একটি ঝুঁকিপূর্ণ রানের আহবানে সাড়া, একটি খ্যাপাটে দৌড়, একটি মরিয়া ডাইভ এবং তাতেও রক্ষা না পেয়ে মাথা নিচু করে মাঠ ছেড়ে যাওয়া। একটি ক্যারিয়ারের সমাপ্তি? এই উত্তর মিলবে হয়তো শিগগিরই। তবে বিশ্বকাপ অভিযানের সমাপ্তি তো বটেই! অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এভাবেই আউট হয়ে বিশ্বকাপে শেষবার ব্যাট হাতে মাঠ ছেড়ে গেলেন মাহমুদউল্লাহ। রেখে গেলেন একটি উত্তরাধিকার-ঝলমলে এক বিশ্বকাপ অধ্যায়।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে মাহমুদউল্লাহর জায়গা কোথায়, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের সঙ্গে একই বন্ধনীতে তাকে রাখতে কিংবা একই নিঃশ্বাসে তার নাম উচ্চারণে আপত্তি-অভিযোগ থাকতে পারে কারও কারও। তবে একটি ব্যাপার নিয়ে কোনো দ্বিমত বা সংশয়ের জায়গা খুব একটা থাকার কথা নয়। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবসময়ের সেরাদের ছোট্ট তালিকায়ও তাকে রাখতেই হবে।
আর বিশ্ব আসরে যারা উজ্জ্বল, বড় মঞ্চে যারা নায়ক, ইতিহাসেও তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে গৌরবময় আলাদা অবস্থান।
বিশেষ করে, এবার এই ৩৭ বছর বয়সে বিশ্বকাপে এসে প্রবল প্রতিকূলতা ও প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও যেভাবে পারফর্ম করেছেন এবং দলের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে মেলে ধরেছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তুলনীয় আর কিছু নেই। বিশ্বকাপে তিনি বিশেষ কিছু, তা ফুটে উঠেছে এবারও।
এবারের বিশ্বকাপ শেষ করলেন তিনি ৭ ইনিংসে ৫৪.৬৬ গড় ও ৯১.৬২ স্ট্রাইক রেটে ৩২৮ রান নিয়ে। বাংলাদেশের আর কোনো ব্যাটসম্যান ৩০০ রানও করতে পারেননি। ব্যাটিং গড়েও দলে তার ধারেকাছে নেই কেউ।
২০১৫ বিশ্বকাপেও রানের এই সীমানা পেরিয়েছিলেন তিনি। ৬ ইনিংসে ৩৬৫ রান করেছিলেন ৭৩ গড়ে।
দুটি ভিন্ন বিশ্বকাপে ৩০০ রানের ঠিকানায় পৌঁছতে পারা বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান এই মাহমুদউল্লাহ।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান তিনি, এমনকি দ্বিতীয় সেঞ্চুরিয়ানও। এই আসরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেঞ্চুরিটিতে নিজেকে নিয়ে গেছেন তিনি নতুন ও অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ সেঞ্চুরি তার। একাধিক বিশ্বকাপে শতরানের রঙে নিজেকে রাঙানোর একমাত্র কীর্তিও তার।
সব মিলিয়ে চার বিশ্বকাপে ২২ ম্যাচ খেলে মাহমুদউল্লাহর রান ৯৪৪। বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বকাপে তার চেয়ে বেশি রান করা করেছেন কেবল দুজন। সেই দুজন সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম ইনিংস খেলেছেন ঢের বেশি।
বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বকাপে অন্তত ৫ ইনিংস খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় মাহমুদউল্লাহর (৫২.৪৪)।
অন্তত ১৫ ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো স্ট্রাইক রেট তারই (৮৪.৮১)।
চার আসর মিলিয়ে বিশ্বকাপে ২৫টি ছক্কা মেরেছেন তিনি। ১৫টিও মারতে পারেননি বাংলাদেশের আর কোনো ব্যাটসম্যান।
এসব পরিসংখ্যানই ফুটিয়ে তুলছে, বিশ্বকাপে তিনি কোন উচ্চতায় নিজেকে তুলে নিয়েছেন।
এবারের বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্সে আরও প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তিনি বিশ্বকাপেরই ক্রিকেটার!
বিশ্বকাপ দল ঘোষাণার কয়েক দিন আগেও তিনি নিজেই জানতেন না, এই আসরে খেলতে পারবেন কি না বা আদৌ কখনও আর বাংলাদেশের জার্সিতে মাঠে নামতে পারেন কি না। গত মার্চে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দল থেকে তাকে বিশ্রাম দেওয়া হয়। ক্রমে পরিষ্কার হয়ে ওঠে, ওটা ছিল আসলে বিশ্রামের আবরণে বাদই। তিনটি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বাইরে থাকার পর যখন এশিয়া কাপেও সুযোগ মিলল না তার, তখন অনেকেই বাংলাদেশ দলে তার পথচলার শেষ দেখে ফেলেছিলেন।
তিনি সেসবে কান না দিয়ে ধৈর্য রেখে পরিশ্রম করে গেছেন, ব্যাটিং ও ফিটনেস নিয়ে তুমুল খেটেছেন এবং অপেক্ষা করে গেছেন। অন্যদের ব্যর্থতায় শেষ পর্যন্ত তার কাছেই ফিরতে হয়েছে দলকে। তিনি সুযোগটিকে আলিঙ্গন করেছেন, চ্যালেঞ্জ আর উষ্ণতায়। সুযোগ কাজে লাগিয়ে জ্বলে উঠেছেন। আরও একবার!
বিশ্বকাপে এবার প্রথম ম্যাচের একাদশে থাকলেও ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাননি। পরের ম্যাচে তাকে একাদশের বাইরে রাখা হয়। তার ওপর দলের যে খুব ভরসা ছিল না, এতেই ফুটে ওঠে না।
দলের তৃতীয় ম্যাচে ফিরে এসে কিছু রান করেন। এরপর ক্রমেই নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে থাকেন। রানের চেয়েও চোখে পড়ার মতো ব্যাপার ছিল রান করার ধরন। তার রিফ্লেক্স আগের চেয়ে বেড়ে গেছে আরও, ক্রিজে যাওয়ার পর থেকে দারুণ আগ্রাসী ও ইতিবাচক ব্যাটিং, জড়তা নেই বললেই চলে। নিজের সেরা সময়টায় ফিরে যান যেন।
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান পারেননি প্রত্যাশা পূরণ করতে। কেবল মাহমুদউল্লাহ ছাড়িয়ে যান প্রত্যাশাকে।
সবশেষ ম্যাচটিতেই যেমন দেখা গেছে, উইকেটে যাওয়ার পরপরই শন অ্যাবটের শর্ট বল উড়িয়েছেন ছক্কায়। একটু পর টানা দুটি ছক্কা মেরেছেন মিচেল মার্শকে। আরও একটি বড় ইনিংসের জন্য তাকে প্রস্তুত বলেই মনে হচ্ছিল। তখনই গড়বড়। অহেতুক এক সিঙ্গেল নিতে তাকে ‘কল’ করলেন তাওহিদ হৃদয়। মাহমুদউল্লাহ ছুটলেন প্রাণপণে। শেষ মুহূর্তে নিজেকে বাঁচাতে ডাইভ দিলেন। কিন্তু তার আগেই মানার্স লাবুশেন গোটা শরীর শূন্যে ভাসিয়ে অসাধারণ সরাসরি থ্রোয়ে উড়িয়ে দেন বেলস।
সম্ভাবনাময় ইনিংস থমকে যায় ওখানেই। মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়েন তিনি। তবে তার পারফরম্যান্সই মাথা উঁচু করিয়ে দিচ্ছে তার।
আগামী বিশ্বকাপে তিনি থাকছেন না নিশ্চিতভাবেই। এই বিশ্বকাপের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই আর থাকবেন কি না, সেই কৌতূহলও আছে। তবে যেটাই হোক, মাথা তার উঁচুতেই। বরং অসংখ্য কুর্নিশ তার প্রাপ্তি।
শনিবার রান আউট থেকে বাঁচতে ডাইভের সময় হাতে চোট পান তিনি। ব্যান্ডেজ করা হয়, হাত ঝুলিয়ে দেওয়া হয় স্লিংয়ে। দেশে ফেরার পর স্ক্যান করানো হবে। তবে শরীরে চোট থাকলেও মনে নিশ্চয়ই তার প্রশান্তিই খেলা করছে। দলের ব্যর্থতার আক্ষেপ তো থাকবেই, পাশাপাশি অন্তত নিজের জয়ের স্বস্তি তো আছে!
শেষ ইনিংসটিতে দারুণ শুরু করেও স্মরণীয় করে রাখতে পারেননি তিনি। তবে আসরজুড়ে যেভাবে খেলেছেন, আরও একবার নিশ্চিত করেছেন, বিশ্বকাপের মাহমুদউল্লাহকে মনে রাখতেই হবে, ভালো বাসতেই হবে।