকাশ্যে দ্বিমত করার সুযোগ ছিল না।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচের পর অবশেষে কিছুটা ভিন্ন সুর শোনা গেল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে শান্তকে প্রথম প্রশ্নই করা হলো সেই ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক আগের কথাগুলোর সঙ্গেই একটু অন্য ভাবনা জুড়ে দিলেন ছোট্ট করে।
“আমার মনে হয়, ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে কোনো ব্যাটসম্যানের অভিযোগ ছিল না। যে যেখানে ব্যাটিং করেছে, সবাই খুশি ছিল। পাশাপাশি এটাও বলতে চাই, আমরা যেভাবে এসেছিলাম, ওই জায়গায় যদি একই রকম থাকত, ভিন্ন কিছু হলেও হতে পারত। ওটা হলেই যে আমরা অনেক সফল হয়ে যেতাম, এটা যেমন ঠিক নয়, আবার একই রকম থাকলে সাফল্যের পরিমাণ অনেক সময় বেশি থাকে। তবে আসলে এখন এটা নিয়ে কথা বলার বলার মানে হয় না।”
যদিও তিনি বলছেন এটা নিয়ে কথা বলার মনে হয় না, তবে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার ময়না তদন্ত হলে তো সবার আগে এই প্রসঙ্গটিই আসবে! সংবাদ সম্মেলনে তাই শান্তকে আবার বলা হলো, ‘কূটনৈতিক’ উত্তর না দিয়ে সরাসরি তার ভাবনা জানাতে। এবার মনের দুয়ার কিছুটা খুলে দিলেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান।
“(ব্যাটিং অর্ডারে ওলট-পালট) না করলেই ভালো। কিছু কিছু দলের বিপক্ষে অনেক সময় করতে হয়, ওই দলের শক্তিমত্তা অনুযায়ী। তবে যত কম করা যায়…এই বিশ্বকাপে অনেক বেশি করা হয়েছে…। এটার পেছনেও ভালো কিছু চিন্তা করেই করা হয়েছে, সত্যি বললে। প্রতিপক্ষ দলের শক্তি অনুযায়ী করা হয়েছে। তবে যত কম করা যায়… না করলে সবচেয়ে ভালো হয়।”
শান্ত নিজে তিন নম্বরে ভালো করতে থাকলেও বিশ্বকাপে তিন-চারে ছুটোছুটি করতে হয়েছে। তার অসন্তুষ্টি কিছুটা ফুটে উঠল কথায়। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয়েছে তাওহিদ হৃদয়ের। এরকম আরও অনেকের ভাবনা হয়তো আস্তে আস্তে প্রকাশ্য হবে। তাতে পেছন ফিরে গিয়ে এই বিশ্বকাপকে শোধরানো যাবে না। তবে ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার উপকরণ হয়তো মিলবে।